রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০-১৯৩২) জীবনকাল ছিল স্বল্প সময়ের, মাত্র ৫২ বছর। বহুমুখী কর্মকাণ্ডে বিস্তৃত ছিল তাঁর জীবন। তাঁর জীবন ও কর্মকাণ্ড বিভিন্নভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে এবং তাঁকে ভূষিত করা হয়েছে নানা বিশেষণে। ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ বাংলায় যে নবজাগরণ ও নবজিজ্ঞাসার জন্ম দেয়, যেখানে কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা, পশ্চাৎপদতা, রক্ষণশীলতা আরোপিত নারীর অমানবিক অধস্তন অবস্থানের বিরুদ্ধে চিন্তা-চেতনায় যে প্রগতির ধারা সূচিত হয়, রোকেয়ার দর্শন ও চিন্তাধারা ছিল তারই পরম্পরা।
তাঁর চিন্তা ও জীবন দর্শন থেকেই উৎসারিত হয়েছিল তাঁর কর্ম। রোকেয়ার আগে ও সমসাময়িককালে নারীকে পশ্চাৎপদতা থেকে মুক্ত করা নারীর শিক্ষার সুযোগ তৈরি করার কথা অনেকে বলেছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে নারীর পূর্ণ অধিকার, সংসারের বাইরে সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে নারীর যে অবস্থান ও ভূমিকা রয়েছে এমন মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরেছেন রোকেয়া। নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গি যে নারীর অধিকারহীনতার মূল কারণ, শত বছর আগে রোকেয়া তা চিহ্নিত করেছেন। নারী শুধু অর্থনৈতিক কারণে পুরুষের অধস্তন হয়নি, এর পেছনে রয়েছে সমাজের তৈরি দীর্ঘদিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, যা তৈরি করছে সমাজের ক্ষমতার কাঠামো, যাকে বলা হয় পুরুষতান্ত্রিকতা। নারীর প্রতি সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি রক্ষা করে চলেছে সমাজের বিধি, প্রথা, আচার ও মূল্যবোধ। তার ভিত্তিতে সমাজ নির্মাণ করছে নারী ও পুরুষ। আজকের জেন্ডারবিষয়ক একাডেমিক বিশ্লেষণ জেন্ডার ও সেক্সের মধ্যে যে পার্থক্য নির্ণয় করে, সেখানে বলা হয় জেন্ডার হচ্ছে সমাজ কর্তৃক নির্মিত নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক, যা নারী ও পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্ধারণ করে। সমাজের এই নারী করে তোলার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে ছিল রোকেয়ার সব ভাবনা ও কর্ম। জেন্ডার প্রত্যয়ের এই তাত্ত্বিক ধারণা গড়ে ওঠার বহু আগে রোকেয়ার লেখনীতে জেন্ডার ধারণার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। সমাজের প্রথাগত গতানুগতিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন রোকেয়া। তিনি বলেছেন, ‘ভগিনীগণ, বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে জড়াউ অলংকার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই; সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ। ’ সমাজের অর্ধেক জনশক্তির ভূমিকা অস্বীকার করে উন্নয়ন ধারণা যে যথাযথ হতে পারে না তা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে; বলা হয়েছে কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। রোকেয়া বহু আগে এ কথা বলেছেন, ‘আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে। সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে আমাদের জাগিতে হইবে। ’
এসব বক্তব্যে জেন্ডার সমতা বিষয়ে তাঁর চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা কতটা অগ্রসর ও যুক্তিপূর্ণ ছিল তার প্রতিফলন দেখি যখন লেখেন, ‘আমরা ঈশ্বর ও মাতার নিকট ভ্রাতাদের অর্ধেক নহি, তাহা হইলে এরূপ স্বাভাবিক বন্দোবস্ত হইতো—পুত্র যেখানে দশ মাস স্থান পাইবে, দুহিতা সেখানে পাঁচ মাস। পুত্রের জন্য যতখানি দুধ আমদানি হয়, কন্যার জন্য তাহার অর্ধেক, সেরূপ তো নিয়ম নাই। ’ এমন বক্তব্যের সূত্রে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, তবে কেন সম্পত্তির উত্তরাধিকারে নারী-পুরুষের সমতা নেই। আমরা জানি রাষ্ট্রীয় ও গণজীবনে নারীর অধিকার স্বীকৃত থাকলেও ব্যক্তিজীবনের বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির ক্ষেত্রে নারীর অধিকারে এখনো বৈষম্য রয়েছে।
মানুষ হিসেবে নারীর ব্যক্তি অধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা অর্জন হচ্ছে ক্ষমতায়ন। বর্তমান বিশ্বে সব রাষ্ট্রেই সাংবিধানিকভাবে জেন্ডার সমতা স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে সম্পদে, শিক্ষায়, কর্মে, আইনে কোনো ক্ষেত্রেই সমতা নেই। সিডও সনদে বলা হচ্ছে যে সমতার জন্য প্রয়োজন সম-সুযোগ এবং এই সুযোগই সমতা আনবে না, সম-ফলাফল দৃশ্যমান হলে অর্জিত হবে প্রকৃত সমতা। ঘোষিত সমতা ও দৃশ্যমান সমতার মধ্যে যে ব্যবধান তা আজ চিহ্নিত করা হচ্ছে। রোকেয়া অনুরূপ বলেছেন, ‘আমাদের বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি; সম্ভবত সুযোগের অভাবই ইহার প্রধান কারণ। ’ তিনি মনে করতেন, সম-সুযোগ ব্যবহারের জন্য প্রয়োজন আত্মশক্তির বিকাশ ও সক্ষমতা অর্জন এবং এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। তাই তিনি বলেন, ‘কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, তারা নিজের অন্ন বস্ত্র উপার্জন করিবে। ’
রোকেয়া তাঁর সব কাজের মধ্য দিয়ে নারীর আত্মশক্তির বিকাশের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নারী নিজে যদি তার মুক্তির যৌক্তিকতা উপলব্ধি না করে, তবে নারীমুক্তি অর্জিত হবে না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারী শুধু সমাজের দাসত্ব করছে না, এই দাসত্ব তার মনের দাসত্বও তৈরি করছে। নারীর এই দাসত্ব দূর করতে হলে আঘাত হানতে হবে সমাজ বাস্তবতায় ও মানসে।
তাই দেখি রোকেয়ার পদ্মরাগের নায়িকার সাহসী উচ্চারণ, ‘আমি আজীবন নারী জাতির কল্যাণ সাধন করিব এবং অবরোধ প্রথার মূল উচ্ছেদ করিব। আমি সমাজকে দেখাতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের লক্ষ্য নহে, সংসার ধর্মই জীবনের সার ধর্ম নয়। ’ ১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। তাঁর নারীস্থান কল্পনায় হলেও তা সমাজের প্রচলিত নিয়ম ও বিধি ভাঙার উদ্দীপনামূলক কাহিনি।
রোকেয়া মনে করতেন নারীর ব্যক্তিসত্তার বিকাশ ও সার্বিক মুক্তির জন্য প্রয়োজন অবরোধ প্রথার বিলোপ, নারীর আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদা সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতা। তাঁর কর্মযজ্ঞ ছিল প্রধানত এই তিনটি ক্ষেত্রে। তিনি একদিকে যেমন নারীর অধিকারহীনতা ও অধস্তনতার কারণগুলো চিহ্নিত করে লেখনীর মাধ্যমে সমাজের সামনে তুলে ধরেছেন, একই সঙ্গে বাস্তব অবস্থা পরিবর্তনেও একজন Activist হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনি ইসলাম’ নামে নারী সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ভারতে নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনে তাঁর এই সংগঠন যুক্ত ছিল। তাঁর সাহসী কর্মোদ্যোগের আরেকটি উদাহরণ যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের কাজ। ডা. লুৎফর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘নারী তীর্থ’ সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যুক্ততা। যে সংগঠন যৌনকর্মীদের আশ্রয় দিয়ে নানা ধরনের কাজ শিখিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনে সুযোগ সৃষ্টি করে। ‘নারী তীর্থ’ আশ্রমের কার্যনির্বাহী কমিটির সভানেত্রী ছিলেন রোকেয়া। তিনি বলেছিলেন, ‘এ সমাজের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ ঘোষণা করিতে হইবে। ’
ভারতবর্ষের নবজাগরণের পর্যালোচনায় মুক্তবুদ্ধির চর্চার ইতিহাসে রোকেয়ার মতো একজন অগ্রসরমুখী আধুনিক সমাজচিন্তকের নাম বিশেষ উল্লেখ হয় না। এখানেও রয়েছে সেই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। রোকেয়া যে সময়ে নারীর অধিকারের মৌলিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করেছেন, সে সময়ের জন্য তা ছিল বৈপ্লবিক চিন্তা। যেহেতু তিনি সমাজের পশ্চাৎপদ অংশ নারীর কথা বলেছেন এবং তিনি নিজেও একজন নারী, সেই কারণে পরাধীন ভারতবর্ষের পশ্চাৎপদতার বিরুদ্ধে মূলধারার আন্দোলনে রোকেয়ার নাম খুব কমই উচ্চারিত হয়। নানা প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও সারা জীবন স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তিবুদ্ধির চর্চা করে গেছেন রোকেয়া। অষ্টাদশ শতকে মেরি ওলস্টোনক্রাফট (১৭৫৯-১৭৯৭) ৩৩ বছর বয়সে
Vindication of the Rights of Women রচনা করে যেমন গোটা পৃথিবীর সামনে নারী সম্পর্কে বিদ্যমান ধারণা পাল্টে দিয়েছিলেন, একইভাবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রোকেয়ার রচনা ও ভাবনা বাংলার পশ্চাৎপদ, অবরুদ্ধ নারীদের মানুষ হিসেবে নিজের অবস্থান বুঝে নেওয়ার বাণী শুনিয়েছিল। আজকের নারী আন্দোলনের দর্শন বা নারীবাদী তত্ত্বের সার কথা রোকেয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণার অনুরূপ। তাই তাঁর জীবন দর্শন আজকের দিনে নারীমুক্তির প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক ও অসাধারণ তাৎপর্যবহ।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ