ধর্ষণের অপরাধে বিবাহ: শাস্তি না পুরস্কার! – স্বাতী চৌধুরী

আমাদের গ্রাম্য ও তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ দুটোই পুরুষতন্ত্র দ্বারা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখনো একটি মেয়ের জীবনের সার্থকতা বিবাহ বা একটি পুরুষের সঙ্গে যেনতেনভাবে জুড়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত বলে ভাবা হয়। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার নামই যে জীবন, সেই শিক্ষা বা বোঝার সুযোগ তো সবাই পায় না।
কয়েক বছর ধরে দেখছি, দেশে একটার পর একটা ঘটনা ঘটে আর প্রতিবাদী মানুষের মস্তিষ্ক নতুন ঘটনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, যার ফলে পূর্ববর্তী ঘটনাটার প্রতিবাদেও যে লেগে থাকা উচিত, সেটা হয়তো আর মনে থাকে না। মনে না থাকাই স্বাভাবিক। এত ঘটনা-দুর্ঘটনার ঘনঘটায় মানুষের ভাবনা ও চিন্তার খেই হারিয়ে যায়। যেমন কিছুদিন আগে একটি ধর্ষণ মামলায় জামিন পাওয়ার শর্ত হিসেবে এক আসামি আদালতেই মামলার বাদীকে বিয়ে করেছেন; এ রকম একটি ঘটনা আলোচনায় এসেছিল। এ বিষয়ে আর কথা হচ্ছে না। ফলে জানা গেল না এরপর কী ঘটেছে।
আসলে ওই আসামি ও বাদীর বিয়েটি হয়েছিল ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজের আদালতে। জানা গেছে, ওই মামলার আসামি হাসানুজ্জামান একজন প্রকৌশলী। ধর্ষণ মামলায় দেড় মাস জেল খাটার পর কারামুক্ত হওয়ার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাদীকে বিয়ে করবেন। আদালত বিয়ে করার শর্তে তাঁকে জামিন দিয়েছেন। শর্ত মোতাবেক আদালতে বিয়েও সম্পন্ন হয়েছে। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন বলছে, ধর্ষণ মামলা প্রত্যাহারের কোনো সুযোগ নেই। অবশ্য আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে মামলার বাদীর এই বিয়েও নতুন কিছু নয়। তবে ২০২০ সালে ধর্ষণের বিরুদ্ধে ও ধর্ষকের কঠোর শাস্তির দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়াসহ রাজপথের আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল হলে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড আইন পাস হয়। কিন্তু তারপর আদালতেই ধর্ষণ মামলার বাদী ও বিবাদীর মধ্যে কয়েকটি বিয়ে হলে বিশেষভাবে তা সচেতন মহলের নজরে আসে এবং এর বিরুদ্ধে কথা ওঠে। তা সত্ত্বেও এ ধরনের তৎপরতা বন্ধ যে হয়নি, আলোচিত ঘটনা সেটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রশ্ন হলো, যে মামলা প্রত্যাহার করার বা আপস করার সুযোগ নেই, সেখানে এরূপ বিয়ে, তা-ও আবার আদালত প্রাঙ্গণে হচ্ছে কী করে? তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল যে, আইনের রক্ষক আদালতের সামনেই আইন ভাঙা হচ্ছে। কিন্তু কেন? এসব আইনকানুন ও নীতি যাঁরা প্রণয়ন করেন, সেই সব নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কোনো বক্তব্য বা এ বিষয়ে তাঁরা কী ভাবছেন, তা সেভাবে মিডিয়ায় বা কোথাও শোনা যায় না কেন? কিন্তু আমরা জানি, সচেতন সাধারণ মানুষের এখানে অনেক বক্তব্য আছে। সেই সব বক্তব্যে যাওয়ার আগে সাধারণ মানুষের কয়েকটা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা যাক। যেমন আসামি হাসানুজ্জামান বা এ রকম প্রতিটি মামলার আসামি যখন মামলার বাদীকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি তাঁর অপরাধ স্বীকার করে নেন বলেই তো ধরে নেওয়া হয় (কারণ ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো নিরপরাধ লোকের পক্ষে এ রকম মিথ্যা ও নোংরা অপবাদ স্বীকারপূর্বক আপস করা সম্ভব নয়। একজন নির্দোষ লোক তাঁর সম্মান বাঁচানোর জন্য এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন)। আলোচ্য হাসানুজ্জামান সমাজের একজন এলিট ব্যক্তি। তিনি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের প্রকৌশলী। তাঁর পক্ষে মিথ্যা অপবাদ মেনে নেওয়াটা কী প্রশ্নহীন হতে পারে? এটা তো সহজেই অনুমানযোগ্য যে তিনি অপরাধ করেছেন বলেই মামলা প্রত্যাহার করার জন্য বাদীকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অথচ এই সিদ্ধান্ত আগে নিলে ঘটনা এত দূর গড়াত না। কিন্তু তিনি নেননি। ভেবেছিলেন, তিনি পুরুষ মানুষ হিসেবে একটি মেয়েকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মাসের পর মাস স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে বসবাস করতে পারেন। আবার ইচ্ছে হলে তা অস্বীকার করে বেরিয়েও যাবেন আর মেয়েটি একজন মেয়েমানুষ হওয়ার কারণে লোকলজ্জার ভয়ে তা চেপে যাবেন। সাধারণত অধিকাংশ মেয়ে যেভাবে চেপে যান।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ মানুষের চিন্তাভাবনার গতিপথ যেমন করে পেছনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে, সেখানে আইনকানুন সামনের দিকে চলবে—এটাই-বা কেমন করে হয়? কারণ, আজকাল দেখা যাচ্ছে, আইনকানুন পরিচালনা করা লোকের মধ্যেও কিছু পেছনে হাঁটা লোক আছেন। তবে আদালত প্রাঙ্গণে বারবার ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে বাদীর বিবাহ সম্পাদনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যুগের পর যুগ ধরে গ্রাম ও মফস্বল শহরের পাড়া-মহল্লার সর্দার-মাতব্বরের দরবারে আমরা দেখে এসেছি, ধর্ষককে বাঁচাতে মেয়েটির চরিত্র হনন করা হয়। মেয়েটির পক্ষ থেকে দেওয়া শক্ত প্রমাণ খারিজ করার সুযোগ না থাকলে সাজা হিসেবে ওই ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়া হয়। তা না হলে ভিকটিম মেয়েটির মা-বাবাকে মাতব্বরদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়, যেন তারা ধর্ষকের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করে দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ধর্ষক ছেলেটির পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থা মেয়েটির থেকে একটু ভালো হলে বিয়েতে রাজি হয় না। নানা রকম বাহানা করে। বিয়ের পরিবর্তে টাকা দিয়ে ফয়সালা করে নিতে চায়। আর্থসামাজিক অবস্থা সমান হলেও সামাজিক বিচারে সেই ধর্ষক ছেলে ও তার অভিভাবকেরা তবু দাপটে থাকেন। বিয়ে করতে রাজি হলেও উল্টো মেয়েটির বাপের ঘাড়ে অনেক শর্ত চাপিয়ে দেয়। আর মেয়েটির বাবা-মা ও অভিভাবকেরা তাতেই কৃতার্থ হয়ে সব শর্ত মেনে নিয়ে মেয়েটির ইজ্জত রক্ষা করেন।
আসলে সবকিছুর মূলে এই ইজ্জত। মেয়েদের ইজ্জত হলো কচুপাতার পানি। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনো নরনারীর দ্বারা সংঘটিত একই ঘটনার দায় দুজনের বেলায় দুই রকম। এমনকি মেয়েটিকে যখন বলাৎকার করা হয়, তখনো সমাজ মেয়েটিকেই অপাঙ্‌ক্তেয় মনে করে। সমাজ এখনো ধর্ষিত মেয়েকে যতটা ঘৃণা করে, তার সিকি ভাগ ঘৃণাও কোনো ধর্ষককে করে না। তাই ধর্ষক বুক ফুলিয়ে বেড়ায় আর ধর্ষিত মেয়েটি ঘরের কোনে মুখ লুকায় বা আত্মহত্যা করে। মেয়েদের এই ইজ্জতজ্ঞানকে পুঁজি করে তাই লম্পট পুরুষগুলো তাদের লাম্পট্য চরিতার্থ করে।
তবে গ্রাম্য সালিসে ভিকটিম মেয়েদের অধিকাংশই থাকে দরিদ্র এবং শিক্ষাগত বিষয়েও পেছনে পড়া। কিন্তু একজন প্রকৌশলী হাসানুজ্জামানের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ঠকে গেলেন যে মেয়েটি, তিনি নিশ্চয়ই শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তেমনটা পেছনে পড়া নন। তবু কেন তিনি এই ধর্ষককে বিয়ে করতে রাজি হলেন? এবং কেনই-বা তিনি ওই লোকের প্রলোভনের ফাঁদে পা দিলেন? আসলে গ্রাম ও মফস্বলের নারীদেহ লোভী পুরুষের সঙ্গে নগরের উচ্চবিত্ত ও উচ্চশিক্ষিত পুরুষের লাম্পট্যের ধরন ও পুরুষতান্ত্রিক দাপটের যেমন পার্থক্য নেই, তেমনি গ্রাম ও মফস্বল শহরের দরিদ্র, নিম্নবিত্ত পরিবারের অশিক্ষিত, আধা শিক্ষিত মেয়েটির মানসিকতার সঙ্গে রাজধানী শহরের তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত মেয়েটির তফাত নেই। কারণ, আমাদের গ্রাম্য ও তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ দুটোই পুরুষতন্ত্র দ্বারা প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এখনো একটি মেয়ের জীবনের সার্থকতা বিবাহ বা একটি পুরুষের সঙ্গে যেনতেনভাবে জুড়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত বলে ভাবা হয়। আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে বেঁচে থাকার নামই যে জীবন, সেই শিক্ষা বা বোঝার সুযোগ তো সবাই পায় না। তাই তারা একজন ধর্ষকের সঙ্গে বিয়েটাকে মেনে নেয় বা মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। অথবা হাসানুজ্জামানের বান্ধবীর মতো সমাজ আরোপিত হাস্যকর সতীত্ববোধে আক্রান্ত মেয়েগুলোর বিবাহপূর্ব যৌন সম্পর্ক স্থাপনে সাহস থাকলেও একজন প্রতারক ও লম্পটকে প্রত্যাখ্যানের বেলায় সেই সাহস থাকে না। বরং ওই প্রতারককে বিয়ে করেই সে তার সতীত্ব রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আর পরিবার ও সমাজ যুগ যুগ ধরে ধর্ষককে অপরাধের জন্য শাস্তি না দিয়ে ধর্ষিত মেয়েটিকে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে পুরস্কৃত করেছে। যাকে ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন করার দরকার ছিল, তাকেই জামাই-আদর করে মাথায় তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে কারণে দিনে দিনে দেশে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়েছে আর ধর্ষণের মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে।
কিন্তু দেশের আদালত তো গ্রাম্য সালিসি সভা নয়। সমাজ থেকে অপরাধ নির্মূল করার জন্য আদালত তৈরি হয়েছে। সেখানে অপরাধের শিকার ভুক্তভোগী বিচার চাইবে আর আদালতের আইনে সেই অপরাধ আপসের অযোগ্য প্রমাণিত হলে অপরাধীকে যথাযথ শাস্তি দেওয়া হবে, যাতে করে অপরাধী সাজা ভোগ করছে দেখে অন্যান্য মানুষ অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু এখন আদালত যদি প্রমাণিত অপরাধীকে সাজা না দিয়ে মুক্তির পথ বাতলে দেন, তাহলে আদালত আর গ্রাম্য সালিসে যে কোনো পার্থক্য থাকে না, সেটা বলা কি ভুল হবে?

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা

সূত্র : আজকের পত্রিকা

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman