হৃদয় মণ্ডলের হৃদয়ে ক্ষত -দেবাহুতি চক্রবর্তী

হৃদয় মণ্ডল জামিন পেয়েছেন। তার জামিনের ব্যাপারে জনমত ক্রমেই বাড়ছিল। সামাজিক মাধ্যমগুলোয় অনেক বেশি সরব ছিলেন দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্নরা। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও চাপ সৃষ্টি করে। মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত প্রতিবাদ আর সরকারের ইতিবাচক মনোভাব হৃদয় মণ্ডলকে জামিন পেতে সাহায্য করেছে। হৃদয় মণ্ডল কারাগারের নিরাপদ হেফাজত থেকে অক্ষত দেহে বাইরে এসেছেন। কিন্তু তার হৃদয়ের ক্ষত আজীবনের সঙ্গী হয়ে রইল। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, পুরো ঘটনাটা কাম্য ছিল না; অনভিপ্রেত ও নিন্দনীয়। তবে ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে তেমন বিরোধ আছে বলে তার মনে হয়নি। তিনি বলেছেন, এটা বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন।
সাধারণ মানুষ হিসেবে বলতে পারি, বিজ্ঞানের জন্ম জিজ্ঞাসা থেকে। আধুনিক বিজ্ঞান যখন ছিল না, তখনও মানুষের জিজ্ঞাসা ছিল। সব ধর্মগ্রন্থই তৎকালীন জ্ঞান ও বোধের ভিত্তিতে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মানুষের জ্ঞান-সচেতনতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থের পার্থক্যটাও সময়ের পার্থক্যে স্পষ্ট। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৌতুকাকারে একটা লেখা চোখে পড়ল। বৃষ্টি কেন হয়- স্কুল পরিদর্শকের এমন প্রশ্নের উত্তরে এক শিক্ষার্থীর পাল্টা প্রশ্ন- স্যার, এই বিজ্ঞান ক্লাসেই উত্তর দেব, না পরবর্তী ক্লাসে? স্যার তাৎক্ষণিক উত্তর জানতে চাইলেন। শিক্ষার্থী জানাল, কীভাবে সূর্যের তাপে জল থেকে জলীয় বাষ্প ওপরে ঘনীভূত হয়ে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মধ্যে এলে বৃষ্টি হিসেবে ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থীর নির্ভুল উত্তরে কৌতূহলী পরিদর্শক জানতে চাইলেন, পরবর্তী ক্লাসে এর পরিবর্তিত উত্তর কী হবে? পরের ক্লাসটা ধর্মের। আর তাই শিক্ষার্থী জানাল, এই একই প্রশ্নের উত্তর সেখানে সে দেবে অন্যভাবে। বিষয়টা যে মোটেই কৌতুক নয় এবং ধর্ম যে বিশ্বাস আর বিজ্ঞান যে বাস্তব প্রমাণ থেকে উদ্ভূত- এটা তারই উদাহরণ।
সত্য নির্দি্বধায় উচ্চারণের কারণে হৃদয় মণ্ডলকে কারাগারে যেতে হয়েছিল। কারাগার থেকে বেরোতে ১৯ দিন লাগল। তাকে ৫ হাজার টাকা জামিনে বেরোতে হয়েছে। কেন তার বিরুদ্ধে আনীত স্পষ্ট প্রমাণিত মিথ্যে অভিযোগের মামলা থেকে সরাসরি তাকে অব্যাহতি দেওয়া হলো না? কেন তাকে তারিখে তারিখে হাজিরা দিতে হবে? কেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই মামলার পেছনে তার অর্থ ব্যয় হবে? সর্বোপরি কেন তিনি নিষ্পত্তি অবধি অভিযোগমুক্ত মানুষ হিসেবে স্বস্তিতে থাকবেন না? আসলে বিষয়টা এক হৃদয় মণ্ডলের নয়। বাংলাদেশের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার ধুয়া তুলে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মন খুলে কাছের বন্ধুর সঙ্গেও আর এক বন্ধু মতবিনিময় করতে যেন ভয় পাচ্ছে। কত ঝুমন দাশ, রসরাজ এখন নিরাপদ হেফাজতে?
শিক্ষা পাঠ্যক্রমের অবস্থা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, যা ক্রমে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টিতে সহায়ক হচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও সমাজে ক্রমে সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছেন। তবুও যে কোনো সমাজে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তারাই প্রথম সরব ভূমিকা নিচ্ছেন। ঝুঁকি তাদেরও কম নয়। হৃদয় মণ্ডলের স্বাভাবিক কর্মজীবনে ফিরে যাওয়া কঠিন। কতিপয় কিশোর শিক্ষার্থী এত সহিংস ও বিদ্বেষপরায়ণ কীভাবে হলো? ভিডিওতে তাদের চেহারা স্পষ্ট। তদন্তে আরও স্পষ্টতর হবে। কিন্তু বয়স কম বলে এত বড় অপরাধের জন্য তারা বিনা জবাবদিহিতে পার পেতে পারে না। কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্রে তাদের পাঠানো হোক। তাদের ভেতর মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য একটা নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং। মামলার বাদীসহ এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে রাষ্ট্রের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রগতিশীল ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনাও পরিস্কার। উগ্র মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন, যুক্তিবাদহীন বেড়ে ওঠা সমাজকে তারা সমর্থন করেন না। এর পরও দিন দিন অবিমৃষ্যকারিতা বেড়েই চলছে কোন আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে? সমস্যার গভীরে গিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা জরুরি।

দেবাহুতি চক্রবর্তী: সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : সমকাল

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman