সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন প্রচারে জাতিসংঘ অনুমোদিত একটি দিন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই দিবসের হাত ধরে গত শতাব্দীতে এসেছে চারটি বিশ্ব নারী সম্মেলন, বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলনগুলো বেইজিং প্ল্যাটফরম, জাতিসংঘের নারীর মর্যাদা কমিশনসহ (CSW) বহু আন্তর্জাতিক, জাতীয় নারী আন্দোলন সংগঠন।
অবশ্য মনে রাখা প্রয়োজন বিংশ শতাব্দীতে নারী আন্দোলন দৃশ্যমান হলেও অগ্রসর নারীদের ব্যক্তিমানসে আত্ম-অন্বেষার কথা সপ্তদশ শতাব্দীর ইতিহাসের পাতায় দেখা যায়। এই আত্ম-অন্বেষার জন্য ডাইনি হিসেবে বিবেচিত হওয়া, নানা বিষয়ে জ্ঞান থাকার অপরাধে জিহ্বা কেটে ফেলা—এসব ইতিহাসের অংশ। বিংশ শতাব্দীতে নারীর যে যাত্রা শুরু হয়েছে তার পেছনে রয়েছে বহু নারীর যুগ যুগব্যাপী ব্যক্তিগত ক্ষোভ-বিদ্রোহ। যার সবটুকু আমাদের জানা নেই। আজকের নারীর পরিচয় তৈরি করতে যাঁরা অবদান রেখেছেন তাঁরা সমাজের অগোচরেই থেকে যাবেন। তাঁদের সবার প্রতি জানাই বিশেষ শ্রদ্ধা।
নারী আন্দোলনের বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, জাতীয় সংকটের ফলে সৃষ্ট জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই নারী আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে ও শক্তি অর্জন করেছে। প্যারিকমিউন, আমেরিকার যুদ্ধ, দাস বিদ্রোহ, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ইত্যাদি। প্রাচ্যের নারী আন্দোলনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ঊনবিংশ শতাব্দী বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশ, যুবসমাজের শিক্ষানুরাগ এবং শিক্ষা গ্রহণের সুযোগে, নতুন ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুবাদে ভারতীয় নারীরা শিক্ষা বিষয়ে আগ্রহী হন। একই সময়ে মুসলিম তরুণদের মধ্যেও নারী শিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা দেখা যায়। যে গুটিকয়েক নারী শিক্ষার আলোর সুযোগ পান তাঁদের মধ্যে অনেকেই ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামসহ সমাজকল্যাণমূলক বহু কাজে ব্রতী হন। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন সমাজে আলোড়ন তোলেন। তিনি নারীর অবরোধ অবস্থান, নারী শিক্ষার প্রয়োজন, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন—সর্বোপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লেখনী তুলে ধরেন। তিনি ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচূর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’সহ অসংখ্য কথিকা, বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নারীকে জাগিয়ে তোলেন। ঘোষণা করেন, ‘পুরুষ যাহা যাহা পারে, নারীও তাহা তাহা পারিবে।’ তিনি শুধু ঘোষণা-বক্তব্য দিয়েই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। কার্যক্ষেত্রে সর্বশক্তি দিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও মহিলা সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম গড়ে তোলেন। এভাবে একদিকে সমাজে ব্রিটিশবিরোধী দেশমুক্তির আন্দোলন, পাশাপাশি বেগম রোকেয়াসহ রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দ্বারকানাথ ঠাকুরসহ বহু সমাজ সংস্কারকের সংস্পর্শে এসে নারীও সংগঠিত হয় দেশমাতৃকার আরাধনায়। পূর্ববঙ্গের দিকে দৃষ্টি দিলেও দেখব পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের জাতীয় জাগরণের আন্দোলন, সত্তরের মহান স্বাধীনতাসংগ্রামসহ সব সংগ্রামে নারী সম্পৃক্ত থেকেছেন, ভূমিকা রেখেছেন, নিজেকে শক্তিশালী করেছেন।
একবিংশ শতাব্দীতে নারী আন্দোলন একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যেকোনো দেশের গণতান্ত্রিক অর্থনৈতিক বিকাশে এবং বিকাশের স্থায়িত্বে নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ আজ আবশ্যক হিসেবে স্বীকৃত। এই স্বীকৃতির ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলো অতিক্রমের পথ নারী আন্দোলন চিহ্নিত করতে পারে, পথরেখা নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে। তবে পথরেখা নির্মাণের সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের একক ক্ষমতা নারী আন্দোলন অথবা সংগঠনের নেই। সেখানে প্রয়োজন সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা।
২০২৩ সালের নারী দিবসের আহ্বান ‘DigitALL : Innovation and technology for gender equality ।’ আমরা জানি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় আমরা অতিক্রম করছি। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ সভ্যতা গড়ে উঠছে, যা নতুন জীবনাচরণের, মানসিক গঠনের এবং দক্ষতাভিত্তিক মানবসমাজ গড়ে তুলবে। নারী আন্দোলনের অভিযাত্রায় এ কথা আজ স্বীকৃত যে ‘নারী উন্নয়নের বাহক’। প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গড়তে নারীবান্ধব প্রযুক্তি গড়ে তুলতে হবে এবং নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে হবে।
তাই এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেখতে হবে প্রযুক্তি দক্ষতা অর্জনে নারীর সম্ভাবনা সংকট ও চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে, নজর দিতে হবে নারীবান্ধব প্রযুক্তিনীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণে।
লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় লক্ষ রাখা প্রয়োজন। আমার বিবেচনায় বিষয়গুলো হলো উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে : ১. নারীর অভিগম্যতা, ২. নারীর দক্ষতা অর্জন ও ৩. প্রযুক্তি ব্যবহারে নিরাপত্তা।
সম্প্রতি একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, প্রযুক্তি, স্টার্টআপ ও অনলাইনভিত্তিক ব্যবসায় উদ্যোগী নারীদের নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলোয় নারীদের অংশগ্রহণ শতকরা ২০ ভাগ। যদিও যাঁরা অংশগ্রহণের পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাঁদের সফলতা শতভাগ।
প্রযুক্তি উদ্যোগী হওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অন্যতম বাধা হলো অর্থ সংকুলান। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর অধিকার না থাকায় নারীর পক্ষে নিজস্ব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অর্থ জোগান দেওয়ার প্রক্রিয়াটি কঠিন হয়ে থাকে।
অন্যদিকে বর্তমানে অনেক শিল্প-কারখানা স্বয়ংক্রিয় মেশিনে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় শিল্প-কারখানায় নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিককালে গার্মেন্টশিল্পসহ অনেক শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। অথচ আমরা জানি, একসময় গার্মেন্টশিল্পে শ্রমিকের ৮০ শতাংশ ছিলেন নারী। নারীর অংশগ্রহণের এই হার এখন কমে আসার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
করোনা-পরবর্তী সময়ে কিশোরী কন্যাদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার বিষয়ে অনেক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলবে। শিক্ষার সুযোগ সংকোচন প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণকে সংকুচিত করবে।
উচ্চশিক্ষায় যে স্বল্পসংখ্যক নারী সুযোগ পাচ্ছেন তাঁরাও বিজ্ঞান প্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে যথাযথ সুযোগ পান না সমাজ প্রচলিত নানা চিরাচরিত প্রথা ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এসব দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রথা পরিবর্তনের উদ্যোগে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেই প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের জগতে নারীর সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কর্মকাণ্ডে নারীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ নারী জনগোষ্ঠী তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠানগুলোয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রণয়ন করা জরুরি। কর্মসূচির পাশাপাশি প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে যৌন নির্যাতনের জন্য নানাভাবে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার বিষয়ে অপ্রতুল জ্ঞান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও আইনের সীমাবদ্ধতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নারীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই মাধ্যম নারীর জন্য নিরাপদ করার লক্ষ্যে ব্যবহারকারীকে সচেতন ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে নানাবিধ প্রশিক্ষণ।
ডিজিটাল সুরক্ষা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বহুবিধ সংকট আমরা জানতে পারি গণমাধ্যমের সহায়তায়। এই আইন প্রয়োগকারী জনবলের সীমাবদ্ধতাসহ যেসব নেতিবাচক প্রবণতা আছে সেগুলোর উত্তরণ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে নারী নির্যাতনের নতুন মাত্রা ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগের নিরাপত্তাহীনতা শুধু নারীসমাজ নয়, প্রান্তিক, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যও সংকট সৃষ্টি করছে। নারীসহ সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল সুযোগ নিরাপদ করা ব্যতিরেকে জাতীয় অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। এটি যথাযথ অনুধাবন ও প্রতিরোধের পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সময়কালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের নারীর মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের ৬৭তম অধিবেশনের প্রতিপাদ্য ‘বর্তমান ডিজিটাল যুগে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করতে হবে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে।’
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখি জাতীয় অগ্রগতি অপরিহার্য শর্ত লিঙ্গীয় সমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হলেও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল সংকট। সম্পদ-সম্পত্তিতে নারীর অধিকার, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর প্রভাব সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি এবং সমাজের প্রচলিত গত্বাঁধা ধারণা পরিবর্তন করে আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা যেমন সময়ের চাহিদা, তেমনই নারী আন্দোলনের দাবি। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সহায়তায় পিতৃতান্ত্রিক ধারণার পরিবর্তন করে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠন করার প্রত্যয় দৃঢ় হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের চেতনা।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ