হেনা দাস তার ‘চার পুরুষের কাহিনী’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘আমার জন্মের আগের দুই পুরুষ যে পারিবারিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে এবং তৎকালীন পরিবেশের যে বিবর্তন ঘটেছে, তা আমার চরিত্র ও জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে।’ মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। আজীবন তিনি এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে এর আদর্শ-সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অসাধারণ ভূমিকা রেখে অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ নামে যে গণভিত্তিক সংগ্রামী নারী সংগঠনের জন্ম হয়, তার সিলেট শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। এই বাম আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব হেনা দাস সিলেটের মেয়ে। ১৯২৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। তার সাহস, মেধা-প্রজ্ঞা, ত্যাগ তাকে অসামান্য মহিমা দান করেছে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবেও তার লড়াই ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষক আন্দোলন ও সংগঠন করতে গিয়ে তাদের ন্যায্যতা ও অধিকার রক্ষায় অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন। শিক্ষকতা পেশার শুরু থেকেই শিক্ষক সমিতির কাজের সঙ্গে ব্যাপৃত ছিলেন। ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন এ দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ও নারী আন্দোলনের সঙ্গে। ১৯৭০-এর ৪ ফেব্রুয়ারি এর জন্মলগ্ন থেকে হেনা দাস এ সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। নানা উত্থান-পতন ও বিচিত্র ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে এ সংগঠন। মুক্তিযুদ্ধের নারীরা এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন। সংগঠনের শুরু থেকে এর সার্বিক বিকাশে হেনা দাস কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় ছিলেন। সভানেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। হেনা দাস ঐতিহাসিক নানকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে একে নেতৃত্ব দিয়েছেন অসম্ভব সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে। ১৪ বছর শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ড. কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঠিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিরও সদস্য ছিলেন। হেনাদিকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি মহিলা পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে। কবি সুফিয়া কামালের মৃত্যুর পর তিনি সভাপতির দায়িত্ব পেলেন। সংগঠনের সে দায়িত্ব মেধা-মনন ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পালন করে গেছেন দক্ষ হাতে। পাকিস্তান আমল থেকে এ দেশের সব সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। তার অনন্য ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি রোকেয়া পদক, পাক্ষিক অনন্যার ‘অনন্যা শীর্ষ দশ’, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, ঢাকেশ্বরী মন্দির পদকসহ বহু পদকে ভূষিত হন তিনি। তার লেখা গ্রন্থ ‘চার পুরুষের কাহিনী’ প্রকাশের পর সব মহলে তিনি নতুনভাবে সমাদৃত ও আলোচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন পত্রিকা ও সংগঠনের মাধ্যমে। হেনাদি আজ আর নেই; কিন্তু তার রাজনৈতিক, মানবিক চেতনা, দেশপ্রেম, মানবসেবার আদর্শ, চারিত্রিক দৃঢ়তা আমাদের অনুপ্রাণিত, প্রভাবিত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। আমরা তাকে ভুলতে পারব না।
লেখক : প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল