চলে গেলেন নূরজাহান আপা। না-ফেরার দেশে। আমি শোকার্ত। বিমর্ষ। শুধু আমার নয়, এই শোক আমাদের জাতীয়। মাথার ওপর ভরসার হাত
ছিল সব সময়। বটবৃক্ষ চলে গেলেন। অভিভাবক হারালাম আমরা। অভিভাবক-ই ছিলেন নূরজাহান বেগম। ‘বেগম পত্রিকা’র সম্পাদক। তিনি এমন মানুষ, যিনি নিভৃতে নিজের কাজটুকু করে গেছেন_ কাজকে ভালোবেসে, দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবেসে।
সাংবাদিকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশার নাম; ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। সাংবাদিকতা সবার পেশা। কিন্তু দেখা যায়, সাংবাদিকতায় পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ নিতান্তই কম। দেড় যুগ আগেও বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় নারীদের হার ছিল ৭ শতাংশ। তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ রিপোর্টার। কিন্তু বর্তমানে দেশে নারী সাংবাদিকরা এখন সে অবস্থানে নেই। এগিয়েছে অনেকদূর। হেঁটেছে অনেকটা পথ। বিপুলসংখ্যক মেয়ে সাংবাদিকতায় আসছে। নারীরা এখন ডাক্তারি আর মাস্টারি পেশার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। অন্যান্য পেশার মতোই সাংবাদিকতা পেশায় পুরুষের পাশাপাশি মেয়েরাও পারদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে। সেই পথচলার অগ্রদূত নূরজাহান আপা।
বর্তমানে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কল্পনার চেয়েও বেশি। মানুষ শুধু সংবাদপত্র আর টিভি চ্যানেলে আটকে নেই, সঙ্গে যোগ হয়েছে এফএম রেডিও এবং অনলাইন মিডিয়া। যে কোনো ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সামনে চলে আসছে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এবং শত শত অনলাইনের মাধ্যমে। বেগম রোকেয়া কি কল্পনা করতে পেরেছিলেন, অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সংবাদজগতেও নারীরা এমন সফলতার প্রদীপ হাতে নিয়েই এগোবেন। এই এগিয়ে চলার যাত্রা শুরুর হাতিয়ারটা ছিল ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের হাতে। আর তারই মেয়ে হয়ে নারী সাংবাদিকতায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন নূরজাহান বেগম।
নারী সাংবাদিকতা এবং সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম এক অনন্য নাম। দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় তিনি ‘বেগম’ পত্রিকা সম্পাদনা করে আসছেন। নূরজাহান আপা ছিলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, একজন সাহসী সাংবাদিক, একজন নিষ্ঠাবান সম্পাদক; সর্বোপরি একজন স্নেহময়ী মায়ের রূপও তার মধ্যে পেয়েছি আমরা। আপন মমতায় তিনি তার দুই মেয়েকে যেমন মানুষ করেছেন মানুষের মতো, তেমনি আগলে রেখেছেন বেগম পত্রিকাটি। কাজ তার কাছে ছিল সন্তানের মতোই। নিবিড় মমতায় সেই কাজটুকু করে গেছেন। নিভৃতে। ৩৮ শরৎগুপ্ত রোডের নূরী (নূরজাহান আপার ডাকনাম) আপার এত গাছগাছালিসহ বাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে যেমন ছিল, তেমনি তিনি ছিলেন আমাদের। যে কোনো অনুষ্ঠানে, কোনো বিশেষ দিন উদযাপনে আপাকে পাশে পেয়েছি সব সময়। এই যে গত এপ্রিলে এত অসুস্থ ছিলেন, একটু বেশি কথা বলতে গেলেই হাঁপিয়ে উঠতেন, তা-ও নারী অধিকারের জায়গাটুকু তিনি জোরালোভাবেই উচ্চারণ করেছেন। নারী দিবসের অনেক আয়োজনে কলমের সঙ্গে আমরা পেতাম তার সোচ্চার কণ্ঠ। সময়ের পরিবর্তনে কত বিবর্তিত হয়েছে চারদিক। নূরী আপা তো বদলাননি। কাজ-ই ছিল তার জীবন। সাংবাদিকতার শুরু থেকে যখন বাবার হাতটি ধরে এই কাজ শিখেছেন, তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন পরবর্তী কাজের ক্ষেত্রে। এমনকি মারা যাওয়ার আগেও বেগম অফিসে কিংবা বাসায় বসে তিনি পালন করে গেছেন তার দায়িত্বটুকু। নূরজাহান আপার শৈশবের শিক্ষার পথচলা শুরু হয়েছিল বেগম রোকেয়ার হাত ধরে। তার মা ছোট্ট নূরীকে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। শিক্ষার হাতেখড়ি হয় যার এমন মহীয়সী নারীর হাত ধরে, তিনি তো এগিয়েই থাকবেন। যে সময়টায় নারীরা রান্নাঘরের কাজ, সন্তান প্রতিপালন, খুব বেশি হলে কিছুটা সেলাই কাজকে-ই তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি মনে করতেন_ সে সময়টাতেই নূরজাহান বেগম প্রমাণ করেছেন, সংসার-সন্তান সামাল দিয়েও কর্মক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দেওয়া যায়। এতে অবশ্য তার পারিবারিক সহযোগিতার হাতটাও ছিল প্রসারিত। এর আগে যখন আপা হাসপাতালে ভর্তি হলেন শ্বাসকষ্টের কারণে, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছেন বাসায়। এবারও ভেবেছিলাম তেমন হবে। আপা আবার সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন। শতায়ু হয়ে অভিভাবকের মতোই আরও কিছুটা বছর থাকবেন আমাদের সঙ্গে। কাল সকালে যখন মৃত্যুসংবাদটা শুনলাম, বড় বিমর্ষ হয়ে গেলাম। উনার কাছ থেকেই তো আমাদের যতটুকু ধারণ করার। এই অগ্রপথিক নিজের পথচলা শেষ করে আমাদের একটা শূন্য জায়গায় রেখে গেলেন।
লেখক :সভাপতি,বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
অনুলিখন :জোহরা শিউলী
তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল