‘নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক, পুষ্প বিকাশের প্রয়োজনে’, কবি সুফিয়া কামাল রচিত কবিতার এই পঙ্ক্তি আমাদের বারবার স্মরণ করতে হয়। প্রকৃত অর্থে সুফিয়া কামাল জীবনব্যাপী এই ফুল ফোটানোর কাজে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। তিনি ভূষিত হয়েছেন জননী সাহসিকা, সমাজের বিবেক ইত্যাদি উপাধিতে। রোকেয়া সাখাওয়াত তাঁকে বলতেন ফুলকবি, তিনি ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বোন, নজরুল ছিলেন তাঁর কবি দাদু, জন্মদিনে পাঠানো তাঁর কবিতা পড়ে আশীর্বাদসূচক কবিতা লিখে পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
এ সবই সুফিয়া কামাল অর্জন করেছিলেন, ভাগ্যক্রমে পাওয়া নয়।
আজীবন নানা কর্মের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় তিনি স্বদেশিদের সঙ্গে বরিশালে চরকা কেটেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলায় গড়ে ওঠা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কাজের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। তারপর একাদিক্রমে চলেছে তাঁর নানামুখী কর্মসাধনা।
পাকিস্তান আমলে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে তাঁর কর্মযজ্ঞের বিশালতা তাঁকে ভূষিত করেছে নানা উপাধিতে।
বাঙালির আত্মবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে বহুমুখী আন্দোলনে তিনি যুক্ত ছিলেন। অভিজাত পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন; কিন্তু নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁকে পথ অতিক্রম করতে হয়েছে। বাবা ধর্মের আকুলতা নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন তাঁর একেবারে বাল্যে। মামার বাড়িতে তিনি বড় হয়েছেন, জীবনের পাঠশালায় পাঠ গ্রহণ করে তিনি হয়েছেন স্বশিক্ষিতা। বাল্যকালে রোকেয়ার সান্নিধ্য তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল। পরবর্তী জীবনে রোকেয়া ছিল তাঁর আদর্শ। তাঁর ‘একাল আমাদের কাল’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘উনার আদর্শ তো আমার জীবনের সাথে একেবারে লেপটে গেছে। ’
সুফিয়া কামালের কোমল অথচ দৃঢ় সংবেদনশীল মন-মানসিকতা তাঁকে সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যুক্ত করেছে। বাংলাদেশের সব সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তিনি রাজনীতি করতেন না; কিন্তু তাঁর ছিল নিজস্ব রাজনীতি, মানবতাবাদ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা। এই কারণে তিনি চেতনায় ধারণ করতে পেরেছিলেন সমগ্র সমাজ। আশির দশকে তিনি প্রথম বলেন, নারীর অধিকার মানবাধিকার। এখন আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘ এই স্লোগান গ্রহণ করেছে। আজকে বলা হচ্ছে ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘন। ’ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তাঁকে বলেছিলেন, কেবল নিজের মুক্তি খোঁজাই যথেষ্ট নয়, কাজ করতে হবে সমাজের মুক্তির জন্য। এটাই ছিল সুফিয়া কামালের জীবনের মন্ত্র।
তিনি মনে করতেন, মানবাধিকারের সঙ্গে সংস্কৃতি বিকাশের কার্যক্রমের যোগসূত্র রয়েছে। দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ছিল তাঁর ব্যাপক ভূমিকা। পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রবিরোধী তথা বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী যে অবস্থান, তা বাঙালি জাতির ভাষা-সংস্কৃতির বিপরীতে সাম্প্রদায়িক কূপমণ্ডূক ধর্মীয় জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। পাকিস্তান সরকারের দমননীতি বাঙালি জাতিসত্তা ও স্বকীয়তার ওপর আঘাত হানে; যার বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি প্রতিরোধ সংগঠিত করে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সুফিয়া কামাল পালন করেছেন ধাত্রী ও লালনকারীর ভূমিকা।
আইয়ুবের সামরিক শাসনের সময় যখন বাঙালির জাতীয়তা ও সংস্কৃতিকে অস্বীকৃতি জানানো হচ্ছে, এমন একটি সামাজিক অবস্থায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়। সরকারি বাধানিষেধের মুখে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালন ছিল সংস্কৃতি সমাজের প্রতিবাদী কার্যক্রম। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে এটি ছিল রাজনৈতিক কার্যক্রম। এই কর্মসূচি পালনে অন্যতম পুরোধা ছিলেন সুফিয়া কামাল। সেই সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডূকতার যুগে প্রতিষ্ঠিত হয় সুস্থ মননশীল সংস্কৃতিচর্চার প্রতিষ্ঠান ছায়ানট; যার সভাপতি ছিলেন সুফিয়া কামাল। একদিকে নিজস্ব লেখনী দিয়ে মুক্তির চেতনাসহ সাহিত্যচর্চায় অবদান রেখেছেন তিনি; পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতি-চেতনা বিকাশে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত নারী ও শিশুর অধিকার তাঁর কর্মকাণ্ডে সব সময় প্রাধান্য পেয়েছে। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত সুফিয়া কামাল নারীর অধিকারের প্রশ্নে ছিলেন অনমনীয়। মহিলা পরিষদের মতো একটি অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন গণনারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এই দায়িত্ব তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন তত দিন পালন করে গেছেন। নারীর অধিকারকে তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করে বলেছেন, নারীর অধিকার কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা দেশ ও সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি নারীর অধিকারকে দেখেন একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিনি সব সময় বলতেন, ‘মহিলা পরিষদের সব সদস্যকে হতে হবে এক একটি মহিলা পরিষদ। ’ অর্থাৎ প্রত্যেক নারীকে নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং নিজের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সংগ্রাম করতে হবে। তাঁরই অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় নির্যাতনের শিকার নারীর সাময়িক আশ্রয়কেন্দ্র ‘রোকেয়া সদন’-এ যেন রোকেয়ার স্বপ্নের তারিণী ভবনের আরেক রূপ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারী আন্দোলন সংস্কারমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে অধিকারভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নতুন ধারার নারী আন্দোলন গড়ে তোলার যে প্রয়াস তার নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল। মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আজকে অমর্ত্য সেন বলছেন, ‘নারী উন্নয়নের লক্ষ্য নয়, উন্নয়নের বাহক। ’ অর্থাৎ নারীর জন্য উন্নয়ন নয়, নারী উন্নয়ন সৃষ্টিকারী। মহিলা পরিষদের জন্ম এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে।
নারীসমাজকে সচেতন ও সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে যেমন সুফিয়া কামাল নেতৃত্ব দিয়েছেন, পাশাপাশি মানবিক অধিকারের দাবিতে রাজপথের মিছিলে ছিল তাঁর দৃপ্ত পদচারণ। আজকে যখন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সরব ভূমিকা বিদ্যমান তখনো আমরা দেখি নারী ও কন্যাশিশু নৃশংসভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, বহু ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটছে পরিবারের ভেতরে, তখন সুফিয়া কামালের অভাব গভীরভাবে অনুভূত হয়।
নারী নির্যাতন ও সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে সমাজের বিবেক জাগ্রত করো-এই দাবি নিয়ে আশির দশকে সমাজের সব শ্রেণির নারী-পুরুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার নেতৃত্বে ছিলেন সুফিয়া কামাল।
আজকের দিনে নারীমুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বৈশ্বিক নারী আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এই ধারণায় বিশ্বাসী মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের চেতনা ও কর্মসূচি সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত করার প্রয়াস গ্রহণ করছে। সেখানেও ছিল সুফিয়া কামালের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অগ্রবর্তী চিন্তাচেতনা। তিনি যেমন দেশের ভেতর সমাদৃত হয়েছেন, তেমনি দেশের বাইরেও সম্মানিত হয়েছেন বাংলাদেশের নারী জাগরণ ও নারী আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে।
সুফিয়া কামালের ব্যক্তিত্ব ছিল ঋজু; কিন্তু নমনীয়, দৃঢ় ও সংবেদনশীল। তিনি সেই তরুণীকাল থেকে সমাজের কাজ শুরু করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই কাজ করে গেছেন। এর মধ্যে সমাজের নানা পরিবর্তন হয়েছে, যুগের পরিবর্তন হয়েছে, জীবনের চাহিদায় পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনময়তায় নতুনকে গ্রহণ করার মতো অগ্রসর চেতনার অধিকারী ছিলেন সুফিয়া কামাল।
দীর্ঘ জীবনে অনেক বিশিষ্টজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে, তাঁদের সান্নিধ্য পেয়েছেন, একই সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে জীবন, সমাজ ও দেশ বিষয়ে যে পাঠ তিনি নিয়েছেন তা তিনি পরিপূর্ণভাবে আত্মস্থ করেছেন এবং নিজের বৃহত্তর জীবনবোধের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। তাঁর কর্মে তিনি এর প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছেন। তিনি হয়েছেন সমাজের বিবেক।
সুফিয়া কামালের প্রিয় গান ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনই লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব’। রবীন্দ্রনাথের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে তাঁকে, ব্যক্তিজীবনে কঠিন বেদনার আঘাত সইতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর প্রিয় গানের মতো জীবনে সঞ্চয়ের নতুন দিকগুলো গ্রহণ করেছেন এবং নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে মানবিকতার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। যথার্থ মানুষ হওয়ার সাধনার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কিভাবে সামাজিক শক্তিতে পরিণত হয় কবি সুফিয়া কামাল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সত্য, কল্যাণ ও ন্যায়বোধের প্রতি বিশ্বস্ততা থেকে গড়ে উঠেছিল তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে তাঁর সব কর্ম ছিল একসূত্রে গাঁথা।
সুফিয়া কামাল আজীবন সমাজের আত্মশক্তি বিকাশে কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন সমগ্র মানবী। তাঁর সুদীর্ঘ জীবন ও কাজের খতিয়ান গ্রহণ করলে আমরা সেটাই দেখতে পাব। সমাজ সচেতনতা ও সংগঠিত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সামাজিক শক্তিই যে আসলে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে সেটি তিনি বিশ্বাস করতেন এবং তাঁর সব কর্মধারা সেভাবেই প্রবাহিত হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ও স্বকীয়তার জন্য যেমন তাঁর আন্দোলন ছিল, তেমনি তিনি নিজেও ছিলেন একজন পরিপূর্ণ বাঙালি ও পরিপূর্ণ মানুষ।
ফুল ফোটানোর সাধনা করেছেন সুফিয়া কামাল। তিনি চেয়েছিলেন সব মানুষ যেন ফুলের মতো বিকশিত করতে পারে তাদের জীবন। তিনি এও জানতেন নানা বাধাবিঘ্ন, শোষণ-পীড়ন, অধিকারহীনতা মানুষকে পদে পদে বঞ্চিত রাখে জীবন বিকাশের সুযোগ থেকে। তিনি তাই ছিলেন শৃঙ্খলিত, পশ্চাৎপদ নারীসমাজের মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত। একই সঙ্গে নারীমুক্তির সঙ্গে গোটা সমাজের মুক্তির প্রশ্ন তিনি মিলিয়ে নিতে পেরেছিলেন। আর তাই মুক্তি সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করে তিনি আপন জীবন পুষ্পিত করে তুলেছিলেন। সবার জীবনে বয়ে এনেছিলেন প্রেরণা, সাহস ও শক্তি। এখানেই সুফিয়া কামালের সার্থকতা।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ