বিশ্বব্যাপী বৈষম্য, বঞ্চনা-অন্যায্যতার শিকার নারী সমাজের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশের মাইলফলক আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঘোষণা এসেছিল ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারীদের সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিনের প্রস্তাবে। ১৯১১ সাল থেকে বিভিন্ন দেশে এ দিবসটি প্রথম পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘের ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ে সব সদস্য রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করে আসছে। এ দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা একে অপরের কাছাকাছি এসেছে। একে অপরের দাবিতে একাত্ম হয়ে নারী অধিকারের পক্ষে বৈষম্যের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কণ্ঠে আওয়াজ তুলেছে।
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। নারীর স্বার্থে অনেক নীতি, আইন, ব্যবস্থা চালু হয়েছে। নারী সমাজ দেশে দেশে তার অবস্থানের উন্নয়ন ঘটিয়েছে; কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ঐক্যবদ্ধ বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা, এ দিবস পালনের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। কেননা, প্রকৃত অর্থে নারীরা এখন পর্যন্ত বৈষম্য, বঞ্চনা, অধিকারহীনতার শিকার হয়ে দিন কাটাচ্ছে। যে দর্শন, যে দৃষ্টিভঙ্গি, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা নারীকে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসাবে বিবেচনা করে না, মর্যাদা দেয় না, মানবাধিকারের স্বীকৃতি দেয় না, সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি।
এ কথা বাস্তব সত্য, একদিকে নারী হিসাবে যেমন সব নারীই বৈষম্যের শিকার, অপরদিকে বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক নারী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি সত্য। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সামগ্রিক বৈশ্বিক উন্নয়নের সূচকে। দীর্ঘ ধারাবাহিক নারী আন্দোলন তাই সামগ্রিক বৈশ্বিক, মূল ধারার উন্নয়ন কর্মসূচিতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য-আজকের জেন্ডার সমতাই পারবে আগামীকে টেকসই করতে। আমরা জানি, নানাভাবেই আমাদের এ চিরচেনা পৃথিবী এবং মানবসমাজের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। তার মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় হলো জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, যা আমাদের আগামীকে বিপন্ন করে তুলেছে। ইতোমধ্যেই আমরা সেসব নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি। বিশ্বের এক প্রান্তের এক শ্রেণির মানুষের ভোগবিলাস, উন্নয়ন ধারণা অন্য প্রান্তের মানুষকে বিপন্ন করে তুলেছে। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ জলবায়ুকে অস্থির করে তুলেছে। বরফ গলে যাচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঝড়-বন্যা, অগ্নিকাণ্ডসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনপদ, বনভূমি সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে।
আমরা জানি, সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা যার মধ্যে আছে গ্রামীণ নারী, কৃষক, আদিবাসী নারী, নানাভাবে প্রকৃতিকে সযত্নে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। প্রকৃতির কাছাকাছি তাদের অবস্থান, প্রকৃতির ভালো-মন্দ তারা অনুভব করেন। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নারীদের জীবনকে তুলনামূলকভাবে অতিরিক্ত মাত্রায় বিপন্ন করে তোলে। আজকের বিশ্ব সম্প্রদায় যখন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ভবিষ্যৎকে নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও উদ্বিগ্ন, তখন বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি প্রকটভাবে সামনে চলে আসছে। কেননা সম্পদ-সম্পত্তি, ভূমির অধিকারের পাশাপাশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা বঞ্চিত। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের মোকাবিলায় যখন পরিকল্পনা প্রণীত হচ্ছে, তখন প্রকৃতি সংরক্ষণে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় নারী সমাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এ পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে অন্তর্ভুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
সময়ের বিবর্তনে আজকের নারী আন্দোলন শুধু নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নারী আন্দোলন আজ অনেক বেশি ব্যাপকতা লাভ করেছে। নারী আন্দোলন আজ সার্বজনীন মানবাধিকার আন্দোলনের সমার্থক। যেখানে যুক্ত হয়েছে বিশ্বের সব প্রান্তের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, যার মধ্যে রয়েছে আদিবাসী, দলিত, হরিজন, অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘু, প্রতিবন্ধী, ভিন্ন লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষ-উন্নয়ন পরিকল্পনার বাইরে যাদের অবস্থান। আজকের নারী আন্দোলন শুধু নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। নারী আন্দোলন আজ সামগ্রিক, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনার রূপকার এবং চালিকাশক্তি। আজকের নারী আন্দোলন সমান অংশীদারত্বের ভিত্তিতে সব মানুষের জন্য আগামী দিনের একটি স্থায়িত্বশীল বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ার আন্দোলন। যে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়, গ্রহণ করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন পরিকল্পনা।
বিগত দিনগুলোর মতো যদি এবারও আমরা শুধু মানুষে মানুষে বৈষম্য হ্রাসে কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকি, তাহলে এ পরিকল্পনা পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত হবে না। নারী এবং সব মানুষ যদি মানবাধিকার এবং মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী না হই, প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করি, যার মধ্যে পড়ে নারীর সম্পদ-সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার, সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, প্রতিনিধিত্ব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিশ্চয়তা। তাহলে নারীরা পিছিয়েই থাকবে। লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্তরায় চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি।
১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন নারীর চোখে বিশ্ব দেখার যে আহ্বান জানিয়েছিল, সেখান থেকে নারী আন্দোলন ক্রমেই তা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হতে যাচ্ছে নারী আন্দোলনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার নির্যাস নিয়ে, ‘নারী-পুরুষের সমতাই হবে টেকসই আগামীর নিশ্চয়তা’। এ আগামী শুধু নারীর নয়, সমগ্র মানবসমাজের, এ বিশ্বের, সুতরাং এই আন্দোলনে সবাইকে যুক্ত হতে হবে, যুক্ত করতে হবে। নারী আন্দোলন অনুভব করছে লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূরীকরণের মধ্যে দিয়েই বিশ্বে শুধু নারীর উন্নয়ন নয়, নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত নয়, এ বিশ্বের টেকসই উন্নয়ন এবং সার্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব এবং যার কোনো বিকল্প নেই।
আজকে যদি নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা না করা যায়, উন্নয়ন ধারার সঙ্গে যদি লিঙ্গ সমতা নারীর মানবাধিকারের ধারণায় সম্পৃক্ত করা না যায়, তাহলে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না।
সব ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ এবং অংশীদারত্ব নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য দূর করে আমরা নিজেদের এবং আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করি, টেকসই করি। এই হোক আজকের দিনের প্রতিশ্রুতি।
মালেকা বানু : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ