প্রায়ই শোনা যায় অমুক উপজেলা বাল্যবিবাহমুক্ত। সে খবর একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। কোনো ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি তিনি চেয়ারম্যান-মেম্বার যিনিই হোন, তাঁর এলাকায় বাল্যবিবাহ পরিস্থিতির কথা জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘আরে না না, না না। পেশাগত কাজের অংশ হিসেবে আমাকে প্রতি মাসে মাঠপর্যায়ের কমসে কম ৮টি মাতৃস্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক পরিদর্শন করতে হয়, যেখানে অধিকাংশ সেবাগ্রহীতা গর্ভবতী এবং প্রসব-পরবর্তী সেবা নিতে আসা মা। তাঁদের মাঝে এ সংখ্যাই বেশি যাঁদের বিশ বছরের মধ্যেই তিনটি সন্তান হয়ে গেছে বা দু-তিনটি আছে আবার ক্যারি করছেন। চৌদ্দ-পনেরো বছরের মায়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সেদিন শাপলা নামের এক কিশোরী মাকে দেখলাম। তার সমস্যা জটিল।
শাপলার বয়স চৌদ্দ বা এর চেয়ে একটু বেশি। তার মা বলেছিলেন, গত শাওন মাসের আগের শাওন মাসে শাপলার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি হয়নি। কারণ শাপলার মতো বরের বয়সও কম ছিল। শাপলার ভাইয়েরা বোনের জন্য আঠারো বছরের জন্মসনদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু গোল বাধায় বরের বয়স। তার বয়স আঠারো-উনিশ হলেও জন্মসনদে রয়েছে পনেরো। তাই কাবিন ছাড়াই মোল্লা দিয়ে বিয়ে পড়িয়ে নাবালক শাপলাকে নাবালক বরের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়েছিলেন তারা। এর মাঝে শাপলা গর্ভবতী হয়েছে। তার হৃষ্টপুষ্ট শরীর শুকিয়ে কাঠ এবং গায়ের ফরসা রং তামাটে হয়েছে। শাশুড়ি তাঁর নাবালক পুত্রবধূর কাছে পাকা গিন্নির কর্মদক্ষতা আশা করেন। কাজ না পারলেই বকাঝকা দেন।
তা ছাড়া, হাতে তুলে যে খাবার দেন, তাতে শাপলার পেটও ভরে না। এ অবস্থায় শাপলার মা তাকে নিজের বাড়ি নিয়ে এসেছেন এবং বেয়াল্লিশ দিন আগে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। প্রসবের পর থেকে শাপলার শরীর ভালো না। তার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা। ঠিকমতো খেতে পারে না। ঘুমালে মুখ দিয়ে ফেনা বের হয়। পাড়াপড়শি দাদি-চাচিরা বলছেন, শাপলার ওপর জিন ভর করেছে। তাতে কবিরাজ-কবজ-তাবিজ করেও কোনো কাজ হয়নি। তাই ক্লিনিকে এসেছে। কিশোরী শাপলা নিজের শরীরটাকেই সামলাতে পারে না, বাচ্চাটাকে কী করে সামলায়? ঠিক করে দুধও খাওয়াতে পারে না। বাচ্চাটার ঠান্ডা-কাশি-জ্বর লেগেই আছে। প্রথমে শাপলার মা ক্লিনিকে এসেছিলেন ওষুধ নিতে। ক্লিনিকের সেবিকা বললেন, মাসহ বাচ্চাকে নিয়ে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাপলা এল বাচ্চাকে নিয়ে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই কেমন মায়া লাগে। কী নিষ্পাপ মুখটা! জানা গেল আরও নানান তথ্য। শাপলার শ্বশুরবাড়ি কাছেই। বর সন্ধ্যা হলে শ্বশুরবাড়ি চলে আসে। বরকে শাপলার অপছন্দ নয়। কিন্তু রাতের বেলা বর এলেই তার ভয় হয়। সে উদ্ভট আচরণ করে। মুখে ফেনা আসে। শাপলার মা-ও বিশ্বাস করেন শাপলাকে জিনে ধরেছে। তাই মেয়ের শরীর খারাপ। জিনে ধরা মেয়ের আচরণ নিয়ে উভয় পরিবারের লোক বসেছে দরবারে। শাপলার বরের এখন শ্বশুরবাড়ি আসা নিষেধ।
মেয়েকে অল্প বয়সে বিয়ে দিলেন কেন? জবাবে আছিয়া বেগম বলেন, তাঁর ছেলেরা সিলেটে কাজ করে। পুরুষশূন্য বাড়িতে সোমত্ত সুন্দরী বোনকে রাখতে ভাইদের ভয়। গ্রামের বখাটে ছেলেরা বাড়ির পাশে ঘুরঘুর করে। কী জানি কখন বিপদ হয়, তাই বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চেয়েছিল ভাইয়েরা। কিন্তু এখন যে মেয়ে-নাতিসহ ফেরত এল? শাপলার মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, ‘ম্যাডাম, হের লাইগ্যাই তো মনে শান্তি নাই। মাইয়ারে বাইত আনছি বুইল্যা পোলারাও আমারে কথা শোনায়। হেরার লগে আমার বিরোধ লাগছে।’
শাপলা যখন ক্লিনিকে আসে, তখন আরও দুটি অল্প বয়স্ক মা প্রসব-পরবর্তী সেবা নিতে এসেছিল। তাদের এবং তাদের বাচ্চাদেরও ক্ষীণ শরীর। অপুষ্টিতে ভুগছে মা ও শিশু। কিন্তু শাপলার অবস্থা ছিল করুণ। নার্স তাকে কিছু ওষুধ দিয়ে খাবার সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়ে দেন। নার্সের ভাষ্য, অল্প বয়সে বিয়ে, বাচ্চা এবং শ্বশুরবাড়িতে অনাদর, অবহেলা ও পেটভরা খাবার না পেয়েই তার অবস্থা এত খারাপ হয়েছে।
একজন প্রাপ্তবয়স্ক প্রসূতি মায়ের জন্যও যেখানে স্বাভাবিকের চেয়ে পরিমাণে বেশি পরিমাণ পুষ্টিকর খাবার এবং পরিবারের লোকদের, বিশেষ করে তার জীবনসঙ্গীর যথেষ্ট মনোযোগ, সেবাযত্ন ও ভালোবাসার প্রয়োজন হয়, সেখানে শাপলার মতো কিশোরীরা অনাদর, অবহেলায় দিন কাটায়। পুষ্টি দূরে থাকুক, পায় না পরিমাণমতো খাবার। উল্টো বাচ্চা বহন করার মতো কঠিন কাজের সঙ্গে সংসারের দায়িত্বও তার কাঁধে বর্তায়। অথচ একজন কিশোরীর বাড়ন্ত বয়সে শরীর ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য এমনিতেই পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের দরকার। কিন্তু বাল্যবিবাহের কারণে দেশের ষাট-পঁয়ষট্টি শতাংশ কিশোরীকে শরীর ও বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটার সুযোগ না দিয়ে অকালমাতৃত্ব ও সংসারের নানা ধরনের দায়িত্ব পালনের চাপে পিষ্ট করে নারী জনগোষ্ঠীর বিশাল একটা অংশকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে তার পরিবার। এই পঙ্গুত্ব নারীর ক্ষমতায়নের পথে যে মস্ত বাধা, তা যেমন তাদের পরিবার বোঝে না, সমাজও বোঝে না। এমনকি বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য যাঁদের হাতে ক্ষমতা ও দায়িত্ব আছে, তাঁরাও তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন না। কারণ, তাঁরা মেয়েদের এখনো পূর্ণ মানুষই মনে করেন না। তাই নারীর ক্ষমতায়ন ধারণাটা তাঁরা মানেন না। যদি বুঝতেন, তবে মেয়েদের বিকশিত না করে বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হতেন না।
প্রায়ই শোনা যায় অমুক উপজেলা বাল্যবিবাহমুক্ত। সে খবর একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়। কোনো ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি তিনি চেয়ারম্যান-মেম্বার যিনিই হোন, তাঁর এলাকায় বাল্যবিবাহ পরিস্থিতির কথা জিজ্ঞাসা করলে বলবেন, ‘আরে না না, না না। আমাদের এলাকায় এখন আর বাল্যবিবাহ নেই। বুঝলেন, মানুষ এখন সচেতন হইছে। তাই এখন আর কেউ বাল্যবিবাহ দেয় না।’
সেদিন একজন নারী ও পুরুষ ইউপি সদস্য বললেন, তাঁদের এলাকায় বাল্যবিবাহ নেই। তখন তাঁদের দুজনের এলাকার হাতেনাতে ধরা তিনটি বাল্যবিবাহের তথ্য দেওয়া হলো। মুহূর্তেই মুখ কাঁচুমাচু। ‘আসলে সব খবর কি আমরা নিতে পারি ম্যাডাম? আমরা মেম্বার বলে কি আর লোকজন তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতে জিজ্ঞাসা করে?’
হ্যাঁ, জিজ্ঞাসা করে না। তবে জন্মসনদের জন্য তো আসে? জনপ্রতিনিধিরা বলেন, ‘তা আসে, কিন্তু আমরা সঠিক বয়সের জন্মনিবন্ধনই দিই।’ বয়স কম হলে কাজি সাহেবরা কাবিন ফরম রেজিস্টারের তলায় রেখে মোল্লা দিয়ে বিয়ে পড়ানোর বুদ্ধি দেন। তারপর পাত্রীর বয়স আঠারো হলে রেজিস্টারে তোলেন। কাজি সাহেবরা বলেন, মেম্বার-চেয়ারম্যানরা বা সচিবেরা ব্যক্তিগত পরিচয়ের খাতিরে ও টাকার বিনিময়ে দিয়ে দেন আঠারো বানিয়ে। আর কোর্টে এক জাতের উকিল আছেন, তাঁরা ওকালতি নয়, নোটারি পাবলিকের নামে খালি বিয়ে দেন, মেয়ের বয়স যা-ই হোক না কেন। সে জন্য নোটারি পাবলিকের বিয়ে বন্ধ করা আগে দরকার।
এই পারস্পরিক দোষারোপের ফাঁকতালে গ্রাম-শহর সর্বত্র বাল্যবিবাহ হয়েই যাচ্ছে। করোনা মহামারি বাল্যবিবাহেরও মহামারি নিয়ে এসেছে সঙ্গে করে। কেউ যদি হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি ক্লিনিক বা সেবাকেন্দ্র পরিদর্শনে যান বা দেখতে পাবেন ছোট ছোট মায়েরা সন্তান কোলে দাঁড়িয়ে আছে জবুথবু হয়ে। এদের দেখলে কেবল মায়া হয়। মনে হয় কী অপচয় জীবনের! অথচ এই বয়সী একটি ছেলে, হোক সে শ্রমিক বা দিনমজুর অথবা মধ্যবিত্ত ও বড়লোকের, প্রবল আত্মপ্রত্যয়ে নিজেকে গড়েপিটে নেয় সে, তার নিজস্ব জায়গা বা ভুবন তৈরির জন্য লড়াই করে। এ লড়াই করার প্রত্যয় আমাদের অসংখ্য কিশোরী-তরুণীর মাঝে দেখা যায়। কিন্তু বাল্যবিবাহ তছনছ করে দেয় ওই সব কিশোরীর স্বপ্ন, লড়াই করার শক্তি, সাহস ও আত্মপ্রত্যয়কে। সেই সঙ্গে তছনছ করে দেয় গোটা দেশ, জাতি, সমাজকে। তাই দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে এখনই যে নতুন কর্মকৌশল ঠিক করে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, জাতির সে বোধোদয় কবে ঘটবে?
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : আজকের পত্রিকা