ইউনাইটেড নেশন উইমেনের নেতৃত্বে এবং নাগরিক সমাজের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে লিঙ্গসমতা উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে ৩০ জুন থেকে ২ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জেনারেশন ইক্যুলিটি ফোরাম, প্যারিস-এর তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে সরকারি-বেসরকারি প্রতিনিধি ও অপেক্ষাকৃত তরুণ সমাজের প্রতিনিধিরাও অংশগ্রহণ করে তাদের মতামত প্রদান করেছেন। এর আগে ২৯ থেকে ৩১ মার্চ ২০২১ তিন দিনব্যাপী এ জাতীয় আরেকটি সম্মেলন হয়েছে মেক্সিকো সিটিতে। জেনারেশন ইক্যুলিটি ফোরামÑ প্যারিস-এর এই ভার্চুয়াল সম্মেলনে ৬টি থিম নিয়ে অনেকগুলো ইভেন্টে আলোচনা পর্যালোচনা হয়। ৬টি থিম হলোÑ ১. লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, ২. অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার ও অধিকার, ৩. শারীরিক স্বায়ত্বশাসন এবং যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার, ৪. জলবায়ু বিচারের জন্য নারীবাদী পদক্ষেপ, ৫. জেন্ডার সমতার জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবন, ৬. নারীবাদী আন্দোলন এবং নেতৃত্ব। তবে এই ছয়টি থিমের মধ্যে তৃতীয় যে থিমটি যা বডিলি অটোনমি অ্যান্ড সেক্সয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস বা শারীরিক স্বায়ত্তশাসন এবং যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারের কথা বলা হয়েছে সেটাকেই আমার কাছে মুখ্য বা অন্যতম বলে মনে হয়েছে। কারণ অন্য ৫টি বিষয়কে বাস্তবায়ন করতে হলে আগে নারীকে তার শরীরের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শারীরিক স্বায়ত্তশাসন শব্দটা আমার কাছে নতুন লাগছে বটে কিন্তু বিষয়টা তো নতুন নয়। যারা নারী অধিকার নিয়ে আন্দোলন করি বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমরা কথা বলে থাকি। তবু শব্দগত নতুনত্বের জন্য বিষয়টি নিয়ে ভাবতে গিয়ে আজ থেকে হাজার বছর আগের চর্যাপদের কবি ভুসুকপা রচিত একটি পদ কেবল মনে পড়ছে। পদটি হলো ‘অপনা মাংস হরিণা বৈরী।’ মানে হরিণের মাংসই তার শত্রু। তার মাংসের জন্যই শিকারি পশু তাকে প্রতিনিয়ত ধাওয়া করে ফেরে। ভুসুকপার কবিতার সেই চরণ উদ্ধৃত করে আরও একটি বিষয় বোঝানো হয়ে থাকে, হরিণের মতো নারীর শরীরও নারীর শত্রু। যেজন্য লম্পট নারীলোভী মানুষের মতো দেখতে প্রাণীগুলো শিকারি পশুর মতো নারীর শরীরের লোভে তার পেছনে তাড়া করে ফেরে। যে কারণে বর্তমান সময়ে এসেও দেখা যাচ্ছে যেকোনো বয়সী নারী বিশেষ করে নিরীহ শিশু কিশোরী তো বটেই দুগ্ধপোষ্য নারী শিশুরাও তাদের লালসার থাবা থেকে রেহাই পায় না।
কথা হলো, কেন নারীর নিজের শরীর তার শত্রু হয়ে যায়? শত্রু হয়ে যায় কি এ কারণে যে আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নারীকে মানুষ নয় একটা শরীরসর্বস্ব বস্তু বলেই মনে করা হয়, তাই। আরও সহজভাবে বলা যায়, নারী মানেই একটা শরীর! তা শরীর তো সকলেরই থাকে। এমনকি জড়বস্তুরও একটা কাঠামো থাকে। মানুষের এবং প্রাণিকুলের সকলেরই একটা শরীর থাকে। যতক্ষণ সে জীবিত থাকে এই শরীরের ভিতরে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়। এই শরীরের সাহায্যেই আমরা নানা প্রকার কাজ করে থাকি। নারীর শরীরেই বেড়ে ওঠে নারী পুরুষ তথা মানুষের শরীর। তাহলে শরীর তো যার যার তার তার হওয়া উচিত। যদিও প্রাণিকুলে মাংসাশী পশু তার থেকে দুর্বল পশুকে খেয়ে ফেলে। হরিণের চেয়ে শক্তিশালী পশুরা তাকে শিকার করার জন্য তাড়া করে। কিন্তু মানুষ তো সকলেই মানুষ সেটা যদি আমরা মনে করি তাহলে কোনো একটা শ্রেণির মানুষের শরীর কেন তার জন্য বৈরী হবে? কেন পুরুষের শরীর পুরুষের জন্য বৈরী হয় না? বৈরী হয় না কারণ এ সমাজ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের শরীর কোনো বস্তু বা উপকরণ নয়। যেমন করে নারীর শরীর একটা উপকরণ হয়। এর কেনাবেচা চলে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। প্রত্যক্ষভাবে হলো নারীকে হস্তান্তর করা হয় এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে। আর পরোক্ষভাবে নারীদেহকে ভার্চুয়ালি বিক্রি করা হয়। সিনেমায়, বিজ্ঞাপনে এবং পর্নোগ্রাফিতে ছাপা কাগজে বা সেলুলয়েডের ফিতায়। এর ক্রেতা কারা? অবশ্যই পুরুষ।
হস্তান্তরের প্রক্রিয়াটা শুরু হয় পরিবার থেকেই। যারা নারীকে জন্ম দেয় তারা, মানে তার বাবা-মা। মায়ের কথা বলা হলো কারণ মা নিজে নারী হয়েও পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে মেয়েকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে করে একজন পুরুষের হাতে তুলে দিলেই মেয়েটার একটা গতি হলো। ওই মায়ের এটা দোষ নয়। পুরুষতন্ত্র তার মগজে এরকম ধারণা ঠেসে দিয়েছে। ঠেসে দেওয়া ধারণাকে সে তার সামাজিকীকরণের সময় থেকে ধারণ করে আসছে। এর থেকে বের হওয়ার জন্য যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা দরকার তা আমাদের পরিবার ও সমাজ রাষ্ট্রের কাঠামোতে সহজলভ্য নয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ রাষ্ট্রের কাঠামোতে শিক্ষা ও সংস্কৃতি পুরুষতন্ত্রেরই ছাঁচে গড়া। এ সংস্কৃতি পুরুষের পক্ষে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক! তবে যদি কারওর নিজের ভিতর শক্তিশালী প্রতিবাদী সত্তা থাকে তবে প্রতিবাদ করার সাহস দেখাতে পারে।
পুরুষতন্ত্রে নারীকে হস্তান্তরের বৈধ ব্যবস্থা হচ্ছে বিবাহব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা অনুযায়ী নারীকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দেওয়াকে সম্মানজনক ব্যাপার হিসেবেই মানুষের মনে ও মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো অধিকাংশ পরিবারে একটি মেয়েশিশুকে জন্মের পর থেকে যেন বড় করে তোলাই হয় তাকে একজন পুরুষের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। বড় বলতে শুধু দৈহিক আকার আকৃতিতে বা পুরুষটির পরিবারে কায়িক শ্রম দেওয়ার মতো সক্ষম মনে করার মাধ্যমে। এখানে বৈবাহিক প্রথায় নারীকে পুরুষের হাতে তুলে দেওয়ার সময় খুবই সামান্য একটা অংশের পরিবার ছাড়া সিংহভাগ পরিবারে মেয়েটির সম্মতি গ্রহণের প্রয়োজনই বোধ করা হয় না অন্তত আমাদের দেশ ও আশপাশের দেশগুলোতে। সিনেমা নাটকে এমন দৃশ্য একটা কমন বিষয় যেখানে বাবা কখনো মাও একটা ছেলের হাতে মেয়েটাকে ধরিয়ে দিয়ে বলে- আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা! এই যে শব্দবন্ধ, হাতে তুলে দেওয়া এটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে এটাই তো মনে হয় যে ছেলেটির হাতে কোনো বস্তু তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় দুজন মানুষ দাতা আর গ্রহীতা। মাঝখানে যে সে যেন বস্তু, তার কোনো বক্তব্য নেই। মুসলিম বিবাহব্যবস্থায় কবুল বলার মানে মেয়েটি বিয়েতে সম্মতি দেওয়ার একটা অনুষ্ঠান আছে বটে কিন্তু কতজন মেয়ে আদৌ কবুল উচ্চারণ করে, নাকি করে না, আর যারা করে তারাও যে কতটুকু স্বেচ্ছায় উচ্চারণ করে কে জানে? আবার হিন্দু বিয়েতে মন্ত্র উচ্চারণের বিষয় থাকলেও সে মন্ত্রের মর্মকথা কী, তা যে সাড়ে নিরানব্বই শতাংশ নারী পুরুষ জানে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। তাতে এটাই প্রমাণ হয়, এই হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। তার বাপ ভাই ক্ষেত্রবিশেষে মা বা এদের অবর্তমানে জ্ঞাতি গোষ্ঠীর যে কেউ যে কোনো সময় তাকে হস্তান্তর করতে পারে। আবার এত ঢাকঢোল পিটিয়ে যাদের কাছে হস্তান্তর করা হয় কখনো কখনো তাদের কেউ কেউও যে তাকে অন্য কোথাও হস্তান্তর করে দেয় সে খবরও তো প্রায়ই জানা যায়।
তা এ তো গেল পারিবারিক হস্তান্তরের কথা। বিয়ের লোভ দেখিয়ে, চাকরি বা কাজের লোভ দেখিয়ে অসহায় কিশোরী-তরুণীদের অচেনা লোকের হাতে যে হস্তান্তর করে দেয় মানে বিক্রি করে দেয় দালাল ও লম্পট প্রকৃতির নষ্ট লোকরা। সেও তো আজকাল অহরহ ঘটছে। এছাড়া সন্ত্রাসী-গুণ্ডা শ্রেণির লোকরা কোনো মেয়ের ওপর নজর পড়লে প্রকাশ্যে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। নিয়ে বিক্রি করে দেয় বা গডফাদার-মাদারদের হাতে তুলে দেয়। বাকি জীবন এদের দেহ শোষণ করে চলে। অতি সম্প্রতি একটা দালালচক্র প্রযুক্তির সুবিধা ব্যবহার করে এক কিশোরীকে ভারতে নিয়ে বিক্রয় করে দিয়েছে এমন ঘটনায় দেশ তোলপাড় হলো। এরকম ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেওয়ার ঘটনা বহু পুরনো। যত দিন যাচ্ছে সংখ্যায় বাড়ছে।
নারীকে এভাবে বিক্রয় করা, হস্তান্তর করা, পাচার করে দেওয়া প্রকারান্তরে নারীর শরীর নিয়ে বেচাকেনার খেলা চলছেই। কিন্তু কেন এই কেনাবেচার খেলা? এর উত্তর খুব সহজ। নারীর শরীরের ওপর নারীর অধিকার না থাকার কারণেই নারীদেহ নিয়ে এত টানাহেঁচড়া। নারীকে মানুষ থেকে শরীর হিসেবে রূপান্তর করে যে দেহসর্বস্ব পুরুষতান্ত্রিক মগজ তারা দেহের ঊর্ধ্বে চৈতন্যের স্তরে উঠতে পারে না। চৈতন্যহীন দেহসর্বস্ব মগজধারীদের র্ভিড়ে নারীর শরীর তার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এক সময়ে এই পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিল। দাস মানুষদের শরীরের ওপর তাদের কোনো অধিকার ছিল না। তাদের শরীরের ওপর দখলদারিত্ব থাকত দাস মালিকদের। সেই মালিকরা দাসের শরীরকে তাদের নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করত। তাদের শ্রম শোষণ করত, তাদেরকে বিক্রি করে দিত। এমনকি তাদের বিকৃত আনন্দের জন্য কখনো কখনো দাসদের বাঘের খাঁচায়ও ছেড়ে দিত। আমাদের অনেক বাবা-মাও তাদের মেয়েশিশুদের বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেয়। তবে তা অবশ্য বিকৃত আনন্দলাভের জন্য নয়। তাদের ঘাড়ের বোঝা কমানোর জন্য বা পিতা-মাতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য। অধিকাংশ পরিবারের মেয়েশিশুটি তার শরীর সম্পর্কে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের মেয়েটিকে বিয়ের নামে একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ নামের বাঘের হাতে তুলে দেয়। হিন্দু পরিবারগুলো তো একেবারে সম্প্রদান করে সাতজনমের জন্য দিয়ে দেয়। এভাবে যখন তাকে তুলে দেওয়া হয়, তখন যার কাছে দেওয়া হয় সে তো তার সম্পত্তি হয়ে যায়। তখন সেই সম্পত্তি সে কী করবে সবটা তার অধিকার। বছর দুয়েক আগে মাত্র নবম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী চৌদ্দ বছরের সেই কিশোরীটির সঙ্গে যে নির্মম ঘটনাটি ঘটেছিল নিশ্চয়ই তা আমরা ভুলে যাইনি। কিশোরীটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার বাবা-মা বিদেশফেরত পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী পুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিল (অবশ্যই বিয়ে দিয়ে)। বিদেশফেরত টাকাপয়সাওয়ালা ওই লোকটির কাছে মেয়েটিকে হস্তান্তর করে বাবা-মা খুবই আনন্দিত ছিল। কিন্তু সংসার বা বিবাহ নামের খাঁচার ভিতর বসে পুরুষ নামের বাঘটি কিশোরীটিকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছিল। বাবা-মার আনন্দ তিন দিনের বেশি স্থায়ী হয়নি। ছেঁড়া-খোঁড়া ক্ষতবিক্ষত মেয়েটির রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারেননি চিকিৎসকরা। হাসপাতালের শয্যায় সপ্তাহখানেক নির্জীব পড়ে থেকে মারা যায় সে। শরীরটা তো তার ছিল না! কারণ প্রথমে ওই শরীরটা ছিল তার বাবা-মার দখলে (মা নারী হলেও এখানে পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি) তাই তারা তাদের ইচ্ছেমতো আরেকজনের কাছে দখলিস্বত্ব হস্তান্তর করেছে এবং নতুন দখলদার তাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। এটা যে একটা মানুষÑ তার যে প্রাণ আছে, তারও যে ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালোলাগা, মন্দলাগা, কষ্ট ও যন্ত্রণার বিষয়-আশয় থাকতে পারে, তার বয়স কত এসব সে ভাবতেই পারেনি। আসলে তাকে তো ভাবতে শেখানো হয়নি। পুরুষতন্ত্র শুধু তার প্রয়োজনটাই ভাবতে শেখায়।
কয়েকদিন আগের সংবাদপত্রের খবর, একটি কিশোরী মেয়ে এবং ছেলেটি অপ্রাপ্ত বয়স্ক না হলেও একুশ বছর হয়নি, তারা প্রেমের টানে দুজনে মিলে পালিয়ে গিয়েছিল। কিশোরীর বাপ চেয়ারম্যানের কাছে বিচার চাইলে সালিশ বসে। সুন্দর চেহারার কিশোরীকে দেখেই মনে ধরে গেল বলে ষাট বছরের চেয়ারম্যানের। আর সে সালিশ বৈঠকে বসে সালিশ করার পরিবর্তে কিশোরীটিকে বিয়ে করতে চাইল; কিশোরীর বাপও তাতে সম্মত হয়ে বিয়ে দিয়ে দিল! কিশোরীটি অবশ্য বুড়ো চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিয়েটি মেনে নেয়নি বলে খবরে বলা হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি উল্লেখের কারণ এজন্য যে একজন জনপ্রতিনিধিও একজন সালিশের বিচারক হয়ে সে আইনকানুনকে তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে কী করে একটি কিশোরীকে বিয়ে করতে উদ্যত হলো আর অমনি তার বাবাও রাজি হয়ে গেল! কেন এই বর্বরতা?
কখনো কখনো বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজিত উঠান বৈঠকে অনেক জীর্ণশীর্ণ শরীরের ত্রিশোর্ধ মাকে দেখি, যাদের তাদের প্রকৃত বয়স থেকে দ্বিগুণ বয়সী মনে হয় অথচ তারা তাদের ১৪-১৫ বছরের কিশোরীর মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করে; তাদের প্রশ্ন করি- আপনারও তো অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে, তাই না?
তারা লাজুক হেসে জানায়, হ। তারপর কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল প্রশ্ন করলে ঠিক উত্তর দিতে পারে না।
অনেকে বলে- বড় যে বন্যা হইছিল, সেই বচ্ছর আমার জন্ম! কেউ বলে তার মাসিক মানে রজস্বলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।
তাকে প্রশ্ন করি- সেই বয়সের বিবাহিত জীবন কী আপনার আনন্দময় ছিল? তারা আবার লাজুক হাসি হাসে। বলে, কী কমু, তাও কি হয়? কিছুই তো বুঝতাম না। তাও কত কষ্ট! কত যন্ত্রণা! মা-বাপে বিয়া দিছে। কইয়া দিছে জামাই যা কইব তাই শুনতে। শুনতে হতো।
কেউ জানায় বিবাহিত জীবনে আনন্দ কিয়ের? বাপের বাড়ি খাইছি আর হাত ধুইছি। বিয়ার পর শাশুড়ি খালি কাম করায়। বচ্ছর ঘুরতে না ঘুরতে পেটে বাইচ্চা আইল। কত কষ্ট। দিনে কামের ছুডে ঘুমাইতে পারি না রাইতে বাইচ্চার কান্দন, হাগামুতা, জামাইয়ের চাওয়া পাওয়া আরও কত কী! লাইফ এক্কেরে কেরাসিন।
তাহলে সেই আবার নিজের মেয়ের লাইফ কেরোসিন কেন করতে চান এ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টো তারাই প্রশ্ন করে। লাজুক হাসি হেসে বলে, অভাবি মানুষ আমরা। সংসার চালাইতে পারি না। সংসারে তিনটা মাইয়া, দুইটা পোলা। একজনের রোজগারে চলে? তাও হৌর-হাউরি আছে না আরও?
তাহলে এতগুলো ছেলেমেয়ে জন্ম দিলেন কেন? দুটো একটা বাচ্চা নিলেই তো অভাব কম থাকত। আপনার শরীর স্বাস্থ্যও ভালো থাকত। তাই না?
কেউ কেউ জবাব দেয়- জামাই চায়, শাশুড়ি চায় পোলা অইত। যতখান না পোলা হইছে, জন্ম তো দেওনই লাগব। একবার একজন জানাল, গর্ভধারণ করলেই তার শরীর অসুস্থ হয় আর ডেলিভারির পরও আরও বছর দুয়েক সে অসুস্থ থাকে। তবু তার জামাইয়ের শখ একটা মেয়েসন্তানের। সেজন্য আশায় আশায় সে চারটি ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তাও রেহাই নেই। জামাইয়ের ইচ্ছে নেই বলে সে কোনো প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিতে পারে না।
পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে দম্পতিদের সহায়তা করার জন্য সরকারের একটা দফতর রয়েছে। দম্পতিদের এ সমস্ত পদ্ধতি সেবাদানের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে সরকারি কর্মীরা। কিন্তু এসব কর্মীরা এখনো অনেক দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে থাকেন। দম্পতি নারী উদ্বুদ্ধ হলেও তার পরিবারের লোক বিশেষ করে তার শাশুড়ি ও বর বাধা দিয়ে থাকেন। আর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির উপকরণও প্রায় সবই নারীর ব্যবহারের জন্য তৈরি করা। যেসমস্ত পদ্ধতির বিশেষ করে মেয়েদের ব্যবহারের পদ্ধতিগুলোর নানাপ্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যেসমস্ত দম্পতির উভয়েই আর সন্তান নিতে চায় না তাদের নারী পার্টনারকেই কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় আর তার সমস্ত প্রজননকালটা নানারকম উপসর্গ যেমন মাথাঘোরা, অতিরিক্ত বা অনিয়মিত ঋতুস্রাব, শরীর মোটা বা শুকিয়ে যাওয়া ইত্যাদি যন্ত্রণা নিয়ে যাপন করতে হয়। আর যারা এসব পদ্ধতি গ্রহণ করে না তারা বারবার অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ করতে করতে লাইফকে নরক বানিয়ে ফেলে। বাল্যবিবাহের শিকার-কিশোরী বা আঠারো-উনিশের তরুণী বিবাহিত নারীদের প্রজননকাল অনেক দীর্ঘ হয় অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে। এই দীর্ঘ প্রজননকালে হয় তাদের অধিক সংখ্যক সন্তানের জন্ম দিতে হয় আর তা না দিতে চাইলে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যন্ত্রণাময় বা অস্বস্তিকর জীবন কাটাতে হয়। অনেকে অকালে মৃত্যুবরণও করে।
উপরে বর্ণিত নারীর জীবনের এই অকাল অবসান বা যন্ত্রণা বা অত্যাচার নির্যাতনের মূল কারণ নারীর শরীরের ওপর তার অধিকার না থাকা। তার নিজের শরীরের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা। কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে, কখনো প্রথা বা নিয়মের বেড়া দিয়ে এবং নারী পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট সেটা নারীর মগজে বসিয়ে দিয়ে পুরুষতন্ত্র নারীর শরীরের ওপর অন্যের নিয়ন্ত্রণ ও দখলদারিত্ব পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। যে কারণে ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা নারীরাও তাদের শরীরের ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় মেনে নেয় আর জীবনভর অত্যাচার নির্যাতন, কষ্ট ও যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকে বা মরার আগেই মরে থাকে।
তাহলে নারীর এরকম জীবনযাপনের সঙ্গে ক্ষমতায়নের সম্পর্ক কোথায়? কেবল মুখে মুখে নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে গেছে বললেই নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে যায় না। এসব ফাঁকা বুলি মাত্র। নারীর শরীরের ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব না। লেখক তসলিমা নাসরিন একবার জরায়ুর স্বাধীনতার কথা বলায় দেশে গেল গেল রব উঠেছিল। যে দেশে প্রতিদিন অসংখ্য নারী শিশু এমনকি প্রৌঢ়া বৃদ্ধা নারীরাও ধর্ষিত হন সেখানে জরায়ু শব্দটা উচ্চারণ করলেই সবাই লাজে মরে যায়। এটা খুবই হাস্যকর। জরায়ু নারীর একটা অঙ্গ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের সকলের জন্ম হয়েছে এই জরায়ুতেই। কিন্তু নারী নিজের জরায়ুতে কখন সন্তান ধারণ করবে, কয়টা সন্তান ধারণ করবে নাকি আদৌ ধারণ করবে না এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। তা নিয়ন্ত্রণ করে পুরুষ বা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি শাশুড়ি বা অন্যরা। কারণ পুরুষতন্ত্রে জরায়ুর মালিকানা নারীর নয় যেহেতু শরীরের মালিকানাই তার নেই। কাজেই নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা করতে হলে নারীর শরীরের ওপরও তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আর অবশ্যই মনে রাখা প্রয়োজন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর শরীরের অধিকার ও তার প্রজনন স্বাস্থ্য শুধু নারীর বিষয় নয়। এটা নারী-পুরুষ সকলের বিষয়। এটা মানবসভ্যতার বিষয়। তাই সভ্যতার আলোকময় পথে হাঁটতে গেলে প্রত্যেকটা ব্যক্তি মানুষকে, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সেই অমিয় বাণী, ‘প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন’ এর ওপর বিশ্বাস রাখা। তা চেতনায় ধারণ করতে হবে এবং প্রাত্যহিক জীবনযাপনে আচরণ করতে হবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : খোলা কাগজ