আজ ৪ এপ্রিল, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৫০ বছরে পা রাখল। ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রায় পাশাপাশি পথ চলছে। এই পথ বন্ধুর, সংগ্রামমুখর; চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনের উত্তরসূরি সুফিয়া কামাল ও ছাত্র আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারার নেত্রীদের যৌথ প্রয়াসে স্বাধীনতার ঊষালগ্নে জন্ম হয় মহিলা পরিষদের। মহীয়সী নারী রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন বলেছিলেন, ‘ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন- অগ্রসর হউন। বুক ঠুকিয়া বল মা! আমরা পশু নই; বল ভগিনী আমরা আসবাব নই; বল কন্যে জড়োয়া অলঙ্কার রূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই, সকলে সমস্বরে বল আমরা মানুষ।’ ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতারা রোকেয়ার সুরে ‘সচেতন হও, সংগঠিত হও নিজের অধিকার বুঝে নাও, আন্দোলন গড়ে তোলো’- এই আহ্বান জানিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিলেন।
মহিলা পরিষদ নারীর মানবাধিকারকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। আর তাই মহিলা পরিষদের কাজের ধারা বহুমাত্রিক। নারী সমাজকে সচেতন ও সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে মহিলা পরিষদের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার মধ্যে নিহিত ছিল বিপুল সম্ভাবনা ও শক্তি। তাই আজ সর্বস্তর ও পর্যায়ের গণনারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের একটি বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৬১টি জেলায় ৩৮৫টি ইউনিয়নে, ২৩৮৩টি তৃণমূল শাখা রয়েছে সংগঠনের। এসব স্থানে কাজ করছেন এক লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৬ জন সদস্য। এ বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান- ‘যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলি’। মানবাধিকারের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো সব রকম সহিংসতা, নিষ্ঠুর আচরণ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন-নিপীড়নমুক্ত জীবন। বাংলাদেশের নারী ও কন্যাদের জীবনে মানবাধিকারের এই মৌল শর্ত পদে পদে লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ নারী তার নিকটতম পারিবারিক সদস্যদের দ্বারা নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি। এর মধ্যে ১৮ বছরের নিচে কন্যাশিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তারা গৃহ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পথ-প্রান্তরে নানা ধরনের নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্ততার শিকার হচ্ছে। পত্রিকা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে তিন হাজার ৯১৮টি নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণ ৯৪২টি, গণধর্ষণ ১৮২টি। তা ছাড়া যৌন হয়রানি, এসিড নিক্ষেপ, যৌতুক, হত্যাসহ বিভিন্নমুখী নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছে তারা। ২০১৭ সালে মহিলা পরিষদের অপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নির্যাতিতদের ৩৫ শতাংশ নারী, ৬৫ শতাংশ কন্যা। ধর্ষণের শিকার নারীর ৫৫ শতাংশের বয়স দুই থেকে ২৫ বছর। ধর্ষণকারী পুরুষের ৪৩ শতাংশ ১১ থেকে ২৫ বছর বয়সী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার ও নির্যাতনকারী উভয়েই তরুণ, যা সামাজিকভাবে আরও গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আমাদের সমাজে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিপক্ষের নারী সদস্যদের ওপর নির্যাতন ও সহিংসতা। তা সে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হোক, পারিবারিক বা সম্পত্তির বিবাদ হোক। সর্বক্ষেত্রে নারী হয়ে উঠছে আক্রোশ ও সহিংসতার শিকার। সম্প্র্রতি ঘটে যাওয়া জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন-পরবর্তী নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ঘটে যাওয়া গণধর্ষণের ঘটনা তারই প্রতিফলন।
নারী ও কন্যার জীবনে এই অন্ধকার চিত্রের বিপরীতে একটি উজ্জ্বল চিত্রও রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। নারী দক্ষতার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সব ধরনের দায়িত্ব পালনে সমর্থ হচ্ছে। সরকারের গৃহীত নানামুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বিগত দুই দশকে জাতীয় ও বৈশ্বিক নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি স্থিতিশীলতা রয়েছে। এর পাশাপাশি ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্যের হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা উদ্বেগের বিষয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অর্থনৈতিক সূচকে রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিসংখ্যানের হিসাবে নারীর উন্নয়ন প্রতিফলিত হচ্ছে। নারী ও কন্যা নির্যাতনের ক্ষেত্রে কিছু ইতিবাচক আইন, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের মতো সাহায্যকারী কেন্দ্র রয়েছে। মহিলা পরিষদসহ আরও নানা সংগঠন বিভিন্ন ধরনের আইন সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নারী ও কন্যা নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সংগঠিতভাবে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। তার পরও দেখা যাচ্ছে, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনায় মাত্র ৩ শতাংশ বিচারের আওতায় আসছে। অর্থনৈতিক-রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কারণে নারী নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার বাধাগ্রস্ত হয়। বিচারহীনতার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের সমাজে ছড়িয়ে আছে। বিচারহীনতার এই অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, জেন্ডার সংবেদনশীল বিচার ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থায় জেন্ডার সমতাপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। আমরা লক্ষ্য করি, অর্থনৈতিক বিকাশে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পরও উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অংশীদারিত্ব তেমন নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান শর্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বক্ষেত্রে নারীর অধিকার। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে মূলধারার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের একটি প্রক্রিয়া। এ ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের পরিবর্তে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠান। এ লক্ষ্যে মহিলা পরিষদ খসড়া বিলও পেশ করেছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আরও ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন পদ্ধতি বহাল রাখা হয়, যা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি পশ্চাৎপদ সিদ্ধান্ত। নারী আন্দোলন আশা করে, বর্তমান সংসদ বিষয়টি নিরীক্ষণ করবে এবং সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে, যা হবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ।
ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতার ক্ষেত্র বিয়ে ও বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার নারীর প্রতি বৈষম্য তৈরি করছে। এর পেছনে রয়েছে নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গি। সিডও সনদের নারীর ব্যক্তি অধিকারের ২নং এবং ১৬.১ (গ)নং ধারা এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। সিডও সনদেও ২নং ধারায় বলা হয়েছে- প্রতিটি দেশের সংবিধান ও জাতীয় আইনগুলোয় নারী-পুরুষের সমতার নীতিমালা সংযুক্ত করতে হবে। প্রচলিত যেসব আইন, বিধি, প্রথা নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে সেগুলো পরিবর্তন বা বাতিল করার উদ্দেশ্যে আইন প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ১৬নং ধারায় বিয়েসহ সব ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। ব্যক্তিজীবনের অধিকারহীনতা নারীকে ক্ষমতার কাঠামোয় অধস্তন করে রেখেছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন সামাজিক সূচকে নারীর অবস্থান উন্নীত করছে না। তাই আজ বুঝতে হবে, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা নারীর ব্যক্তি-সমস্যা নয়। এটি সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত সমস্যা, যার মূলে রয়েছে নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে বিদ্যমান। এই বাস্তবতা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে তুলবে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়ন দেশের অবস্থানের উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করবে। একই সঙ্গে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম ‘জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন’-এর বাস্তবায়ন ঘটবে না। নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধের আন্দোলন সমাজে প্রচলিত রীতি, আচার, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতাকে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে। গ্রহণ করতে হবে বহুমাত্রিক কার্যক্রম, যা বাস্তবায়নে থাকবে নারী-পুরুষ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত ভূমিকা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য দুর্নীতিসহ নানা ক্ষেত্রে সরকার যেমন ‘শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি’ ঘোষণা করেছে; বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে সমগ্র নারী সমাজের পক্ষ থেকে আমাদের প্রত্যাশা- নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি’ ঘোষণা ও তা বাস্তবায়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : সমকাল