বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তাঁর বৈজ্ঞানিক তত্তে¡র কারণে নির্যাতিত হতে হতেও আÍবিশ্বাস নিয়ে বলেছিলেন, ‘কিন্তু যাহাই হোক পৃথিবী ঘুরিতেছে। ’ তিনি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সত্যি, কিন্তু তাঁর তত্ত¡ পরবর্তীকালে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এ কথা উলেখ করার কারণ এই-মহিয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বৈজ্ঞানিক গ্যালিলিওর মতোই আÍবিশ্বাস, ধীশক্তি আর দূরগামী দৃষ্টি নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদিগকেও ঐরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিয়া উঠিতে হইবে। বিবেক আমাদিগকে আমাদের প্রকৃত অবনতি দেখাইয়া দিয়াছে, এখন উন্নতির চেষ্টা করা আমাদের কর্তব্য।
’ মনীষী রোকেয়ার এই আÍকথন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় দেড় শতাধিক বছর আগের সমাজব্যবস্থা, পরিবেশ আর পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে সমাজ পরিবর্তন, অব্যাহত কঠিন সংগ্রামের কথা। সে সময়ের সমাজমানসে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে চেপে থাকা নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বানের কথা।
তাঁর এই আহ্বানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সবার সম্মিলিত অভিমত আদায় করা এই মর্মে যে পরিবারে নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি যুক্তি হিসেবে তিনি বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন এভাবে যে ‘জগতে দেখিতে পাই, প্রত্যেকে প্রত্যেকের নিকট কোনো না কোনো প্রকার সাহায্য প্রার্থনা করে, যেন একে অপরের সাহায্য ব্যতীত চলিতে পারে না। তরুলতা যেমন বৃষ্টির সাহায্যপ্রার্থী, মেঘও সেইরূপ তরুর সাহায্য চায়। জল বৃদ্ধির নিমিত্ত নদী বর্ষার সাহায্য পায়, মেঘ আবার নদীর নিকট ঋণী। ’ মনীষী রোকেয়া সাখাওয়াতের আÍকারণের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার পথের প্রতিবন্ধকতা, নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতা প্রতিরোধে সাহসী হয়ে উদ্যোগ নিতে পারলে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আগ্রহ সৃষ্টি করে ঈপ্সিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার পথে যাপিত জীবনের পরতে পরতে বয়ে চলা নানা বৈষম্য, প্রথা, আর রীতিনীতির ঘেরাটোপে নানা দিক থেকে নারীর জীবনকে আবদ্ধ রাখার, বাধাবিপত্তি, প্রতিবন্ধকতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার সাহস অর্জনের কথা।
দেড় শতাধিক বছর আগের সেই সময়কালে সর্বত্র নারীর প্রতি যে ধরনের বৈষম্য প্রবল ছিল আজ সেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে উলেখযোগ্য অগ্রগতিও অর্জিত হয়েছে। অসূর্যস্পর্শা নারী আজ এভারেস্ট শৃঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে প্রতিনিধিত্ব করছে, বিমান চালনা, সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রের বিশেষত গুরুত্ব বহন করে এমন পেশাদারি কর্মক্ষেত্রে উলেখযোগ্য অবদান রয়েছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে, অর্থনীতির চাকা সামনে নিতে সাহসী ভূমিকা রাখছে। রাজনীতিতে উলেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে, কৃষি-শিল্প-কলকারখানা-রাস্তা নির্মাণ, আইলা মোকাবিলায় নারীর অবদান চোখে পড়ার মতো দৃশ্যমান হয়ে চলেছে। সমাজমানস পরিবর্তনের পথে এ এক ইতিবাচক দিক।
আস্থা নিয়ে বলা যায়, যে সময় মনীষী রোকেয়া জীবনজগৎকে উপলব্ধি করে সামজমানসকে সচেতন-সজাগ করে ভূমিকা নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা থেকে আজ বেশ কয়েক যুগ সামনে সময় এগিয়ে গেছে। শুধু আমাদের এই ভূখণ্ড নয়, সমগ্র উপমহাদেশ তথা গোটা বিশ্বে পরিবর্তনের বাতাস বয়ে চলেছে, দেশে নারী ও পুরুষের মধ্যে অসমতার ক্ষেত্রগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত হচ্ছে। তার মোকাবিলায় দেশে দেশে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগ অনুমোদন, কার্যকর করার অঙ্গীকার স্বাক্ষর দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে, নারী-আন্দোলন আমাদের দেশে সামাজিক শক্তির সক্রিয় সমর্থন আদায়ের মধ্য দিয়ে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রটিকে প্রতিনিয়ত আলোচনার বিষয়ে পরিণত করছে, জবাবদিহিতার দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরছে। এসব এই দীর্ঘ সময়কালের অর্জন হিসেবে উলেখযোগ্য।
নারী-আন্দোলন তার দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতায় দেশ ও বিশ্ব পরিসরে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে নারীর প্রতি যে অবমূল্যায়ন, অসমতা আর বৈষম্য কারো জন্য মঙ্গলময় নয়। এই অসমতা বৈষম্যের এক নৃশংসরূপ বর্তমান সময়ে আমাদের দেশসহ গোটা বিশ্বের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন। সমাজে বয়ে চলা বহুকালের এই বৈষম্য ও অসমতার সংস্কৃতির চর্চা হয় পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে। তাতে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে বৈ কমে না। সমাজমানসিকতা যেকোনো নির্যাতনের ঘটনায় নির্যাতনকারীকে দায়ী করার পরিবর্তে সাধারণভাবে নির্যাতনের শিকার নারীকেই দায়ী করে। নারী নির্যাতন বর্তমান সময়কালে দেশ ও সমাজ-প্রগতির ক্ষেত্রে যে অন্তরায় সৃষ্টি করে চলেছে, তাতে গোটা বিশ্ব একমত হয়েছে- যেকোনো বয়সের নারীকে সহিংসতামুক্ত রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে নিপীড়নকারীকে বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দায়ও রাষ্ট্রের।
আন্তর্জাতিক চুক্তি, আইন, সনদ হওয়া সত্তেও আমাদের দেশের জাতীয় পর্যায়ে আইন থাকা সত্তেও নারী নির্যাতনমুক্ত হতে পারছে না কেন? কারণ, নারী নির্যাতনের মূল সূত্রটিতে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র গুরুত্ব দেয় না। মহীয়সী রোকেয়ার আশাবাদ সামনে রেখে বলা যায়, নারীর প্রতি সহিংসতার ছবিগুলো আমাদের আতঙ্কগ্রস্ত, বিমর্ষ ও হতাশ করলেও শত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নারী-পুরুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা সহিংসতা রোধে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। আমাদের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার সাহস, দায়বদ্ধতা ও আশাবাদী স্বপ্ন নিশ্চয় একদিন নারীর জন্য সহিংসতামুক্ত, নিরাপদ, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জীবনের নিশ্চয়তা দেবে। সমাজমানস নারী-পুরুষ সমতার দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করবে। রোকেয়ার স্বপ্ন নারী-পুরুষের সমতাকে তরুণ প্রজন্ম ধারণ করবে, সার্থক ও সফলতার মুখ দেখাবে।
লেখক : নারী আন্দোলনকর্মী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ