২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এ উপলক্ষে এ বছরের স্লোগান ‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করো, সম-অধিকার নিশ্চিত করো’। প্রতিদিনের পত্রিকার পাতা খুললেই পাতায় পাতায় নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার খবর আমরা দেখতে পাই। টেলিভিশনসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং হালের সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকও সহিংসতার খবরে সয়লাব। ঘটনার পর ঘটনা ঘটেই চলেছে। শুধু যাঁদের ওপর ঘটে তাঁরাসহ কিছু মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়; কিন্তু বিচারের দাবি নীরবেই কাঁদে। অধিকাংশ মানুষসহ রাষ্ট্র, বিচারব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা দেখে মনে হয়, সবকিছু গা সওয়া হয়ে গেছে।
হ্যাঁ, কোথাও কোথাও পুরুষ নির্যাতন হয় এবং সব নির্যাতনই মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কিন্তু অনেকে নারী নির্যাতনের বিপরীতে পুরুষ নির্যাতনের কথা তুলে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেন। নারী নির্যাতিত হন নারী হওয়ার কারণে আর পুরুষ নির্যাতিত হন সেটা পুরুষ হওয়ার কারণে নয়, নানা কারণে। পুরুষ নির্যাতনের পেছনেও আছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পুরুষতন্ত্র পুরুষকে শেখায় তুমি কেঁদো না, নারীরা কাঁদে; তুমি পুরুষ, মার দেবে। নারীর কাছে ‘নায়ক’ সাজার জন্য তিনি তাঁর অক্ষমতা লুকিয়ে রাখেন। তাই পুরুষ তাঁর যন্ত্রণা চেপে রাখেন। তাঁর যন্ত্রণা বা নির্যাতনের কারণ হচ্ছে এই।
আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারী পুরুষের অধস্তন। এ ব্যবস্থায় নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ সম্পদ-সম্পত্তিতে অধিকার না থাকা। কথা বলার, অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই বলে নারী দুর্বল থাকেন মানসিকভাবে। সেই দুর্বলতার প্রভাব তাঁর শরীরেও পড়ে, যার সুযোগ নেন দুর্বৃত্ত পুরুষ।
সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকারের কথা বললেই সব ধর্মের পুরুষেরাই হইহই-রইরই করে ওঠেন। তাঁদের মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীর লোকজন প্রথমেই কোরআন-সুন্নাহর দোহাই দেন। তারপর বলেন, ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি পেলেও শেষ পর্যন্ত নাকি নারী-পুরুষ সমান সম্পত্তিই পান। কারণ, নারী স্বামীর সম্পত্তিতে ভাগ পান, ছেলের সম্পত্তিতে ভাগ পান। তাই সব মিলিয়ে সমানই পান। কিছু না বুঝে পুরুষতন্ত্রের ডিটারজেন্টে মগজ ওয়াশ করা কিছু নারীও তাঁদের সঙ্গে তাল দেন। ফেসবুকে দেখলাম একজন শিক্ষিত (তথাকথিত) নারী এ বিষয়ে আরেকজনের স্ট্যাটাসে মন্তব্য লিখেছেন, ভাইয়ের সমান সম্পত্তি নিলে কোরআন বা আল্লাহর আদেশ অবমাননা হবে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে নারীদের সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ দিতে গেলেই যাঁরা ব্যক্তিজীবনে ধর্মের ধার দিয়েও যান না, তাঁরাও ধার্মিক হয়ে ওঠেন। বলি, কোরআন যে মিথ্যা বলা, চুরি করা, হিংসা করা, খুনখারাবি, লাম্পট্য-বদমাইশি, পরনিন্দা, পরচর্চার মতো জঘন্য সব ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত থাকতে নিষেধ দিয়েছে, যখন প্রতিমুহূর্তে সেসব নিষেধ তাঁরা লঙ্ঘন করেন, তখন কি আল্লাহর আদেশ অমান্য করা হয় না? কিন্তু ছেলেমেয়ে সম্পত্তির সমান ভাগ দেওয়া কোনো অপরাধমূলক কাজ নয়। এটা করলে আল্লাহ্ তাঁর বান্দার প্রতি বিরক্ত না হয়ে সদয় হবেন। কারণ, তিনি তো দয়ালু এবং কোনো পিতা-মাতার কন্যাসন্তান জন্ম হওয়াকেও সৌভাগ্যের বিষয় বলে নির্দেশ করেছেন। এতই যদি কোরআন অবমাননার ভয়, তবে কোরআন অনুযায়ী অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ না দেওয়াটাও কি অপরাধ নয়? কিন্তু বাস্তবে যখন মুসলিম নারী তাঁর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ পান না, তখন কেউ কোরআন অবমাননার কথা তোলে না। অথচ যদি অর্ধেক ভাগও তাঁরা পেয়ে যেতেন, তাহলে অধিকাংশ সচ্ছল পিতার মুসলিম কন্যাদের জীবনে অন্তত দুর্গতি হতো না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব মুসলিম কন্যা পিতার সম্পত্তির ভাগ পান, তা তাঁদের পিতার বিচক্ষণতার কারণে; যিনি আগেভাগে কন্যার ভাগের বিলি ব্যবস্থা করে যান আর যাঁদের কপাল ভালো তাঁদের ভাইদের মানবিক বোধের কারণে পান। কেউ কেউ কদাচিৎ বিচার-সালিস করে পান। প্রকৃতপক্ষে শরিয়াহ আইন অনুযায়ী, যেটুকু সম্পত্তি একজন মুসলিম নারীর পাওয়ার কথা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা তা পান না।
আমার পরিচিত এক নারীর গল্প বলি। নাসিমা খাতুন সচ্ছল কৃষক পিতার একমাত্র কন্যাসন্তান ছিল। নাসিমার বাবা ভালো ঘর-বর দেখেই তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। তিন সন্তান জন্মের পর নাসিমার বর তাঁকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতে শুরু করেন। নাসিমাকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে তিনি আরেকটা বিয়ে করেন। নাসিমা কোর্টে নারী নির্যাতন ও অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাঁর পক্ষের উকিল আসামিপক্ষের উকিলের সঙ্গে আঁতাত করে মামলা ফেলে রাখেন। নাসিমা সুবিচার পান না। বাপের বাড়িতে তাঁকে দাসী-বাদীর মতো খেটে খেতে হয়। পিতার সম্পত্তিতে ভাইদের অর্ধেক ভাগও পান না নাসিমা। স্বামীর সম্পত্তির ভাগ পাওয়া দূরের কথা, ভাতই জোটেনি। এমতাবস্থায় একটা নারী সংগঠনের সহযোগিতায় নাসিমার আগের মামলাগুলো একটু সচল হয় এবং একটা ভরণপোষণের মামলাও করে দেয় তারা। ছেলে দুটি যখন স্কুলে পড়ছে আর মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে, সেই সময় ওই বাবা আসেন ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে। বাবা মেয়ের ব্রেইনওয়াশ করলে মেয়ে মাকে চাপ দেয় মামলা তুলে নিতে। নাসিমার ভাইয়েরাও বোনের নির্যাতনকারী বরের পক্ষ নেন। নাসিমার কথা কারও কাছে বিকোয়নি। শেষে ধন-সম্পদ তো পেলই না, সন্তানদের হারিয়ে নাসিমা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। পৈতৃক সম্পত্তির সুষ্ঠু ভাগ পেলে নাসিমার জীবনে এত লাঞ্ছনা হতো না। এ দেশে কোটি কোটি নাসিমা রয়েছেন, যাদের লাঞ্ছনার কথা শুধু তাঁরাই জানেন।
বাংলাদেশে হিন্দু নারী তাঁর পিতার কোটি টাকার সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও কোনো ভাগ পান না। অথচ যখনই পিতার সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর জন্য সমান ভাগের দাবি ওঠে, হিন্দু নেতারাও শাস্ত্রের দোহাই দেন। পাশাপাশি আরেকটা কুযুক্তি পেশ করে বলেন, হিন্দু নারী সম্পত্তির অধিকারী হলে তাঁদের বিয়ে করে, ধর্মান্তরিত করে অন্য ধর্মের লোক সম্পত্তি নিয়ে যাবে। বিষয়টা যেন এখন কোনো হিন্দু মেয়ে সম্পত্তির ভাগ পান না বলে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন না। রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড যেমন প্রেমের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, প্রেমের জন্য যুগে যুগে অনেক ছেলেমেয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।
আমাদের সংবিধান যে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিককে সমান অধিকার দিয়ে বলেছে, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কারণে যাতে কেউ বৈষম্যের শিকার না হয়, তা সংবিধান প্রণয়নের ৫০ বছর পরেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে।
ধর্মের দোহাই, যুক্তি-তর্ক আমরা বুঝি না। আমরা বুঝি সব মানুষের সমান অধিকার থাকলেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হয়। সময় এসেছে সব ধরনের বৈষম্যমূলক আইন বিলোপ করার। বাংলাদেশ সরকার দেশের সংবিধান মানতে যেমন বাধ্য, তেমনি জাতিসংঘের সিডও দলিল বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ দলিলে স্বাক্ষর করেও অঙ্গীকারবদ্ধ দেশে বিদ্যমান নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য দূর করতে বাধ্য।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : আজকের পত্রিকা