বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ একটি স্বেচ্ছাসেবী জাতীয়ভিত্তিক গণনারী সংগঠন। এ সংগঠন পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর মর্যাদা ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত পাঁচ দশকের বেশি সময়ব্যাপী আন্দোলন-সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
১৯৬৯ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের সময়কালে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলন, নারী আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলনের কর্মী-সংগঠকরা মিলিত হয়ে এ সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন।
১৯৭০ সালে ৪ এপ্রিল মানবতাবাদী কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে বিভিন্ন প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক, নারীমুক্তি সংগঠন ও ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতায় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের জন্ম হয়। এ সংগঠনের মূল প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্ত স্বদেশে পুনরায় সংগঠিত হয়ে ১৯৭২ সালে প্রথম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
পশ্চাৎপদ কুসংস্কারচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে মুক্ত হয়ে একটি গণতান্ত্রিক, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, সমতাভিত্তিক পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য নিয়ে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা এবং নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পথচলা শুরু।
নারী-পুরুষের সমতা ও সুবিধাবঞ্চিত সব জনগোষ্ঠীসহ সব নাগরিকের সমান মর্যাদা ও অধিকারের নিশ্চয়তার প্রতিফলন ঘটে ’৭২-এ রচিত সংবিধানে। এ দেশের নারী সমাজকে তার বৈষম্যমূলক অবস্থান এবং সাংবিধানিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দেশব্যাপী কার্যক্রম শুরু করে।
শুরু থেকে আজ পর্যন্ত লক্ষাধিক নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবায় উদ্বুদ্ধ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারীদের নিরলস ধারাবাহিক পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর অধিকার আদায়ের সংগঠন হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে।
সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে থেকে সুস্পষ্ট আদর্শ-লক্ষ্য সামনে রেখে সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে ৮৩ জন সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি, দেশের ৫৭টি জেলা (৩টি সাংগঠনিক জেলা), ২৩৫০টি তৃণমূল শাখার মাধ্যমে সংগঠনের কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবী নারী সংগঠনের অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় এ পথচলার ইতিহাস এ দেশের নারী সমাজের অবস্থানের উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যাত্রার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত দৃষ্টি ফেরালে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এ সংগ্রাম উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করেছে।
সেই সময়ে মূলত ঘরের চার দেওয়ালে আবদ্ধ শুধু গৃহকর্ম এবং যৌন প্রজনন ভূমিকায় অংশগ্রহণকারী নারী আজ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কর্মকাণ্ডে উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান।
নারী অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছেন, দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে দেশকে অগ্রসর করে নিয়ে যাচ্ছেন। দুর্যোগ মোকাবিলা থেকে শুরু করে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ, খেলাধুলায় অংশগ্রহণ সব ক্ষেত্রেই নারীরা আজ দৃশ্যমান। প্রশাসনের সব পর্যায়ে, সব পেশায় (প্রথাগত-ব্যতিক্রমী) নারীরা যোগ্যতা, দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনের সব শাখায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি (দেশে-বিদেশে) সীমিত হলেও আজ দৃশ্যমান।
মাঠপর্যায়েও নারীরা দক্ষ প্রশাসক হিসাবে কাজ করছেন। দেশে-বিদেশে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিকাজ, তৈরি পোশাকশিল্প, নির্মাণশিল্পসহ বিভিন্ন পেশায় কর্মরত নারী দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। ক্ষুদ্র্র, মাঝারি উদ্যোক্তা হিসাবেও নারীরা আজ সফল। রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নারীর অংশগ্রহণ উল্লেযোগ্য।
ক্রীড়াঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নারীরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রথাগত গণ্ডি থেকে বের হয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।
সব ক্ষেত্রেই এ অগ্রগতি নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে; যা কিনা সংগঠনকে তার লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। এসব উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মতো একটি সংগঠনসহ নিরলস ধারাবাহিক নারী আন্দোলন। যার সঙ্গে আবশ্যিকভাবে যুক্ত হয়েছে জাতীয় ও বৈশ্বিক নানাবিধ উদ্যোগ।
এতসব সাফল্য ও সম্ভাবনার পাশাপাশি আজও যেসব ক্ষেত্রে নারীর সমতা, মর্যাদা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়, তা অতিক্রম করাই বর্তমান সময়ের নারী আন্দোলনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এজন্য বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নিজেকে সময়োপযোগী করে প্রস্তুত করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে।
শুরু থেকেই নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতাকে নারীর উন্নয়নের পথে, নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বাধা হিসাবে সংগঠন চিহ্নিত করে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার কাঠামোতে অধস্তন অবস্থান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিতির কারণে নারী নানাভাবেই সহিংসতার শিকার হয়ে থাকে। মহিলা পরিষদ জন্মলগ্ন থেকেই সামাজিক কুসংস্কার প্রথা, নারীর প্রতি ক্ষতিকর এবং মর্যাদাহীন আচার-আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে। দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, আইনবহির্ভূত তালাক প্রদান, ধর্মীয় বা সামাজিক সালিশের মাধ্যমে ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতন-এ সবকিছুকেই নারীর প্রতি সহিংসতা হিসাবে চিহ্নিত করে এবং তা প্রতিরোধে বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনা করে।
আশির দশকে এবং এর পরবর্তী সময়ে দেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের হার ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র স্বামী কর্তৃক গৃহবধূ সালেহা হত্যা, কিশোরী শবমেহেরকে পতিতালয়ে বিক্রি এবং পতিতাবৃত্তিতে অস্বীকৃতি জানালে নির্মমভাবে হত্যা, কিশোরী মনুবালাকে ধর্ষণ, সমাজে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য পরিবারের বিপথগামী সন্তান কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, মৌলভীবাজারের ছাতকচড়ায় ফতোয়ার মাধ্যমে নূরজাহানকে পাথর ছুড়ে হত্যা, দিনাজপুরে পুলিশ সদস্যদের দ্বারা ইয়াসমিন ধর্ষণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, হত্যা, এসিড সন্ত্রাস, যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে সংগঠন। জনমত গঠন, গণমাধ্যমের সহায়তা গ্রহণ, আইন সংস্কার আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন, আইনগত ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান, সংগঠন পরিচালিত ‘রোকেয়া সদন’ সাময়িক নিরাপদ আশ্রয় প্রদান, সরকারি-বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অ্যাডভোকেসি লবিসহ বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের আন্দোলন এখন পর্যন্ত সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রধান কর্মসূচি। কারণ, পরবর্তী সময়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার ধরন ও মাত্রা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
আইন সংস্কার আন্দোলন নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে সংগঠন আশির দশক থেকে আইন সংস্কারের আন্দোলনে কাজ শুরু করে। যার ফলে সহিংসতার শিকার নারীর প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়েছে। যদিও এসব আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বেশিরভাগ নারী তার সুফল ভোগ করতে পারছেন না। সব ধরনের প্রভাবমুক্ত হয়ে সব নারীর জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে জেন্ডার সংবেদনশীল বিচার বিভাগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংস্কারের দাবিতে সংগঠন আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপের দলিল সিডো সনদসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদগুলোর পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন, বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার আন্দোলন করছে।
নারীর স্বার্থে উল্লেখযোগ্য নীতি, কর্মসূচি গৃহীত হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন (বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার, দত্তকের ক্ষেত্রে) পরিবারে, সমাজে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার অন্যতম মূল কারণ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমতা, মর্যাদা ও মানবাধিকারের দৃষ্টিসম্পন্ন আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কারিকুলাম অনুসরণ না করা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে নারী নেতৃত্বের অপ্রতুল অন্তর্ভুক্তি, গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে, ধর্মীয় সমাবেশে নির্বিঘ্নে নারীবিদ্বেষী অবাধ প্রচার-প্রচারণা, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির অপতৎপরতা, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার অভাব, নারীর মজুরিবিহীন কাজের স্বীকৃতির অভাব, সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি যথাযথ দৃষ্টি না দেওয়া নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
নারীর সচেতনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে আজকের বাংলাদেশের নারীদের সামনে যে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে, তার যথাযথ ব্যবহারের পাশাপাশি যেসব চ্যালেঞ্জ অব্যাহত আছে তা মোকাবিলা করতে তরুণ প্রজন্মের নারীদের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে হবে। অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে বৈষম্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাহলেই সম্ভব হবে সংগঠনের গত অর্ধশতাব্দীব্যাপী আন্দোলনের সফলতাকে ধরে রাখা এবং আরও অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়া। নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণে নারীর অধিকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
মালেকা বানু : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর