পোশাকের স্বাধীনতার কথা বললে আরেকটি বিষয় সামনে এসে যায় তা হলো—ড্রেস কোড। সারা পৃথিবীতে এবং আমাদের দেশেও ড্রেস কোড আছে। স্কুলপর্যায়ে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ড্রেস আছে। অনেক কলেজেও আছে। আবার স্কুল-কলেজ ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ড্রেস কোড আছে।
হালের ফ্যাশন—বাড়িতে, রাস্তাঘাটে হাফপ্যান্ট পরা যুবা বয়সী ছেলেদের রোমশ মাংসল ঊরু ও পা দেখে কারও ভালো লাগে কি না, জানি না। আমার ভালো লাগে না। তাই বলে আমি ওদের কিছু বলতেও যাই না। এমনকি ইজিবাইকে চলার সময় তাদের কেউ লাফ দিয়ে উঠে পাশের সিটে বসে পড়লেও কিছু বলি না। কেবল তার অভিব্যক্তিতে যদি অসভ্যতা থাকে চুপচাপ নেমে পড়ি। সম্ভবত কেউই কিছু বলে না ওদের। বলা ঠিকও না। বললে সেটা অবশ্যই অনাধিকারচর্চা হবে। পরিচিত বা অপরিচিত মানুষের সামনে যদি কারোর নিজের শরীরের কিছু অংশ অনাবৃত রেখে চলতে লজ্জাবোধ না হয়, আমাদের তাতে কী বলার আছে? বিষয়টা হচ্ছে দেখার অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির।
নইলে আমরা তো জন্ম থেকেই দেখেছি উদোম গায়ে কৃষক-জেলে-মাঝিসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমজীবী পুরুষ মানুষেরা নিম্নাঙ্গে গামছা বা লুঙ্গি ভাঁজ করে হাঁটুর ওপরে তুলে কোমরে গুঁজে নেংটি পরে কাজ করছেন। জন্ম থেকে দেখছি বলে তাতে আমাদের অস্বস্তি লাগেনি। মনে হয়েছে এটাই স্বাভাবিক। কাজ শেষে গোসল সেরে তাঁরা যখন হাঁটুর নিচে নামিয়ে লুঙ্গি বা ধুতি ঊর্ধ্বাঙ্গে হাতাওয়ালা গেঞ্জি, হাফহাতা শার্ট বা ফতুয়া পরেছেন, সেটাও স্বাভাবিক লেগেছে। যদিও হাল আমলের অনেক যুবক সে কৃষিকাজ বা যেকোনো ধরনের শ্রমের কাজ জিনসের প্যান্ট পরেও করে থাকে। কিন্তু আমাদের ছোটবেলায় এবং বছর বিশেক আগেও শ্রমজীবী নারীরাও (গ্রামীণ নারীরা তো সবাই শ্রমজীবী ছিলেন) কাজের সময় উদয়াস্ত পেটিকোট ও ব্লাউজবিহীন শাড়ি কোমরে কষে দুই প্যাঁচ দিয়ে পরে ঘরে-বাইরে কাজ করছেন দেখে দেখে শিশু-কিশোরেরা বড় হয়েছে। ঘরের পুরুষ, পরের পুরুষ সবাই নারীদের এভাবেই দেখেছেন। কিন্তু নারী-পুরুষ কেউ কারও পোশাক পরা নিয়ে কথা তোলেননি। অবশ্য আজও পুরুষের পোশাক পরা নিয়ে কেউ কথা তোলে না। যত কথা হয় সব নারীর পোশাক নিয়ে।
শুরু করেছিলাম যুবা বয়সী ছেলেদের হাফপ্যান্ট পরা ও ঊরু প্রদর্শনীটা অস্বস্তিকর ঠেকার কথা বলে। আসলে অস্বস্তিকর ঠেকে এত দিন আমরা এটা দেখিনি বলে। এত দিন শিক্ষিত বা আধা শিক্ষিত শহুরে ছেলেরা প্যান্ট, পায়জামা বা লুঙ্গি পরে তার সারা শরীর ঢেকেই বাইরে বেরিয়েছে। সেটা দেখেই আমরা অভ্যস্ত। তাই হঠাৎ অনভ্যস্ত চোখে সেটা দেখতে অস্বস্তি। কিন্তু আমরা কথা বলি না নিজেদের শিষ্টাচার থেকে অথবা কিছু বললে উল্টো আমাদের মানসম্মানে আঘাত লাগবে বলে। কিন্তু বর্তমান সময়ে অধিকাংশ লোকের মনকে ও তাদের অনুভূতির তারকে এমন একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে যে কোনো নারী আর তাঁর নিজের পছন্দের পোশাক পরতে পারবেন না। তাঁকে তাঁর সমাজের ও ধর্মের ছকে বেঁধে দেওয়া পোশাক পরতে হবে। তা না পরলেই পুরুষ এমনকি নারীও তাঁকে আক্রমণ করবেন। কিছুদিন আগে ঢাকায় বাসে এবং নরসিংদীতে রেলস্টেশনে এমন দুটি ঘটনা ঘটল।
যদিও ঘটনার পর নানাভাবে প্রতিবাদ হয়েছে। অফলাইনে মানুষের সক্রিয় উপস্থিতিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশের মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছে মানুষ। বেশি প্রতিবাদ হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের পক্ষে যেমন অনেক মানুষ আছেন, তেমনি বিপক্ষেও আছেন। আসলে একজন নারীর পোশাকের জন্য হেনস্তার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নেটিজেনদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখে সমাজ মানসটাও খুব ভালোভাবে জরিপ করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সমাজ ও তার মানুষের মনোজগৎ কত খারাপভাবে বদলে গেছে। একটা বড় অংশের লোক কেউ সরাসরি আক্রমণে আর কেউ একটু ইনিয়ে-বিনিয়ে নারীদের সেই মোড়কের ভেতরেই ঢোকাতে বদ্ধপরিকর।
পোশাকের স্বাধীনতার কথা তুলে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হিজাব-বোরকা পরায় বাধা দেওয়াকে অগণতান্ত্রিক বলা হয়। যেমন ভারতের মুসকান এবং আরও আগে ফ্রান্সে মেয়েদের হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এই আমাদের দেশের অনেক উদারবাদীদেরও বলতে শোনা গেল একজন নারীই ঠিক করবেন তিনি কী ধরনের পোশাক পরবেন! কিন্তু বড় জানতে ইচ্ছে করে—এই হিজাব-বোরকা পরার সিদ্ধান্তের মাঝেই কি কেবল নারীর স্বাধীন ইচ্ছার প্রকাশ ঘটাতে আমরা পছন্দ করি? না পরার সিদ্ধান্তের মাঝে পছন্দ করি না? কিন্তু এটা ছাড়া নারী তাঁর জীবনের আর কোন ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলুন দেখি? যে নারী এখনো তিনবেলা ভাত না পেয়ে তিনবেলা স্বামীর হাতের পিটুনি সত্ত্বেও সেই স্বামীকে ছেড়ে স্বাধীন স্বাবলম্বী জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, সন্তান প্রসবের মতো কঠিন যন্ত্রণাদায়ক দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা না থাকলেও স্বামী ও পরিবারের দাবি মেটাতে গিয়ে কেবল একটা পুত্রসন্তানের জন্য পাঁচ, সাত, আট এমনকি দশবার গর্ভধারণ করতে বাধ্য হন, একাডেমিক চমৎকার সব ফল থাকা সত্ত্বেও পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চাকরি করতে পারেন না, সেখানে প্যাকেটবন্দী হওয়ার মাঝে নারীর স্বাধীন সত্তা খুঁজে নেওয়া সত্যি হাস্যকর নয়কি?
পোশাকের স্বাধীনতার কথা বললে আরেকটি বিষয় সামনে এসে যায় তা হলো—ড্রেস কোড। সারা পৃথিবীতে এবং আমাদের দেশেও ড্রেস কোড আছে। স্কুল পর্যায়ে প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ড্রেস আছে। অনেক কলেজেও আছে। আবার স্কুল-কলেজ ছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ড্রেস কোড আছে। এই ড্রেস কোড অনুসরণ না করা বা না পরা কিন্তু বিধান অমান্য করা। এখন আমাদের পুলিশ, সেনাবাহিনী, আনসার বাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস, অফিস-আদালতের সহায়ক যাঁরা, তাঁদের সবার জন্যই নির্ধারিত অভিন্ন পোশাক আছে এবং চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্সদের জন্যও অ্যাপ্রোন এবং ওয়ার্ডবয় ও আয়াদের জন্য ইউনিফর্ম আছে।
কাজের সময় এসব না পরা সরকারি বা চাকরিবিধি অমান্য করা হয়। সেই জায়গায় কোনো আর্মি সদস্য কি পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি বা ধুতি-পাঞ্জাবি-উত্তরীয় আর পায়ে চপ্পল পরে ব্যারাকে তাঁর কর্মসময়ে অবস্থান করতে পারেন? তাহলে একজন স্কুল বা কলেজছাত্রী তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ড্রেস কোড অমান্য করে হিজাব বা বোরকা পরার বায়না করবে, সেটা কি মামাবাড়ির আবদার নয়? একজন সৈনিক তার কর্ম এলাকার বাইরে যেকোনো পোশাক পরতে পারেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সেটা করলে তাঁর চাকরি থাকবে না। কোনো নারী বা মেয়ে তাঁর যদি হিজাব পরার ইচ্ছা করেন, অন্যত্র তিনি তা পরুন কেউ তো কিছু বলবে না।
শেষ করব দুজন বিশেষজ্ঞ মানুষের আশাবাদী মন্তব্যের আলোকে। একবার প্রাবন্ধিক অধ্যাপক যতীন সরকার স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলার সময় নারীর কথাও উঠল। তিনি আশাবাদী মন্তব্য করে বলেছিলেন, ‘লাখ লাখ মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে, শিক্ষা গ্রহণ করছে, কর্ম করে খাচ্ছে—এটাই তো আশার কথা। রাস্তায় নারীদের এই মিছিল আমাকে আনন্দ দেয়। ওরা বেরিয়ে যখন এসেছে, একদিন সমস্ত অন্ধকারও ভেদ করবে।’ যতীন স্যার এ কথা বলেছিলেন ৯ বছর আগে। ৯ বছর পর দেখছি অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। মাত্র কদিন আগে আমার এক প্রবাসী বন্ধু যিনি জার্মানির এক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন এবং যিনি নিজেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলাচল করতে গিয়ে চারপাশের অবস্থা দেখে নিজেকে একেক সময় অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করেছেন এবং অবস্থাদৃষ্টে বিভিন্ন সময় নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, সেদিন তিনিও হঠাৎ আশাবাদী মন্তব্য করে বললেন, হিজাব-বোরকার এত ব্যবহার আসলে একটা ট্রেন্ড। যেমন একসময় আমরা সবাই চোশত বা বেলবটম জাতীয় পায়জামা পরতাম, এটাও সে রকম একটা ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ড একটা সময় আর থাকবে না। চলে যাবে। বন্ধুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি কেন যেন আশাবাদী হতে পারিনি। আর তাঁর কথামতো যদি এই ট্রেন্ড চলেও যায়, তা-ও কিন্তু এই ট্রেন্ড নারীর সমতার আন্দোলনকে অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়ে যাবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : আজকের পত্রিকা