যদিও ছেলেদেরও বিয়ের একটা সুনির্দিষ্ট বয়স আছে এবং সেই বয়সের আগে বিয়ে করলে বাল্যবিবাহ হয়, তবু বাল্যবিবাহ নিয়ে কথা উঠলে আমাদের সামনে নাবালিকা বিবাহের বিষয়টিই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এবং আমরা উদ্বিগ্ন হই। কিন্তু এটাও তো উদ্বেগের বিষয় যে ২১ বছরের নিচে ১৯-২০-১৬-১৭-এর ছেলেদেরও বিয়ে হচ্ছে। সেটাও সংখ্যায় কম নয়। পরিসংখ্যান বলছে, এখনো ৬৫ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার। এটা করোনা মহামারি-পূর্ব পরিসংখ্যান। বর্তমান সময়ে এ পরিসংখ্যান বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু দেশে ছেলে বাল্যবিবাহের কোনো পরিসংখ্যান আছে কি না, জানি না। না জানার কারণ, এতদ্সংক্রান্ত তথ্য চোখে পড়ে না। তা ছেলে বাল্যবিবাহের পরিসংখ্যান ও এর প্রচারণা থাকুক বা না থাকুক, দেশে ছেলে বাল্যবিবাহ মোটেই কম নয়।
মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হলে তার ফলাফল তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহিত কিশোরীরা মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। বিবাহিত জীবনের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন তো প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনা। সঙ্গে কৈশোরকালীন মাতৃত্বের কারণে অকাল মৃত্যু, প্রজননতন্ত্রের নানা রকম রোগ ও অপুষ্ট শিশুর জন্ম ইত্যাদি তো আছেই। তবে বাল্যবিবাহের কারণে কিশোরীদের জীবনে যত রকমের কুফল আছে তার থেকে সংখ্যায় কম হলেও বা সহিংসতার শিকার না হলেও ছেলেদের জীবনেও কতগুলো কুফল আছে, যা শুধু ব্যক্তিজীবন নয়, এর প্রভাব পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্যাপকভাবেই পড়ে।
আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
প্রথমত, একটা কিশোরও অল্প বয়সে পিতা হওয়ার কারণে তার জীবদ্দশায় চতুর্থ প্রজন্মের জন্ম, যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। দ্বিতীয়ত, একটা ছেলে ১৮ বছর বয়সে পৌঁছালে তাকে সাবালক ধরা হলেও সংসার করার বা সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো বুদ্ধি তার হয় না। অপরিণত বুদ্ধির কিশোর যখন নিজের দায়িত্বই নিতে অপারগ, তখন স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব পালন সংগত কারণেই করতে পারে না। সংসারে মা-বাবা চাপ দেন, ‘তোর বউ বাচ্চা তুই পাল’। বউয়ের অনেক না হোক সামান্য চাহিদা তো থাকবেই। যখন এর কিছুই সে পূরণ করতে পারে না, তখন হয় খিটিমিটি, মারামারি, হাতাহাতি। কারও ভেঙে যায় সংসার, কারও দু-চারটি সন্তানের পিতা হয়ে চোখে সরষে ফুল দেখার জোগাড়। যার নিজেরই পিতার ছায়ায় বেড়ে ওঠার কথা, সে কিনা সংসার সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খায়!
এই কিশোর বা সদ্য তরুণেরা সবাই বাল্যবিবাহের শিকার হয় না বটে, তবে তারা অবশ্যই আমাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের শিকার।
দাদা-দাদি, নানা-নানির নাতি-বউ দেখার শখ পূরণ করতে বা ঘরের কাজকর্ম করার মানুষ নেই বলে যখন অনেক কিশোরকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয় তারা অবশ্যই বাল্যবিবাহের শিকার। এ পরিস্থিতিতে সচ্ছল পরিবারের কিশোরের কাঁধে হয়তো চাপ পড়ে না, কিন্তু ছেলের কিশোরী বউয়ের নরম কাঁধে একটা সংসারের পুরো দায়িত্ব তুলে দেওয়ায় তার কোমল কাঁধটা থেঁতলে যায়। এমন ঘটনা সেসব পরিবারেই হয় যেখানে শিক্ষা নেই। মাতৃ ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে কোনো সচেতনতা নেই। অসচ্ছল পরিবারের কিশোর ছেলেটিকে বিয়ে দিয়ে বাবা-মা যখন বউয়ের ভরণপোষণের ভার ছেলের কাঁধে চাপিয়ে দেন আর সে ভার বইতে না পারলে সেই তাঁরাই গালমন্দ করেন, তখন নানা রকম অঘটন ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
প্রাসঙ্গিকভাবে দু-তিন বছর আগের এক করুণ ঘটনার কথা বলি। পরিচিত এক মেয়ে জানাল, তার উনিশ বছরের বোনপো আত্মহত্যা করেছে। মা-বাবাই শখ করে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে কাজকর্ম করে না। বউয়ের সঙ্গে গল্প-গুজব করে। সেটা মা-বাবার সহ্য হয় না। অবিরত বকাঝকার চোটে বিষ খায় ছেলেটি।
বলছিলাম যে খোঁজ নিলে জানা যাবে কোন ছেলেরা বাল্যবিবাহ করে বা কেন করে। ওপরে যাদের কথা বলা হলো, তাদের অভিভাবকেরাই বিয়ে দেন। কিন্তু একটা বিরাট অংশ নিজেরাই বিয়ে করে ফেলে বা অভিভাবককে বিয়ের আয়োজনে বাধ্য করে। এরা হচ্ছে সমাজের বৃহৎ যে অংশ খেটে খাওয়া মানুষ, সেই শ্রেণি। যে দরিদ্রতার কারণে বিয়ে করতে পারছে না যত যুবক, তার চেয়ে বেশি অনেক কিশোর বিয়ে করে ফেলে। দরিদ্রতার জন্যই দেশের লাখ লাখ পরিবার তার শিশু-কিশোর সন্তানকে জীবিকার জন্য কাজে নামিয়ে দেয়।
দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার পক্ষে আইন আছে শুনি। অথচ সবার চোখের সামনে এই আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। রিকশাচালক ছেলেটার বয়স তেরো-চৌদ্দ বছর দেখেও আমরা অবলীলায় তার রিকশায় চড়ে বসি। বাসার কাজের জন্য শিশুদের খুঁজি। চায়ের দোকান, মুদিদোকান, মাংসের দোকান, কলকারখানায়, ইটের ভাটায়, চাতালে, গ্রিল ও ফার্নিচার তৈরির ওয়ার্কশপে, খেতে-খামারে, ঘরবাড়ি ও সড়ক নির্মাণের শ্রমিক ও পরিবহনের হেলপার হিসেবে নিত্যদিন চোখের সামনে শিশুরা শ্রম বিকোচ্ছে। আট-দশ বা বারো-তেরো বছর বয়সেই তাদের কাজে লাগিয়ে দেন মা-বাবারা। কেউ নিজেই নেমে পড়ে কাজের ধান্দায়। বাইরের পৃথিবীর নিষ্ঠুরতার মাঝে বেড়ে ওঠা তাদের মনের বয়স দ্রুত বেড়ে যায়। বালক থেকে কিশোর, কিশোর থেকে তারা তারুণ্যের দিকে পা বাড়ায়। কাজ করার সুবাদে তাদের পকেটে পয়সা থাকে। যেখানে দুটো পয়সার জন্য মা-বাবার পেছন পেছন ঘুরঘুর করার কথা, সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় উল্টো মা-বাবা তাকে তোয়াজ-তোষামোদ করেন টাকার জন্য। সে তখন মা-বাবার পিতা হয়ে যায়। ইচ্ছে হলে মা-বাবাকে টাকা দেয়। কিন্তু বন্ধুদের নিয়ে ফুর্তি করতে শিখে যায়।
ডিজিটাল যুগের ছেলে তারা একটা স্মার্টফোন হাতে না থাকলে বন্ধুদের কাছে ‘প্রেস্টিজ’ থাকে নাকি? সাত-আট হাজার টাকায় স্মার্টফোন মেলে। ইন্টারনেট মেলে আরও সস্তায়। সস্তার প্যাকেজে ২০-৩০ টাকায় দু-তিন জিবি ইন্টারনেট পাওয়া যায়। হাতের মুঠোয় ব্লুফিল্ম। ইঁচড়ে পাকা ছেলেদের দেহে যৌবন আসার আগেই মনে যৌবন এসে যায়। মা-বাবাকে হুমকি দেয় বিয়ে না করালে টাকা দেবে না অথচ বয়স মাত্র ১৬-১৭। কেউ তো নিজেই বিয়ে করে নিয়ে আসে। এদিকে ঘরে মা-ভাই-বোনেরই থাকার জায়গা হয় না। একটা ঘর নামের খুপরিতেই একসঙ্গে পিতা-পুত্রের যৌনজীবন যাপন। বছর না ঘুরতেই আসে সন্তান। অপুষ্ট শিশু রক্তশূন্য কিশোরী মা এই নিয়েই তো অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষের ঘরসংসার।
এদের আড়ালে রেখেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে যাওয়ার আনন্দে বগল বাজাই আমরা। অথচ এই এরা উন্নয়নের মহাসড়কের মাঝখানে যে খানাখন্দ হয়ে আছে, সে খবর রাখি না। চারপাশে শাহ আবদুল করিমের গান বেজে যায়, ‘গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে…’। গাড়ি না চলার কারণগুলো বলা হলো। সমাধানের পথ তাঁদেরই বের করতে হবে, যাঁরা খানাখন্দ ভরাট না করে গাড়ি ছেড়ে দিতে চান।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : আজকের পত্রিকা