আজ ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু, এর সমাপনী হবে ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার দিবসে। ১৯৬০ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক চার্চের তিন কন্যার বিদ্রোহের ঘটনা স্মরণে এই পক্ষ পালনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৯১ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। তখন থেকে বৈশ্বিকভাবে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ দিনটি পালন করছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে।
আজ ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু, এর সমাপনী হবে ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার দিবসে। ১৯৬০ সালে ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক চার্চের তিন কন্যার বিদ্রোহের ঘটনা স্মরণে এই পক্ষ পালনের সূত্রপাত ঘটে। ১৯৯১ সাল থেকে জাতিসংঘ দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। তখন থেকে বৈশ্বিকভাবে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন দেশ দিনটি পালন করছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে।
সর্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা সম্ভবত সবচেয়ে পুরনো, যা দশকের পর দশক ধরে অব্যাহতভাবে চলছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী এবং এখানে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মাত্রা ও ধরন। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি তিনজন নারীর একজন সহিংসতার শিকার হন। শতাব্দীব্যাপী এর কোনো পরিবর্তন নেই, বরং ঊর্ধ্বগতিই লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশের পরিসংখ্যানেও দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ নারী জীবনে একবার হলেও শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী এই সহিংসতা শুধু নারী ও কন্যার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে না, সামগ্রিকভাবে দেশ-সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
কভিড সংক্রমণকালে আমরা দেখেছি গোটা মানবসমাজ যখন মহামারিতে পর্যুদস্ত, তখন সমাজের অংশ হিসেবে নারী সংকটগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি নারী হওয়ার কারণেও বিভিন্নভাবে জেন্ডারভিত্তিক ভায়োলেন্সের শিকার হচ্ছেন। এই চিত্র পৃথিবীজুড়ে, সেই কারণে কভিড মহামারির পাশাপাশি নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতাকে জাতিসংঘ ‘ছায়া মহামারি’ (Shadow Pandemic) হিসেবে অভিহিত করেছে। আমরা জানি সংকটের সব ক্ষেত্রে, তা সে জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক সংঘাত বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা যা-ই হোক না কেন, নারী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার একটি বড় অবলম্বন হয়েছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। সাইবার বুলিংয়ের মাধ্যমে নারী ও কন্যা ভিন্নতর সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ সে যেমন প্রকাশ্যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, আবার অনলাইন প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্যাতনের মুখোমুখি হচ্ছে। সম্প্রতি নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা বিষয়ে মহিলা পরিষদের একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, ২০২১ সালে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার সবচেয়ে বর্বর পাঁচটি ক্ষেত্র হচ্ছে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, উত্ত্যক্তকরণ, ধর্ষণের চেষ্টা ও যৌতুক (সূত্র : ১৩টি পত্রিকায় প্রকাশিত নারী ও কন্যা নির্যাতনবিষয়ক বিশেষ রিপোর্ট)।
সমীক্ষায় সহিংসতার পাঁচটি ক্ষেত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারী ও কন্যার ওপর সহিংসতা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা—এই তিনটি ক্ষেত্রে। সহিংসতার সবচেয়ে বর্বর রূপ হচ্ছে এই ধর্ষণ। সমীক্ষার তথ্যে আরো উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এই নির্যাতনের শিকার ও নির্যাতনকারী উভয়ই হচ্ছে বয়সে তরুণ, ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের। কন্যারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিজ গৃহে, জনপরিসরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং ধর্ষণকারী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার পরিচিতজন। কিশোর-তরুণ বয়সে যখন তাদের জীবনবোধ গড়ে উঠবে এবং তারা দেশ ও সমাজের স্তম্ভ হবে তখন তারা এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হলে সেই সমাজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত না হয়ে পারা যায় না।
একদিকে ১৪ থেকে ১৮ বছরের কন্যারা অধিক হারে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে বাল্যবিবাহের হারের উদ্বেগজনক বৃদ্ধি ঘটেছে, কন্যারা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে। এই প্রবণতা আমাদের কন্যাদের জীবনের ওপর কি সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে তা সহজেই অনুমেয়। অপরিণত বয়সে বিয়ে ও সন্তানধারণ তাদের জীবনব্যাপী বঞ্চনা ও যন্ত্রণার বিষচক্রে বদ্ধ করে।
সহিংসতার এই অন্ধকার চিত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল দিকও রয়েছে, যেখানে নারী আত্মশক্তিতে দক্ষতার সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রে ভূমিকা রেখে চলছে। নারীর পক্ষে প্রণীত হয়েছে বেশ কিছু নীতি ও আইন। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন প্রতিনিয়ত নানা অ্যাডভোকেসি, লবি, মাঠ পর্যায়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। বৈশ্বিকভাবেও নারীর প্রতি সহিংসতাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও মোর্চাগুলো নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখছে। নানা সনদ, ঘোষণা গৃহীত হচ্ছে, যার অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রও অঙ্গীকারবদ্ধ।
এত সব উদ্যোগের পরেও কেন নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের তরুণসমাজ এই জঘন্য অপরাধে অধিক হারে জড়িত হচ্ছে, তা তলিয়ে দেখা দরকার। সমাজে নারীর অবস্থানের মধ্যে নিহিত রয়েছে এর মূল কারণ। নারী নির্যাতন বিলোপ সম্পর্কে জাতিসংঘের ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘নারী ও পুরুষের মধ্যে অসম ক্ষমতার সম্পর্ক নারীর প্রতি সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। ’
এই অসম সম্পর্ক নারীর প্রতি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে অধস্তনভাবে দেখে, পূর্ণ মানব হিসেবে বিবেচনা করে না। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে নারী ও কন্যা নির্যাতনের বীজ। সেই কারণে আমরা দেখি রাষ্ট্রের নীতি ও পরিকল্পনা নারীকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করছে, নারী তাঁর দক্ষতা দিয়ে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু যখনই অংশীদারির প্রশ্ন আসছে, তখনই নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটছে। সেটা সংসদে হোক, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে হোক কিংবা নির্বাহী বিভাগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে। অর্থাৎ নারীর পদায়ন হচ্ছে, কিন্তু ক্ষমতায়ন ঘটছে না।
নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, যার চর্চা হয় পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নারীর ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতা। সম্পদ, সম্পত্তি, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব—সব ক্ষেত্রেই নারী বৈষম্যের শিকার। সেই সঙ্গে থাকছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অনুপস্থিতি।
নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ সমাজ মানস পরিবর্তন একটি পরিকল্পিত সমন্বিত প্রয়াস। এখানে রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষার পাঠ্যক্রম, রাষ্ট্রের জেন্ডার সংবেদনশীল নীতি, জেন্ডার সংবেদনশীল আইন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন।
অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আইন থাকার পরও দেখা যায় নারী যথাযথ বিচার পাচ্ছেন না। এর পেছনে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, যেখানে প্রবলভাবে বিরাজ করে পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য, রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থের জোর, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা এবং আদালত ও বিচারপ্রক্রিয়া নারীবান্ধব না হওয়া। এই বিচারহীনতার কারণে একদিকে যেমন নারী ন্যায়বিচার পান না, পাশাপাশি নারীকে আদালতের দ্বারস্থ হতে উৎসাহ জোগায় না বা বিচারের প্রতি অনাস্থা তৈরি করে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আজকে নীতিনির্ধারক, সমাজ ও জনগণকে সমতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া দরকার। প্রথমেই বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে যে ‘নারী নির্যাতন নারী ইস্যু নয়, মানবাধিকার ইস্যু। নারী-পুরুষের সমতার ইস্যু’, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতনের পক্ষে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়ার ১০টি করণীয়ের কথা বলেছে—১. সম্মিলিত আওয়াজ তোলো, ২. বিষয়টি জানো ও অঙ্গীকারবদ্ধ হও, ৩. সহিংসতার কথা বলো, ৪. প্রচলিত ধারণা ও কলুষিত পৌরুষবাদকে চ্যালেঞ্জ করো, ৫. নারী আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগঠিত করো, ৬. সহিংসতার শিকার নারীর জন্য সেবামূলক সহযোগিতা বৃদ্ধি করো, ৭. সহিংসতার তথ্যব্যাংক তৈরি করো, ৮. নারীর প্রতি সংবেদনশীল শক্ত আইন তৈরি করো, ৯. নারী নেতৃত্বকে সমর্থন করো এবং ১০. সব ধরনের নির্যাতন এবং রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানাও।
নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতিসংঘ ঘোষিত এই ১০টি উদ্যোগ আজ সব রাষ্ট্রের গ্রহণ করা বিশেষ জরুরি।
জাতিসংঘের এবারের স্লোগান হচ্ছে : ‘UNITE! Activism to end violence against women and girls.’যেখানে জাতিসংঘ সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, Unite by 2030 to end violence against women. Campaign a multi years effort aimed at preventing and eliminating violence against women and girls around the world. নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে মহিলা পরিষদ আহ্বান জানাচ্ছে, ‘নারী ও কন্যা নির্যাতন বন্ধ করি, নতুন সমাজ নির্মাণ করি। ’
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত করেছে। পৃথিবী আজ একবিংশ শতাব্দীতে অবস্থান করছে। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা নারীর মানবাধিকারের লঙ্ঘন—এ কথাটি সবার অন্তরে ধারণ করে সমাজ, রাষ্ট্র ও বৈশ্বিক সম্মিলিত উদ্যোগ এবং মোর্চা আজ সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান দাবি।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক কালেরকণ্ঠ