বাসে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ার প্রতিবাদ করায় কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেয় বাস কন্ডাক্টর। জমি নিয়ে বিরোধ অথবা রাজনৈতিক বিবাদে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য ঘটে সেই পরিবারের নারীর ওপর নির্যাতন। কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুরুষ তার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করতে না পারলে নির্যাতন করে সেই নারীকে। এলাকার কিশোর গ্যাং মায়ের বয়সী নারীকে করেছে গণধর্ষণ।
এমন পীড়ন থেকে বাদ পড়ছে না কন্যা ও শিশুরা। ২০২১-এর অক্টোবর পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩১২৮টি। এর মধ্যে ধর্ষণ ৮৯০টি, গণধর্ষণ ১৫৯টি, ধর্ষণের পর হত্যা ২৯টি, ধর্ষণের চেষ্টা ১৩৮টি, ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা ৭টি (তথ্যসূত্র : বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ)। রিপোর্টে ৩৭ ধরনের নারী নির্যাতনের ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বর্বর জঘন্য নির্যাতন-ধর্ষণের তথ্য এখানে উল্লেখ করা হলো। এই হচ্ছে নারী নির্যাতনের সামান্য পরিচয়, যা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে।
নির্যাতনের কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে নারী হওয়ার কারণে সে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সমাজে জেন্ডার অসমতা নারী-পুরুষকে ভিন্নভাবে মূল্যায়িত করছে। তাদের সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, অধিকার, মর্যাদায়ও রয়েছে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে পুরুষ ক্ষমতাবান, নারী ক্ষমতাহীন অধস্তন। সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নারীর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা বিস্মিত হই যখন দেখি আদালতের পর্যবেক্ষণে একজন নারী বিচারক ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের অভিযোগের মামলা গ্রহণ না করতে পুলিশকে পরামর্শ দেন। বিচারক যখন বলেন, অভিযোগকারী নারী যৌনসংসর্গে অভ্যস্ত তখন কার্যত বলা হয়, যদি কোনো নারী যৌনসংসর্গে অভ্যস্ত হয় তাকে ধর্ষণ করা জায়েজ। তখন স্পষ্টই বোঝা যায়, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কি প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল সমাজের সর্বক্ষেত্রে!
উপরোক্ত বাস্তবতার পাশাপাশি আমরা দেখি ২০১৮ সালে মহামান্য হাইকোর্ট প্রদত্ত ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার নারীর বিচারপ্রাপ্তি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনায় বলা হয়—ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ এ ধরনের অপরাধের ঘটনায় থানার ওসি কোনো বৈষম্য ছাড়াই তাত্ক্ষণিক ঘটনার স্থান উল্লেখপূর্বক অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবেন। নির্যাতনের শিকার নারীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও গাফিলতি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। দ্রুততম সময়ে তদন্ত সম্পন্ন করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে ধর্ষণের বিচারের ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি—ধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন নিষিদ্ধ করে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের বিধান পরিবর্তন করতে হবে এবং ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণকারীকে প্রমাণ করতে হবে সে ধর্ষণ করেনি।
২০০১ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ফতোয়া নিষিদ্ধ করে নির্দেশনামূলক রায় ঘোষণা করেছেন। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ফতোয়া কার্যকরের নামে বিচারবহির্ভূত শাস্তি দেওয়াকে বেআইনি ঘোষণা করে রায় প্রদান করেছেন। ২০০৯ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন রোধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৮ সালে ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারি পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘দ্বি-আঙুল পরীক্ষা’ (Two finger test)অবৈধ ঘোষণা করে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ রায় দিয়েছেন। ২০১০ সালে পারিবারিক সহিংসতা (সুরক্ষা) আইনের মতো অগ্রগামী আইন প্রণীত হয়েছে। ২০২০ সালে খুলনায় হিন্দু পরিবারের সম্পত্তি নিয়ে করা এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু বিধবার কৃষি-অকৃষি উভয় প্রকার সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে বলে হাইকোর্ট রায় প্রদান করেছেন।
এত কিছুর পরও দেখা যায়, নারী ও কন্যা হওয়ার কারণে তারা নিয়ত বহুমুখী সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিজীবনে নারীর অধিকারহীনতা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও নারী পূর্ণ নাগরিক হিসেবে তার সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব নারী এই অধিকারহীনতার শিকার। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’, ২৮(২) বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম বর্ণ বা নারী-পুরুষের জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। ’ ২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম-অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যমূলক সব আইন বাতিল হবে এবং রাষ্ট্র অসামঞ্জস্যমূলক কোনো আইন প্রণয়ন করবে না।
সংবিধানের এই মৌলিক ধারণার পরিপন্থী ও সাংঘর্ষিক হচ্ছে প্রচলিত ধর্মভিত্তিক ‘পারসোনাল ল’। এই পারসোনাল ল ধর্মের ভিত্তিতে নারীর বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে, যা নাগরিক হিসেবে মৌলিক অধিকার লাভের পরিপন্থী। এই পারিবারিক আইন রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মভিত্তিক বিভাজন আনছে, যা শুধু নারী-পুরুষ নয়, নারীতে নারীতে বিভাজন সৃষ্টি করছে। পারিবারিক আইনে বিভাজন থাকার কারণে একই দেশের নাগরিক সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। এটা সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণাপত্র ও সিডও সনদের পরিপন্থী।
নারীর ন্যায্য অধিকার লাভের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিভাজন ও বৈষম্য দূর করে সংবিধানের আলোকে সব নাগরিকের সম-অধিকারের প্রশ্নটি আজ সামনে আসছে জরুরিভাবে, যা নারীর প্রতি সংহিসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত। নারীর ওপর নির্যাতন যে নিছক নারী ইস্যু নয়—মানবাধিকার ইস্যু, জেন্ডার সমতার ইস্যু, তা উপলব্ধি করতে হবে। জনজীবন ও ব্যক্তিজীবনের সব ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠিত না হলে নারীর নাগরিক অধিকার তথা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। সেই কারণে আজ জরুরি হয়ে উঠেছে অভিন্ন পারিবারিক আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ১৯৯৩ সাল থেকে বৈষম্যপূর্ণ পারিবারিক আইন নিয়ে মাঠ পর্যায়ের নারী-পুরুষের বক্তব্য, আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত, সমাজবিজ্ঞানীসহ নাগরিক সমাজের মতামতের ভিত্তিতে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’-এর খসড়া প্রণয়ন করে। খসড়া প্রণয়ন করেন সর্বজনশ্রদ্ধেয় বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্য্য, বিচারপতি কে এম সোবহান, বিচারপতি কামালুদ্দীন আহমেদ, অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। এই খসড়া সরকারের কাছে জমা দেওয়াও হয়েছে, জাতিসংঘ সিডও কমিটি যা বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সম-অধিকারের প্রশ্নটি ন্যায্যতার সঙ্গে যুক্ত। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে তিনি নির্দেশনা দিয়েছেন। নারী আন্দোলন মনে করে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জেন্ডার সমতা আনয়নের ক্ষেত্রে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ গ্রহণ বিশেষ শক্তি জোগাবে। সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে আইনের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সমাজ ও জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনের সংজ্ঞা নির্ধারণ, আইন সংস্কার, নতুন আইন প্রণয়ন সব সময় হয়ে এসেছে। আজকে বাংলাদেশের নারীর সামগ্রিক অবস্থানের সঙ্গে সংগতি রেখে তার অগ্রগতি, বিকাশের পথে বাধা দূর, ন্যায্য অধিকার পাওয়া, সর্বোপরি মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হলে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অঙ্গীকার আজ সময়ের দাবি।
আজ ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ শুরু, শেষ হবে ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে। ১৯৯১ সালে জাতিসংঘ এই দিনটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে, যার সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০ সালে ডমিনিক্যান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তিন বোনের বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষে স্লোগান গ্রহণ করেছে—‘নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করো, সম-অধিকার নিশ্চিত করো’। আজকের দিনে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের দাবি—বৈষম্যপূর্ণ আইন বাতিল করে ‘অভিন্ন পারিবারিক আইন’ গ্রহণ করে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করা হোক।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ