১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্ট। কিশোরী ইয়াসমিন, যাকে পুলিশের কয়েকজন সদস্য দিনাজপুরের দশমাইল মোড় থেকে শহরের রামনগরে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ভ্যানে তুলে নেন। তারপর তাকে ধর্ষণ ও হত্যা করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেন। ইয়াসমিনের লাশ ভোরে রানীগঞ্জ মোড়ে ব্র্যাক অফিসের সামনে পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয় লোকজন।
ইয়াসমিন তখন রক্তাক্ত, নিথর। এরপর পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি দল থেকে তাকে পতিতা ‘বানু’ বানানোর চেষ্টা করা হয়। বানোয়াট পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিয়ে তড়িঘড়ি দাফন করে ফেলা হয়। কিন্তু সব চক্রান্ত নস্যাৎ করে অভূতপূর্ব জনপ্রতিরোধ গড়ে ওঠে kalerkanthoদিনাজপুরে। সামু, কাদের, সিরাজ, গোলাপ, নান্নু, জুলহাস এবং একজন শিশুসহ শহীদ হন সাতজন। প্রথম পোস্টমর্টেমে ধর্ষণের কোনো আলামত পাওয়া না গেলেও আন্দোলনের মুখে দ্বিতীয়বারের জন্য মরদেহ উত্তোলন করা হয়।
এই হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ফাঁসির রায় ২০০৪ সালে কার্যকর হয়। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে মামলা হয়েছিল—জনগণের রোষ, সাক্ষী, প্রমাণ ইত্যাদি। আমরা জানি, জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে এই মামলা মাথায় নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বেইজিং গিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে যোগ দিতে। ইয়াসমিনের পুলিশ হেফাজতে ধর্ষণ ও হত্যা প্রসঙ্গ সেখানেও আলোচিত হয়। একত্র হয় নারীসমাজ। কিন্তু আজও এই প্রতিরোধ আন্দোলনে শহীদদের বিচারের মামলাটি স্থবির আছে। শহীদ পরিবারগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের কোনো যোগাযোগ বা তাদের সাহায্য করা হয়নি।
ইয়াসমিনের পর হাজার হাজার ইয়াসমিন নানাভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছে, তাদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও আন্দোলন কিছুটা হয়েছে, বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন হয়েছে, স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি বললেই চলে। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং নির্যাতিত নারীকে যৌনকর্মী বানানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে, যেন যৌনকর্মী হলেই ধর্ষণ অপরাধ নয়? এই নির্যাতনের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নতুন ধরন। যৌন নিপীড়ন, পারিবারিক সহিংসতা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ এখন নিত্য ঘটনা। এগুলো পত্রিকার পাতায় আসছে। আর যেগুলো আসছে না তার সংখ্যা কত, তা বুঝতে সময় লাগে না।
কোথাও নিরাপদ নন নারী। তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করা হচ্ছে। নারী পোশাকেও নিরাপদ নন। নরসিংদীর রেলস্টেশনের নারী লাঞ্ছনা প্রসঙ্গে মাননীয় আদালতও সে কথা বলেছেন। কপালের টিপে এবং অবস্থানেও নিরাপদ নন তাঁরা। ঘরে ও বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহনে কোথাও নিরাপদ নন।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এ কথা স্পষ্ট যে নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিই সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি নারীকে অধস্তন দেখে, পণ্য ও ভোগ্যবস্তু হিসেবে প্রতিপন্ন করে। অর্থাৎ নারীকে মানুষ হিসেবে দেখে না। সমাজে পৌরুষের ভুল ধারণা নিয়ে পুরুষমনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠে। পুরুষ সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান হয়ে বেড়ে ওঠে। হয়ে ওঠে কর্তৃত্বপরায়ণ ও আগ্রাসী।
সুতরাং ধর্ষণ বা সহিংসতা শুধু যৌন আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ নয়, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতিরও বহিঃপ্রকাশ। এ সংস্কৃতিই সমাজ ও রাষ্ট্র বহন করে চলেছে। ধর্ষণের সঙ্গে পোশাকের সম্পর্ক নেই, আছে অসম্মতির। এই বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা।
এই আঘাত কেন হচ্ছে বারবার? এই পাশবিক কর্মকাণ্ড কেন এত ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার যুক্তিভিত্তিক, সমাজতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হওয়া অত্যন্ত জরুরি এবং রাজনৈতিক কর্তব্য।
আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলো। আমরা তবে কোন প্রজন্ম তৈরি করলাম? কোন শিক্ষায় এরা শিক্ষিত! শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি, পাঠক্রম, গণমাধ্যমসহ পরিবারগুলোতে কী শেখানো হচ্ছে? এরা কি আদর্শ ও মূল্যবোধ ছাড়া প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠছে না? প্রসঙ্গত বলতে হয়, পরিবার হচ্ছে শিশুর সামাজিকীকরণের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজটুকু সেখান থেকেই শুরু করতে হবে। নারীর প্রতি সম্মান না থাকলে তাকে নির্যাতন করা, অসম্মান করা সহজ। এ জন্য চাই জেন্ডার সংবেদনশীল সমাজ। তবেই সমাজ বুঝতে সক্ষম হবে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’। নির্যাতন প্রতিরোধের কাজ আরো সমন্বিত ও কার্যকরভাবে করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে কর্মরতদের ঔদাসীন্যও অপরাধীদের পক্ষে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মি টু আন্দোলন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে কতটা গভীরে গ্রথিত নারী-পুরুষের বৈষম্যমূলক অবস্থান। একটা বৈষম্যপূর্ণ মূল্যবোধ, জীবনবোধ, জীবনচর্চা মানুষের শিরায় শিরায় মিশে আছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় এই অবক্ষয় চোখে পড়ার মতো এবং তা রীতিমতো উদ্বেগের। এই অবস্থা উপেক্ষা করার সুযোগ কারো নেই। কেননা নারী নিজে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা বহন করে। তাই নারী অবদমিত, পদানত, অধস্তন অবস্থানে থাকবেন না। নারীর মানবিক সত্তা, ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ববোধকে বিনষ্ট করা নয়, এই সম্ভাবনাকে রক্ষা করা এবং লালন করার দায় সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করে সহিংসতামুক্ত সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
মানবাধিকার সম্পর্কে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। নারীর জন্য ক্ষতিকর প্রথা (বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত সালিসি কার্যক্রম, বহুবিবাহ) বন্ধ করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন ও বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে নারীবান্ধব ও জেন্ডার সংবেদনশীল করে তুলতে হবে। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন ২০১০-এর প্রচার ও প্রয়োগের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ধর্ষণের বিচারসংক্রান্ত আইনের সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় আইন সংস্কার করতে হবে। অপরাধীকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক আশ্রয়-প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় সমাবেশে নারীর প্রতি নেতিবাচক প্রচার-প্রচারণা, সব ধরনের গণমাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচারণা বন্ধ করতে হবে। নারী নির্যাতন কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন যে নৃশংসতার শিকার হয়েছিল—মানুষকে শুধু সেটাই স্তম্ভিত করেনি, তার মৃত্যুপরবর্তী প্রশাসনের আচরণ, মতাদর্শিক আক্রমণও জনসাধারণকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উত্তাল আন্দোলনের মুখে পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনাজপুরে পুরো পুলিশ বাহিনীকে লাইনে ক্লোজ করা হয়। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার শহরের নিয়ন্ত্রণ হারান। ১৪৪ ধারা ও কারফিউ জারি করে বিজিবি (তৎকালীন বিডিআর) নামিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। পরে দিনাজপুরে বিশিষ্টজনদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। ইয়াসমিন এখন শুধু একজন হতভাগ্য ধর্ষিত কিশোরী নয়, সে এখন নারী নির্যাতন প্রতিরোধের একটি প্রতীকের নাম। এই প্রতীক আমাদের মনে করিয়ে দেয় নারীর নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হবে, অনেক কাজ। আমাদের সচেতন হতে হবে। হতে হবে প্রকৃত মানুষ।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, দিনাজপুর জেলা শাখা
তথ্যসূত্র : দৈনিক কালের কণ্ঠ