‘বেগম’-এর মতো মুক্তচিন্তার একটি পত্রিকাই শুধু বের করেননি নূরজাহান বেগম, তাঁর সময়ে নারী লেখকদের লেখা প্রকাশ করে শুধু সচেতনতা নয়, অসংখ্য নারী লেখক তৈরি করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সম্পাদনায় ৬০ বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছে বেগম পত্রিকা, ধরে রেখেছে এর ঐতিহ্য। পত্রিকার পাশাপাশি গড়ে তোলেন বেগম ক্লাব, যা একটি বিরল দৃষ্টান্ত। পত্রিকা ও বেগম ক্লাব ঘিরে একটি শক্তিশালী নারী লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে।
১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই কলকাতা থেকে বেগম পত্রিকার প্রকাশ শুরু হয়। প্রথম দিকে নারী লেখকের সংকট থাকলেও ক্রমেই তা কাটতে শুরু করে এবং শুধু লেখকই নন, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও গুণীজনরাও পাশে এসে দাঁড়ান। কলকাতায় থাকাকালে বেগম পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় জননী সাহসিকা, শতাব্দীর বিবেক কবি সুফিয়া কামাল।
দেশভাগের পর সাপ্তাহিক বেগম ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। লেখিকাদের বেশির ভাগই তখন ঢাকায় ফিরতে শুরু করেন। নূরজাহান বেগমের সম্পাদনায় ১৯৫০ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় সাপ্তাহিক বেগমের চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রকাশ ঘটে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ঢাকায় বেগমের নিয়মিত পথচলা।
বেগম পত্রিকা প্রকাশের ঊষালগ্নে তাঁর একান্ত সহযোগী রাজনীতিবিদ, লেখক, সম্পাদক লায়লা সামাদ পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিনোদন পত্রিকা ‘চিত্রিতা’ এবং মেয়েদের জন্য ‘অনন্যা’ নামে একটি প্রগতিশীল পত্রিকা বের করেছিলেন। পত্রিকাটি বেশিদিন স্থায়ী না হলেও স্বল্প সময়ে পাঠকসমাজে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছিল। আধুনিক ও মুক্তচিন্তার পত্রিকা হিসেবে নন্দিত হয়েছিল।
ফওজিয়া সাত্তারের সম্পাদনায় ১৯৬৬ সালে ঢাকার সেগুনবাগিচা থেকে প্রকাশিত হয় মেয়েদের জন্য ‘ললনা’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত এই পত্রিকাটি স্বল্প সময়ে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারণ ও সম্পাদনার ক্ষেত্রে যাঁদের বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁরা হলেন শিল্পী হাশেম খান, সৈয়দ শাহজাহান ও কবি মোহাম্মদ আখতার। কবি মোহাম্মদ আখতার ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক বেগমের পর এই পত্রিকাটি প্রকাশের লক্ষ্য ছিল তরুণীদের সৃষ্টিশীলতাকে কাজে লাগানো, তাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা।
প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ এই পত্রিকায় নিয়মিত কাজ করেছেন। আরো কাজ করেছেন শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। তিনি বিজ্ঞাপন ও লেখা সংগ্রহ করে এই পত্রিকার ভিত মজবুত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। সে সময় এই পত্রিকায় প্রায় নিয়মিত লিখতেন রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, রাবেয়া খাতুন, জাহানারা ইমাম, হেলেনা খান, পূরবী বসু প্রমুখ। ‘ললনা’ পত্রিকার চিঠিপত্রের পাতাটি ছিল দারুণ সমৃদ্ধ। উত্তর আপা ছদ্মনামে এর উত্তর দিতেন প্রখ্যাত সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী।
শহীদ সেলিনা পারভীন যখন সম্পাদনার কাজে যুক্ত হন, তখন নূরজাহান বেগম ও লায়লা সামাদ ছাড়া সম্পাদনায় আর কোনো বাঙালি নারী ছিলেন না। বাম চিন্তাধারার ধারক সেলিনা পারভীনের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল ‘শিলালিপি’র মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ করা। তিনি হেঁটে হেঁটে লেখা ও অর্থের জোগাড় করে বহু কষ্টে এই পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১৯৬৯ সালে স্বাধীনতার সপক্ষে পত্রিকা বের করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের টার্গেট হন সেলিনা পারভীন এবং ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ঘাতকদের হাতে শহীদ হন। ১৯৬৭ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন শিলালিপি পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা গীতি আরা সাফিয়াও একসময় পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৪ সালে ‘অবজারভার’ পত্রিকায় সানডে সেকশনে তিনি সাংবাদিকতা করতেন। করাচি থেকে প্রকাশিত নারী পত্রিকা ‘সি’ ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি দক্ষতার সঙ্গে।
পঞ্চাশের দশকে কবি জাহানারা আরজুর সম্পাদনায় ‘দিলরুবা’ এবং কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের সম্পাদনায় ‘অঙ্গনা’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৯১ সালে ঢাকা থেকে নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ ও রাখী দাশ পুরকায়স্থর সুযোগ্য সম্পাদনায় ‘চিহ্ন’ নামে নারী বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে মুক্তচিন্তার একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত চলে।
১৯৮৮ সালের ১৫ অক্টোবর তাসমিমা হোসেনের সুযোগ্য সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো পাক্ষিক অনন্যার সূচনা সংখ্যা। নারীদের একান্ত নিজেদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে প্রয়োজন ছিল একটি আধুনিক, মননশীল, প্রগতিশীল পত্রিকার। সে চিন্তা থেকেই অনন্যার এই যাত্রা। একটানা ২৬ বছর ধরে চলছে অনন্যার এই নিরলস পথচলা।
এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সরকারি ও আন্তর্জাতিক নীতি, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, সমাজব্যবস্থার অসংগতি, সামাজিক কুসংস্কার, শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা, ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি, নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা এবং এর বিরুদ্ধে নারীর লড়াই ও নারীর ক্ষমতায়নের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে নারীদের উৎসাহিত করাই ছিল অনন্যার লক্ষ্য।
অনন্যা শুধু পত্রিকা হিসেবেই নয়, আলাদা করে একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেয়েছে। অনন্যা সাহিত্য পুরস্কারের মধ্য দিয়ে দেশের জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সম্মানিত করা হয়। অনন্যা সাহিত্য ও শীর্ষদশ পুরস্কার ধারাবাহিকভাবে নিয়মিত প্রদান করা হচ্ছে। আমি ২৫ বছর এই কার্যক্রমের অংশীদার ছিলাম, সেটা আমার গর্ব ও অহংকার।
লেখক : সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ