জননী সাহসিকা ও একাত্তরে তাঁর উপলব্ধির দিনপঞ্জি -রাখী দাশ পুরকায়স্থ

১৯৭১ সালে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এই ভূখণ্ডের নারী-পুরুষ, শিশু যুবা- সব বয়সের মানুষের মনে নানা উপলব্ধি আর অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত হওয়ার চিত্র এঁকেছে অকপটে; এ কথা আজ ৪৫ বছরে এসেও জলছবির মতোই দীপ্যমান হয়ে আছে। সাধারণ মানুষ যখন একসঙ্গে মিলে অভূতপূর্ব সংগ্রামী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময়কে অতিক্রম করে তখন তা ঘটনা হিসেবে তাদের কাছে মর্যাদা লাভ করে। কিন্তু সমাজে অগ্রগামী চিন্তাচেতনা আর ধারণার মানুষ স্বপ্ন নিয়ে ক্রমেই ভবিষ্যৎকে সুস্পষ্টভাবে দেখতে আগ্রহী হয়। জীবনকে ছন্দময়, সুন্দর ও তাৎপর্যপূর্ণ করতে সাধনা, ত্যাগ, সদিচ্ছা, শ্রম আর অঙ্গীকার যে প্রধান উপজীব্য হয় তার দৃষ্টান্ত এই সমাজে, এই দেশে একবারেই কম নেই।

এমন অনন্য, অনিঃশেষ মায়া-মমতা আর চিত্তবৈভবে পূর্ণ আপন দ্যুতিতে ভাস্বর এক ব্যক্তিত্বের নাম জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল। জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর গুণমুগ্ধ বিদগ্ধজনের জবানিতে পাওয়া যায়, ‘কবি সুফিয়া কামাল সমকালীন বাংলাদেশের এক অনন্য প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন। অর্থাৎ প্রতীকটি হলো জীবনযাপনের সরলতা ও স্নিগ্ধ মাধুর্য। অন্তর শক্তির তেজঃময় বিভা ও বাঙালি মাতৃহৃদয়ের শাশ্বত রূপ’ (শামসুজ্জামান খান : তাঁর মতো আর কেউ নয়)। কিংবা ‘শুধু সাহিত্য নয়, বাংলাদেশের জনগণের মনে বেগম সুফিয়া কামাল ধ্রুব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন তাঁর স্বকীয় স্বভাবগুণে। বাংলাদেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন, তিনি অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং শাসকের জবাবদিহিতার কথা বারবার উচ্চারণ করেন’ (জননী গরীয়সী : মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)।
‘স্পষ্ট করে আপন জানা থেকে বলি, ১৯৪৬ সালে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধের দিনগুলো থেকে আশি-নব্বইয়ে মৌলবাদ-স্বৈরাচার আগ্রাসনের কাল অবধি তাঁকে পেয়ে এসেছি। কিশোর-তরুণদের তিনি সংগঠিত করেছেন প্রতিরোধের কাতারে। দেখেছি বরাভয় উত্তোলিত তাঁর দক্ষিণ হস্ত, নিঃশঙ্ক চোখের ভাষায় স্পষ্ট দিকনির্দেশনা, মাথায় স্বল্পোচ্চ ক্ষীণকায়া ওই মহিলা, কণ্ঠস্বর ধীর-মসৃণ। না কোনোভাবেই ক্যারিশমায় অলংকৃতা নন তিনি। তবে কতনা বৈরী ভুবনে তাঁর পদচারণা, নেতৃত্ব। তা মুক্তির সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ অবধি প্রসারিত’ (কবীর চৌধুরী- অবিস্মরণীয় বেগম সুফিয়া কামাল)।

‘কত বুদ্ধিজীবীর স্টাডিতে, কবিদের আস্তানায় বস্তিতে বস্তিতে আলোকিত পদ্মের মতোই ফুটে ওঠে তাঁর মাতৃমুখ’ (শামসুর রাহমান : কবির খা-খা ঘর শুধু অশ্রুপাত করে)। তাঁর সম্পর্কে এ রকম উচ্ছ্বসিত আবেগ আর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে আরো অনেকেরই লেখায়। এমন যে চিরঞ্জীবী মানুষ আমাদের জননী সাহসিকা কবি সুফিয়া কামাল মহান সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে সাঝের মায়ায় তাঁর অবস্থান ও আত্মোপলব্ধির গভীরতার দেখা মেলে নিজের লেখা দিনপঞ্জিতে।

তিনি যখন বলেছেন তাঁর একাত্তরের ডায়েরির ভূমিকায়, ‘ভূমিকা নয়, রক্তে লেখা শোক’; তখন অনুভব করা যায় তাঁর ভেতরের আহত, আক্রান্ত, ক্ষুব্ধ মানবসত্তার আকুতি। তিনি লিখেছেন :

“একাত্তরের ডায়েরির সব কটা পাতা ভরে তুলতে পারিনি, অনেক কথাই রয়ে গেছে অব্যক্ত। ডায়েরিটা পেয়েছিলাম ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে। ভেবেছিলাম ৭১-এই শুরু করব। এর মধ্যে ঘটে গেল ৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস। যেতে হলো দক্ষিণবঙ্গে রিলিফের কাজে। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে গেলাম। নিঃস্ব মানুষের শোকে-দুঃখে শরিক হয়ে ঢাকায় ফিরে কিছুদিন পর মানুষের সংগ্রামের মিছিলে অংশ নিলাম। ২৫ মার্চ শুরু হলো পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর মারণযজ্ঞ। অনেক কিছুই দেখলাম-শুনলাম বাসায় বসে বসে। সব কথা লেখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা লেখা হয়নি, যা বলা প্রয়োজন তাই এই মুখবন্ধ।

মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের কোটি কোটি কিশোর-যুবা, তরুণ-তরুণী যোগ দিয়েছিল। শহীদ হয়েছে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভ্রম হারিয়েছে তিন লাখ নারী। তাদের উদ্দেশেই আমার ডায়েরিটি উৎসর্গ করলাম। ওদের জন্য আমি বড়ই উদ্বেগ নিয়ে কাটিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের পুরা সময়টা। ওরা ফেরেনি। মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস আমি বারান্দায় বসে বসে দেখেছি পাকিস্তানি মিলিটারির পদচারণা। আমার পাশের বাসায় ছিল পাকিস্তানি মিলিটারির ঘাঁটি। ওখানে দূরবীন চোখে পাকবাহিনীর লোক বসে থাকত। রাস্তার মোড়ে, উল্টো দিকের বাসায়- সবখানে ওদের পাহারা ছিল। নিয়াজী শেষ সময়ে আত্মরক্ষা করতে ওই বাসায় লুকিয়েছিল।

কাঁথা সেলাই করেছি ৯ মাসে ৯টি। প্রত্যেকটি ফোঁড় আমার রক্তাক্ত বুকের রক্তে গড়া। বড় কষ্ট ছিল। কষ্ট এখনো আছে। স্বাধীন বাংলা গড়ার জন্য যারা ছিল অমূল্য সম্পদ- সেই মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, শহীদুল্লা কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, ডা. আলিম চৌধুরী ও ডাক্তার মর্তুজা- এ রকম আরো সোনার ছেলেরা-মেয়েরা রাজাকার-আলবদরের হাতে শহীদ হয়েছে। এদের কথা আমি কী করে ভুলি!”

বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি লিখেছেন- আমার ‘দুলু’র মুখ দেখি আজ বাংলার ঘরে ঘরে শ্বেতবাসা, আর শূন্য দু’হাত নয়নে অশ্রু ঝরে বুকে করে সন্তানে।

…আজ মুছি অশ্রুর ধারা সন্তানহীন মাতা জয়ে, গৌরবে প্রার্থনা করে ওগো দাতা ওগো ত্রাতা সুন্দর কর মহামহীয়ান কর এ বাংলাদেশ এই মুছিলাম অশ্রুর ধারা দুঃখের হউক শেষ। সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের ৪৪ বছর অতিক্রম করার কালে জননী কবি সুফিয়া কামালের এই অমোঘ সত্যকথন ‘আগামীকালের দিন কিভাবে শুরু হবে?’ এই আত্মজিজ্ঞাসাকে সামনে নিয়ে নারী আন্দোলন দেশ ও সমাজ প্রগতির আন্দোলনের সব প্রতিকূলতা ভেদ করে তাঁর আদর্শের অনুসারী, গুণমুগ্ধ সবাই একযোগে অগ্রসর হব। আজ জন্মজয়ন্তীতে জননী সাহসিকার প্রতি এই হোক শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman