এবারের দুর্গাপূজার আগে থেকে যখন বলা হচ্ছিল দেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই তখনই মনটা কু গাইছিল। হামলার আশঙ্কা নেই ঘোষণা শুনেই আমরা জানতে পেরেছিলাম পূজাকে কেন্দ্র করে দেশে হামলার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সমস্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত হয়েছেন আশঙ্কা নেই। কিন্তু কেন যেন আমরা কেউ কেউ নিশ্চিত হতে পারিনি। তার আগে আমাদের টিভি খবরে দেখেছি পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতের রাজ্য পশ্চিমবাংলাতেও জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
দুর্গাপূজার শুরুর দু’তিনদিন আগে থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা। আর তারপরেই কিনা আমাদের দেশে আশঙ্কা নেই বলে খবর প্রকাশ! একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন, সত্যি? কি এভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়? যে কারণে নিরাপত্তার কোনোই ব্যবস্থা রাখা হলো না! মহাঅষ্টমী পূজার দিন কুমিল্লায় নানুয়ার দিঘি পূজামণ্ডপে যে ঘটনা ঘটল তার প্রত্যক্ষদর্শী এবং পূজামণ্ডপের কাছাকাছি বাস করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কয়েকজনের ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানা গেছে, ওখানে রাতে পুলিশ প্রহরা ছিল না। সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল মণ্ডপটি। সেই অরক্ষিত সময়ে কে কী করেছে তা তো পুলিশি তদন্ত ছাড়া জানা সম্ভব না।
আমার বাসার সামনে একটা পূজামণ্ডপ আছে। সপ্তমী পূজার দিন সন্ধ্যা সময় গিয়েছিলাম প্রতিমা দেখতে। পরদিন দুপুরে অষ্টমী পূজাও দেখতে গেলাম। প্রতিবছর পূজায় এখানে পুলিশ ও আনসারকে বসে থাকতে দেখি। কিন্তু ওই দুদিন কাউকে দেখিনি। কুমিল্লার ঘটনার পর মনে হলো, এদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হঠাৎ করে স্থিতিশীল হয়ে গেছে কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত হয়েছিলেন কেমন করে? যেখানে যেকোনো পরিস্থিতির সুযোগ নিতে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী তো বটেই রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও একে অপরের বিরুদ্ধে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে সারাক্ষণ! রাজনীতির ব্যাপারস্যাপার আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি শুধু যেকোনো ব্যক্তি বা যে কোনো সম্প্রদায়ের মানুষের শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদে নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালনের অধিকারের কথা বলতে চাইছি। এ অধিকার ব্যক্তি ও সম্প্রদায়কে রাষ্ট্র দিয়েছে।
সংবিধানে উল্লেখ আছে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক তার ধর্মীয় উৎসব পালনের অধিকার ভোগ করবেন। কাজেই রাষ্ট্রকেই নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে হবে। তার অধিকার বাধাগ্রস্ত যাতে না হয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থা তা দেখভাল করবে। সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কিন্তু কুমিল্লার ঘটনার পরও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা হলো, নোয়াখালীর চৌমুহনী ও চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে যে ভয়াবহ আক্রমণ ভাঙচুরসহ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো তাতে কি প্রমাণ হলো যে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা এবং ধর্মীয় উৎসব পালনের স্বাধীনতা আছে? কেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে চেতনে অবচেতনে ভয়ের মাঝে থাকতে হয়? আশপাশে এমন অনেক ঘটনা ঘটে একজন নাগরিক হিসেবে আমরা কথা বলতে সাহস পাই না। চুপ করে থাকি। কেন আমরা হিন্দু বা সংখ্যালঘু। এমনকি যখন আমাদের ওপর আক্রমণ হয় তখনো চুপ করে ভয়ে ভয়ে থাকি।
এই যে এখন এই লেখা লিখছি, সেটাও ভয়ে ভয়ে লিখতে হচ্ছে। কিন্তু চোরের মায়ের বড় গলা- যারা সন্ত্রাসী, যারা হামলাকারী, যারা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায় তারা বড় গলায় কথা বলছে। তাদের টুঁটি চেপে ধরা হচ্ছে না। বারবার তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটলেই সেটার সঙ্গে রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেলা হয়। পরস্পর দোষারোপের সংস্কৃতির আবর্তে আসল ঘটনা গুলিয়ে ফেলায় এবং অপরাধীদের বিচার না হওয়ায় বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।
অথচ আমরা অহংকার করে বলি এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজমান। কথা তো মিথ্যে ছিল না। এখনো অধিকাংশ মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকেনি। এদেশে এখনো এমন অনেক মানুষ আছেন তাদের অনেকের সঙ্গে যখন আমরা ওঠাবসা চলাফেরা করি তখন মনেও থাকে না যে আমি হিন্দু বা তারা মুসলমান। চোখের সামনে দেখতে পাই যে মানুষটি, তাকে শুধু মানুষই মনে হয়। কিন্তু আমাদের সমস্ত সম্প্রীতি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য তো দু’চারজন সাম্প্রদায়িক লোকই যথেষ্ট। প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র কেন এই দু’চারজনকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারে না? পারে না বলেই দু’চারজন সাম্প্রদায়িক লোকের অশুভশক্তি আমাদের সমস্ত শুভবোধকে পরাস্ত করে দেয় আর দিনে দিনে এই অশুভ শক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাদের অশুভবোধ ক্রমাগত শক্তিশালী হয়। আর তাদের আরও শক্তিশালী করে কিছুই না বুঝে-শুনে চিলে কান নিয়ে গেছে বলে দৌড়ানো অবুঝ হুজুগে বাঙালের দল।
আমার শৈশব-কৈশোর আমি কাটিয়েছি সুনামগঞ্জের দুটো অজপাড়া গ্রামে। একটি গ্রামে হিন্দু-মুসলমান ছিল সমান সমান আরেকটি গ্রামে মুসলমান সংখ্যায় বেশি। কিন্তু কোনোদিন আমরা হিন্দু বলে আমাদের একটুও ভয় করেনি। কেন ভয় করেনি? কারণ ভয় দেখানোর মতো কোনো কাজ সেখানে কেউ করেনি। সংখ্যাগুরুর প্রতাপ দেখাতে আসেনি কেউ আমাদের সঙ্গে। সেজন্য আমার সেই দুই গ্রামের কোনো বাসিন্দা দেশত্যাগ করেনি। কিছুদিন আগে আমি ওই দুটি গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গ্রামের মানুষ অনেকেই গ্রামে নেই কিন্তু তার অর্থ এই নয়, অন্য দেশে চলে গেছে। জীবন-জীবিকার জন?্য তারা এদেশেরই বিভিন্ন শহরে বন্দরে স্থানান্তরিত হয়েছে। তবে এ সরল চিত্র সারা দেশের নয়।
আমি এখন যে শহরে থাকি সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরতলীর একটি গ্রাম নাটাই। সেই গ্রামের মেয়ে শামীমা সিকদার দীনা এখন শহরে থাকে। তার বর্ণনা অনুযায়ী জানতে পারি একসময়ে নাটাই গ্রামে অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল। এখন সম্ভবত দু’তিনঘর মানুষ আছে। তাহলে বাকি লোকগুলো কোথায় গেল? দীনাকে চিনি প্রায় পনের বছর ধরে। এই পনের বছর ধরে তার হাহাকার শুনে আসছি এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য। যে মানুষগুলোর অনেকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার মায়াময় শৈশব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অসংখ্য গ্রাম হিন্দুছাড়া হয়েছে। বিজয়নগর উপজেলার মহেশপুর, বিষ্ণুপুর গ্রাম হিন্দুশূন্য। মহেশ মানে শিব এবং বিষ্ণু নারায়ণ বা হিন্দুদের ভগবানের নাম। তা এই গ্রামগুলো যে কোনো এককালে হিন্দুরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার প্রমাণ এই দেবতাদের নামে গ্রামের নাম নিশ্চয়ই কোনো মুসলমান রাখেনি। তাহলে এসব গ্রামের নাম রেখেছিল সেই হিন্দু জনগোষ্ঠী কোথায় হারিয়ে গেল? দু’দিন আগে আমাদের সময় পত্রিকায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই সম্প্রীতির কথা নিয়েই একটি নিবন্ধ লিখেছেন কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা টোকন ঠাকুর। তার আর একটা পরিচয় আছে। তিনি একজন চিত্রশিল্পীও বটে। তার কাছে মানুষের পরিচয় মানুষই। হিন্দু-মুসলমান বা বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নয়।
এক সময়ে মহিলা পরিষদে কাজ করতেন বলে তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি তার লেখায় সেই একই প্রশ্ন তুলেছেন। চেনা জানা মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে যায়? টোকন ঠাকুর বলেছেন ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার ভায়না গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। শৈশব-কৈশোরে তিনি দেখেছেন সেই ভায়না গ্রামের ৮০% জনগোষ্ঠী ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে তিনি দেখেছেন মাত্র আশি পার্সেন্ট জনগোষ্ঠী দুই ঘরে এসে ঠেকেছে। সেই দুই ঘরের মানুষ যাদের একঘরে পেশাগত পরিচয় কামার ও অন্যঘরে নাপিত। সেই গ্রামে তাদের বর্তমান সংখ্যা? যা গুরু মানুষরা তাদের প্রয়োজনে রেখেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন এসব মানুষ কোথায় গেল? কোথায় হারিয়ে গেল তারা!
টোকন এবং দীনা দুজনই সংবেদনশীল মানুষ। তাদের কাছে মানুষের পরিচয় আগে মানুষ অথবা শুধুই মানুষ আর বাকি সব একান্তই নিজের। টোকন শুধু প্রশ্ন করেছেন। নিশ্চয়ই সেসব প্রশ্নের উত্তর তিনি জানেন। আমরাও জানি। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী হওয়া যেসব লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশপ্রেমের টানে, জন্ম ভিটেমাটির টানে এদেশের পোড়া ভিটায় ফিরে এলেন তারা কেন পরে আবার এদেশ ত্যাগ করলেন! শৈশবে যে সম্প্রীতি আমরা দেখেছি তা যদি সারা দেশে বিরাজমান থাকত তবে কি কোটি কোটি হিন্দু দেশত্যাগ করতেন? আমরা এসব জেনেছি ও দেখেছি। কেন এবং কীভাবে, পঁচাত্তরের পর, বিরানব্বই সালে, দু’হাজার একসালে, দু’হাজার চৌদ্দ সালে এদেশের হিন্দুরা দেশত্যাগ করেছে।
আসলে নিজের দেশ মাটি ও বিষয় সম্পদ ফেলে অন্যদেশে কেউ শখ করে যায় না। কুমিল্লা, চৌমুহনীর ঘটনা আরও অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করবে। আমরা এও দেখেছি, এই দেশত্যাগের ফল ভোগ করে একটা শ্রেণি। দিনে দিনে তারা সম্পদশালী হয়েছে। তারাই মদদ দেয় তারাই আক্রমণ করে। সেই ৪৬ সাল থেকে এই অবস্থা চলে আসছে। তার ফলাফল আজ এদেশে হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যালঘু নাকি দশ পার্সেন্টে এসে নেমেছে। একটা সম্প্রদায়ের মানুষের এই পার্সেন্টেজ কমে যাওয়া বা নেমে যাওয়ার সুযোগ যারা নেয় তারাও কিন্তু সংখ্যালঘু। কারণ এখনো এদেশের অধিকাংশ মানুষ সাম্প্রদায়িক নন।
কিন্তু লুটেরা, সন্ত্রাসী ও হামলাকারীরা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও তারা কিন্তু শক্তি প্রদর্শন করে সংখ্যাগুরুর জোরে। কিন্তু এই অধিকাংশ অসাম্প্রদায়িক মানুষ বহু বিভাজিত শিক্ষাব্যবস্থায় বহু মত-পথের হওয়ায় এই লুটেরা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কখনো রুখে দাঁড়ায় না। রুখে যারা দাঁড়ায় তারাও সংখ্যায় কম কিন্তু যাদের হাতে পাওয়ার আছে, আইন আছে তারা সময়ের কাজ সময়ে করে না। যত গর্জে তত বর্ষে না। কোনো অপরাধীর বিচার হয় না বলে রুখে দাঁড়ানো সংখ্যায় কম-রা পেরে ওঠেন না। তাই বছরের পর বছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। বাগাড়ম্বরের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। সংখ্যালঘু আরও সংখ্যালঘু হতেই থাকবে। আর আমরা শুধু মুখে মুখেই সম্প্রীতির সুবাতাস বইয়ে দিতে থাকব!
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : খোলা কাগজ