বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের এ ভূখণ্ডে নারী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন প্রায় শতবর্ষ আগে। ষাটের দশকের শেষ দিকে গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। তার সঙ্গে ছাত্র আন্দোলন থেকে সদ্য বিদায় নেওয়া একদল আমরা যুক্ত হয়েছিলাম। তিনি শুরু থেকে আমৃত্যু ছিলেন সামনের সারিতে। তিনি নারী শিক্ষা অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের উদ্যোগে যে শিখাগোষ্ঠী এক সময়ে এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে পশ্চাৎপদতা ও অন্ধকার সময় জয় করে এগিয়ে নিতে সক্রিয় ছিল, তাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনের পাশে থেকে নিজে লিখেছেন, অন্যদের এজন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে সমাজসেবামূলক কাজে যেভাবে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন তার হিসাব রাখা কঠিন। এর পাশাপাশি ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। আমরা যারা তার সংস্পর্শে এসেছি প্রত্যেকেই মনে করেছি_ আমিই বোধহয় ‘খালাম্মার’ সবচেয়ে কাছের লোক। তার স্নেহধারা আমার প্রতিই বোধহয় সবচেয়ে বেশি বর্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে তিনি একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে নারীরা অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। এজন্য মহিলা পরিষদের কৃতিত্ব আছে। অন্য অনেক সংগঠন এ ধারার কাজ করেছে। ব্যক্তি ও সামষ্টিক পর্যায়েও নিরলস কাজ করে চলেছেন অনেকে। তাদের প্রত্যেকের অবদান আমরা স্মরণ করি। রাষ্ট্রের ভূমিকাও বিপুল। গত চার বছরে প্রায় ৩০ লাখ কিশোরী অষ্টম শ্রেণীর পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে বছরে ৬-৭ লাখ ছাত্রী। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রায় পাঁচ লাখ ছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভিড় জমায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে ছাত্রীদের পদচারণা আমাদের দেশকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের প্রাণ হয়ে আছে লাখ লাখ নারী। তারা নিজেদের জন্য উপার্জন করছে, দেশের রফতানি আয়ে অপরিমেয় অবদান রাখছে। প্রবাসেও কাজ করছে অনেক নারী। আমাদের নারীরা হিমালয় চূড়ায় উঠছে। প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন পরীক্ষায় যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তর_ যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, জাতীয় সংসদ পরিচালনা ভার হাতে নিয়েছে।
তবে এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, ব্যক্তি বা পারিবারিক পর্যায়ে নারীর যে সাফল্য, তারা যতটা দৃঢ়পণে এগিয়ে চলেছে সমাজ তার সঙ্গে সবসময় তাল মেলাতে পারছে না। কিছু ক্ষেত্রে উদ্বেগ ও হতাশার চিত্রও আমরা দেখতে পাই। ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য নারীকে আপন ভাগ্য জয় করে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। কিশোরী ও তরুণীরা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে না যায়, তৈরি পোশাক ও ইলেকট্রনিক শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো যেন দক্ষ নারী কর্মী হারিয়ে বন্ধ হয়ে যায়, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলায় বিপুল অবদান রাখা নারী কর্মীরা যেন কৃষিকাজ থেকে সরে দাঁড়ায়_ এসবই চাইছে একটি মহলটি। একাত্তরে এ দেশের নারী-পুরুষের মিলিত আত্মদানে যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে, তার মূলে আঘাত হেনে চলেছে এই শক্তি। আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে, বেগম সুফিয়া কামাল এ শক্তিকে মেনে নিতেন না। নারী সমাজকে মুক্তবুদ্ধি ও আধুনিক ধ্যান-ধারণায় গড়ে তোলায় তিনি আজীবন সক্রিয় ছিলেন। আমরা তার পাশে থেকে কাজ করেছি এবং প্রতিদিন শিখেছি অসম সাহসে দীপ্ত পদক্ষেপে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়। কত চড়াই-উতরাই তিনি নিজে অতিক্রম করেছেন, আমাদের সহযাত্রী করেছেন। যখন দেশ অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে বলে অনেকের মনেই শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে, তখন তার কাছ থেকে মিলত অভয়বাণী। তিনি যে অনন্ত প্রেরণাদায়ী। শুধু নারীদের জন্য নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই মনে করতেন_ আমাদের সামনে সুফিয়া কামাল আছেন যে। কতবার যে বিভিন্ন সমাবেশে তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে_ মেঘ কেটে যাবে, হেসে উঠবে ঝলমলে রোদ। আমরা পরাজিত হবো না।
প্রতিটি সমাজে যুগে যুগে কাজের ধারা বদলায়। কর্মসূচিতে পরিবর্তন আসে। সুফিয়া কামাল যে সময়ে কাজ করেছেন, তখন যা এজেন্ডা ছিল_ তার অনেক কিছুতে এখন পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমরা যারা তার সংস্পর্শে এসেছি তারা প্রত্যেকে অনুভব করি যে তিনি প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। এখন যদি তিনি পাশে থাকতেন, তাহলেও নতুন সময়ের করণীয় নির্ধারণে থাকতেন একইভাবে সক্রিয় ও উদ্যমী। সুফিয়া কামাল অনেক ধরনের কাজ করেছেন। সবকিছুর মূলে ছিল মানবতাবোধ। মানুষের কল্যাণে কিছু করে যেতে হবে, এটাই ছিল তার প্রেরণা। যখন যে ধরনের আন্দোলন প্রয়োজন, সেটা তিনি করতে পেরেছেন।
শৈশবে তার লেখা পড়েছি। পত্রিকার পাতা খুললে তার সম্পর্কে অন্যদের লেখা দেখতে পেয়েছি কিংবা বিভিন্ন বিষয়ে তার বক্তব্য জেনেছি। আমাদের স্কুলের বইয়ে তার ‘সাঁঝের মায়া’ কবিতা পাঠ্য ছিল। তিনি কবিতায় সুন্দরের স্বপ্ন আয়োজনের কথা বলেছেন। পুষ্প বিকাশের প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করার প্রেরণা দিয়েছেন। দীপ না জ্বলা ঘরে দীপ জ্বালানোর তাগিদ দিয়েছেন। তার এ ধরনের লেখা যতবার পড়ি মনে হতে থাকে যে, আলোর ঝরনাধারা আমাকে সিক্ত করছে।
ছোট-বড় কত ঘটনাই না তিনি মনে রাখতে পারতেন। কার কী বৈশিষ্ট্য, কার কী গুণ_ সব খবর রাখতেন। সঙ্গত কারণেই সবার সঙ্গে অন্তরঙ্গ হতে কোনো সমস্যায় পড়তেন না। এটা কাউকে খুশি করার জন্য করতেন না। একেবারে সহজাত বিষয় ছিল না। তিনি পান খেতেন। আমারও পান খেতে ভালো লাগত। তার বাসায় গেলে পানের খিলি নিজেই আমার হাতে তুলে দিতেন। কোনো সভাতে নিজে পান মুখে পুরতে গেলে আমার দিকে হেসে তাকাতেন। আমিও হাত বাড়িয়ে দিতাম। অন্যদের পছন্দ-অপছন্দ তার জানা থাকত। কারও আনন্দে দ্রুত সাড়া দিতেন, কষ্টকে মনে করতেন নিজের কষ্ট। মহিলা পরিষদের এক সক্রিয় কর্মী এক সময়ে বেশ কিছু পারিবারিক সমস্যায় পড়েছিলেন। তিনি তার পাশে দাঁড়িয়েছেন স্নেহময়ী জননীর মতো। একবার আমাদের কয়েকজনকে এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ভালো মানুষদের জন্য কেন যে এ ধরনের মুসিবত আসে! তার সেদিনের দীর্ঘশ্বাস এখনও যেন শুনতে পাই।
তিনি সবার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন। বয়সের পার্থক্য কোনোভাবেই বুঝতে দিতেন না। কারও সঙ্গে দ্বিমত হলে তা প্রকাশের পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। কারও প্রতি বিরক্ত হলে চুপ হয়ে যেতেন। কোনো হৈচৈ করা নয়, সমালোচনা নয় বা রাগ-ক্ষোভ নয়, একেবারেই ভিন্ন এক প্রকাশের মাধ্যম। তিনি আমার গোপীবাগের বাসায় এসেছেন। আমার সঙ্গে সংগঠনের বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। আবার আমার মা ও শাশুড়ির সঙ্গে যখন কথা বলতেন, তখন মহিলা পরিষদের কাজে যে সুফিয়া কামালকে জানি, তাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হতো। ঢাকার বাইরে তার সঙ্গে গেছি অনেক জেলায়। ঢাকাতে ছোট-বড় সমাবেশে যোগ দিয়েছি। কত যে সুখস্মৃতি তার সঙ্গে। তিনি যুগের সঙ্গে চলেছেন। তাল মিলিয়ে চলেছেন। একই সঙ্গে সমাজের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অন্ধকার থেকে আলোর পথে সবাইকে নিয়ে চলতে চেয়েছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন। হতাশায় তিনি ভেঙে পড়তেন না। কঠিন সময়ে পড়লে প্রতিনিয়ত উত্তরণের পথ অনুসন্ধান করতেন। তার প্রয়াণ দিবসে একটিই প্রত্যাশা_ আমাদের সমাজ নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় আরও এগিয়ে আসুক। নারী-পুরুষ সমতার অধিকার দিয়েছে আমাদের সংবিধান। এ কাজ সম্পন্ন করায় নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াস চাই। বেগম সুফিয়া কামাল এজন্য আজীবন সক্রিয় ছিলেন। এখন তার পথ ধরেই আমরা চলতে পারব। কারণ তিনি যে আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন।
সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল