আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ একটি গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক মানবিক যুক্তিবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। প্রতিষ্ঠার পরই ১৯৭১ সালে শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং অগণিত নারী-পুরুষের আত্মদানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মহিলা পরিষদ নানা সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে পাশাপাশি পথ পরিক্রমণ করছে। অর্ধশতাব্দীর পথচলায় বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে গ্রহণ করেছে বহুমাত্রিক কার্যক্রম।
সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর বিভিন্ন স্তরে নারীর দক্ষতাপূর্ণ উপস্থিতি লক্ষণীয়। কৃষি, পোশাকশিল্পসহ শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। অভিবাসী নারীরা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রাখছে অন্যতম ভূমিকা। কিন্তু গৃহকর্মে নারীর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি আজও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকে যুক্ত হচ্ছে না। নারীর এই অগ্রসরমাণতাকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় দাঁড় করার ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্র সব সময় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে না। নারীর প্রতি সংবেদনশীল নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান। যখন নারীর অংশগ্রহণ ও অংশীদারির দাবি সামনে আসে, যখনই নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হয় তখনই দেখা দেয় সামাজিক দ্বন্দ্ব, নানা প্রশ্ন, নানা জটিলতা।
সামাজিক, অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে নারীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকার পরও নারীর প্রতি বৈষম্যের একটি প্রধান কারণ হচ্ছে প্রচলিত, গত্বাঁধা প্রথা ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কাঠামোগতভাবে এতটাই শক্তিশালী যে নীতি, আইন ও কর্মসূচি থাকার পরও তা নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় বাধা প্রদান করছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নারী-পুরুষের মধ্যে অসম ক্ষমতা সম্পর্ক। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সব ক্ষমতা পুরুষের হাতে কেন্দ্রীভূত, সম্পদ-সম্পত্তিতে রয়েছে নারীর অধিকারহীনতা, যা প্রতিনিয়ত নারীকে বৈষম্য এবং সহিংসতার সম্মুখীন করে।
বাংলাদেশের সংবিধানে নারী-পুরুষের সমতার কথা বলা হলেও নারীর ব্যক্তি অধিকার ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের অনুশাসনে পরিচালিত হওয়ার বিষয়টিকে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় ক্ষেত্র বলে বিবেচনা করে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সরকারের কাছে অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রস্তাবনা পেশ করে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সিডও কমিটি ২০১১ সালে বাংলাদেশের সিডও সাময়িক প্রতিবেদনবিষয়ক সমাপনী মন্তব্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অপরিহার্যতা বিবেচনায় মহিলা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ে নারীর পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণের দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করছে, কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ অপ্রতুল।
সরকারের ঘোষণা রয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিতে নারীর সম-অংশগ্রহণ, সমসক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে, নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের প্রয়োজনীয় সংশোধনী করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে মানবসভ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আজকের দিনে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত নারীর জীবনকে অধিকতর বিপন্ন করে তুলেছে। এ ক্ষেত্রেও প্রয়োজন নারীবান্ধব সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও কর্মনীতি।
বৈশ্বিক বিপর্যয় করোনা মহামারি বাংলাদেশের নারীর জীবনের অনেক অর্জনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি, কন্যাদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া এবং ব্যাপক নারীর কর্মহীন হয়ে যাওয়া—বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবিলম্বে যথাযথ পরিকল্পিত ও সুচিন্তিত নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে মৌলবাদের প্রসার, সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার, গণতন্ত্রের সংকট, দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব, অর্থ ও পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য নারীর মানবাধিকার ও নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা নিরসনের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্তরে গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠক্রম বিষয়ে রাষ্ট্রের বলিষ্ঠ নীতি ও কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃঢ়তার অভাব আগামী দিনের মানবিক ও যুক্তিবাদী চিন্তার মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
নারী কোনো অভিন্ন সত্তা নয়। বিভিন্ন পেশার নারী, আদিবাসী নারী, শ্রমিক নারী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নারী, কৃষক নারী, দলিত নারী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নারী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান মৌলিক বৈষম্যের পাশাপাশি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের চাহিদা আকাঙ্ক্ষা অধিকারহীনতার ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ তার কার্যক্রম ও কর্মসূচিতে এসব ক্ষেত্র ধারণ করবে এবং এই লক্ষ্যে প্রয়োজনে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তুলবে। পেশাজীবীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অধিকার আন্দোলনের কর্মীদেরও মনে রাখতে হবে নিজ নিজ দাবিভিত্তিক আন্দোলনের পাশাপাশি মূলধারার নারী আন্দোলনে সবাইকে যুক্ত হতে হবে। তবেই শক্তিশালী হবে নারী আন্দোলন, যা নারীর মানবাধিকার আদায়ে নারী-পুরুষের সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারবে। পুরো সমাজকেও যুক্ত করতে হবে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। কেননা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেমন নারীকে মানুষ হতে দিচ্ছে না, একইভাবে পুরুষ সমাজকে বিষাক্ত পৌরুষত্বে (toxic masculinity) আবদ্ধ করে রাখার ক্ষেত্র গড়ে তুলছে। এসডিজির যে মর্মকথা ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’, মহিলা পরিষদও মনে করে মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার জন্য সবাইকে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় যুক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। নারীর মানবাধিকার ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অর্ধশতাব্দীব্যাপী পরিচালিত আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবার সম্পৃক্ততায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নারী আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে মহিলা পরিষদ, যেখানে ঘটবে কর্মের শক্তির সঙ্গে উপলব্ধির শক্তির মেলবন্ধন।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ