চোখের সামনে নেই কিন্তু অনুভবে আছেন, সময়ের তাগিদে বারবার তিনি উপস্থিত হন তাদের সামনে—যাদের নিয়ে তিনি পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। অন্য কথায় যারা তাঁর পেছনে হেঁটেছে দীর্ঘ সময়, দীর্ঘ পথে—তাদের সবাইকে তিনি অনুভব করিয়েছেন পূর্বসূরিদের মতো তাদেরও পথের বাধা পেরিয়ে পথ তৈরি করতে আপন শক্তি আর প্রতিভাকেই নির্ভর করতে হবে। মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, সবাইকে সংগ্রামের পথে অবিরাম চলার জন্য প্রয়োজনে হৃদয়ে অবিনাশী চেতনার মশাল জ্বালাতে হবে। আর এই মশালকে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে সমাজে, পরিবারে, নারীর জীবনে, তবেই নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে।
সত্য, সুন্দর, কল্যাণ আর ন্যায়বোধের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তিনি মানবপ্রেমী হিসেবে সব ধরনের অসাম্য বঞ্চনা আর শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়েছেন, অন্যদের সংগঠিত করে পাশে এনেছেন। তিনি প্রথাগত রাজনীতিতে যুক্ত হননি, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তাঁর আনুগত্য দেখাননি কিন্তু গণমানুষের, নারীসমাজের ন্যায্য অধিকার, যা রাজনীতি-সংশ্লিষ্টতাকে তিনি ধারণ করেছেন আপন চেতনায়, আপন শক্তিতে—এখানেই দেখতে পাওয়া যায় তাঁর শক্তিময় রূপ। তাঁর চেতনায়, তাঁর মননে এই দেশ, এই সমাজে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আর আধিপত্যে নারীর জন্য তৈরি করা বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ার সংগ্রামের তিনি অগ্রসৈনিক। তাঁর সংগ্রামের আহ্বানে দেশ ও সমাজের নারীদের আগ্রহী করেছে নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সংগঠিত শক্তি হিসেবে বিকশিত হতে। কোমলে-কঠিনে, মায়ায়-মমতায় যিনি ছিলেন দীপ্যমান। নারী আন্দোলনের অগ্রসেনানি সেই সুফিয়া কামাল, তিনিই তাঁর কর্মধারায় নারীর অবস্থা ও অবস্থানকে বিশ্লেষণ করে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং প্রাপ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর জীবনদর্শনে দেখতে পাওয়া যায় বঞ্চিত, অবহেলিত, নিগৃহীত মানবতার পাশে বৈষম্যের শিকার, নির্যাতন আর নিগ্রহের শিকার নারীর জন্য সংগঠিত আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। গৃহিণী নারীর গৃহকাজে নারী শ্রমের স্বীকৃতি কর্মজীবী নারীর একযোগে পারিবারিক ও কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রমের কার্যক্রম গ্রহণ করার জন্য সংগঠিত আন্দোলনের আহ্বান আজকের বাস্তবতায় কিছুটা ফলপ্রসূ হয়েছে বলেই নারীর মধ্যে কিছুটা হলেও সচেতনতা এবং শক্তির প্রকাশ ঘটছে।
এই দেশে শ্রমিক নারীর অধিকার, বিশেষত তাঁর কর্মক্ষেত্রটি নারীবান্ধব করার সংগ্রামের শুরু থেকেই শ্রমজীবী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেরও বাতিঘর জননী শতাব্দীর সাহসিকা শক্তিময়ী সুফিয়া কামাল। স্বাধীন দেশে সব মানুষের মৌলিক যে অধিকার—আহার, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান তার সব কটির অধিকার পুরুষের পাশাপাশি শ্রমজীবী নারীও প্রাপ্য। নারীকে যে সততই সর্বত্র সংগ্রামের পথে ধাবিত হতে হয়, শ্রমজীবী নারীর অবস্থা বিবেচনায় নিলে তা বিশেষভাবে সুস্পষ্ট হয়।
স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী এই বাংলাদেশে উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন পর্যায়ে, সংখ্যার সমতা না থাকলেও নারীর দৃষ্টান্তমূলক উপস্থিতির সঙ্গে, নারীর কার্যক্রমের সাফল্যের সঙ্গে শ্রমজীবী নারীর অবস্থাকে কোনোভাবে চ্যালেঞ্জমুক্ত বলে গ্রহণ করা যায় না। এই দেশে, এই সমাজে, কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী নারীর কর্মপরিবেশ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কণ্টকমুক্ত হয়নি। অথচ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে সুযোগের, সমতার কথা বলা হয়েছে এভাবে—‘সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন’ ১৯(১), ‘জাতীয় জীবনের সর্বস্তরের মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন’ ১৯(৩)। ১৯(২) অনুচ্ছেদে ‘সকল নাগরিক আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ’
অথচ গত ১৫ নভেম্বর ২০১৯ সেগুনবাগিচায় মহিলা পরিষদের উদ্যোগে শ্রমজীবী নারীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় জানা যাচ্ছে, শ্রমিক নারীর অধিকার ও বাস্তবতা তাদের জীবনকে চ্যালেঞ্জ শুধু নয়, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে। অথচ আইএলও কনভেনশনের ১১১ ধারায় বৈষম্য বিলোপ, নিরাপত্তা বিধানের উল্লেখ আছে, তার সঙ্গে শ্রমজীবী নারীর সংগঠিত হওয়ার, দর-কষাকষি করার অধিকার যুক্ত আছে। অথচ শ্রমিক-মালিক সম্পর্কে নারী শ্রমিকের অবস্থান ও মর্যাদা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার যে দোষ—তা দেখতে পাওয়া যায় নারী শ্রমিকের প্রতি কখনো মালিক-প্রতিনিধি, কখনো কর্মক্ষেত্রে পুরুষ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুপারভাইজার, লাইনম্যানদের যৌন নির্যাতনের আচরণ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে। আবার অন্যদিকে শ্রম আইনে নারী শ্রমিকের অধিকার বিষয়ে ধারণা কিংবা তথ্য না জানার কারণে তাদের মধ্যে আত্মশক্তি বিকাশের সুযোগ লাভ করে না।
সময়ের বাস্তবতা আর জীবন-জীবিকার তাগিদে শ্রমজীবী নারীদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্যের পরিধি বেড়ে গেছে। তা মোকাবেলায় রাষ্ট্রয়াত্ত অবকাঠামো বিশেষত গণপরিবহন এখনো নারীবান্ধব নয়। বাসে উঠতে দিতে চালক-কন্ডাক্টরদের অনীহা-অসম্মানজনক মন্তব্য ছাড়াও নারী জাতির যৌন হয়রানি ও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। কলকারখানাসহ শ্রমবাজারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ প্রায় দেখতে বা শুনতে পাওয়া যায় না। নারী-পুরুষের মধ্যে মজুরি বৈষম্য শ্রমবিভাজনে নারী শ্রমিকের অবস্থা বিবেচনা করে দায়িত্ব নিরূপণ অবহেলার মধ্যে থাকে। নারী শ্রমিকের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, শিশু দিবাযত্ন কেন্দে র নিশ্চয়তা বিধান, আবাসন ব্যবস্থা, সন্তানধারণকারী নারীর স্বাস্থ্য বিবেচনাপূর্বক দায়িত্ব নিরূপণ, নারীর মাতৃত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা, কর্মক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসাসেবার অনুপস্থিতি, আইন অনুযায়ী চাকরির সুবিধা দেওয়া, নারীবান্ধব বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে।
বলা হয়, এসব বিষয়ে সরকারের করা আইন শ্রমিকদের, নারী শ্রমিকদের জানতে হবে। সবই সত্য কিন্তু গোল বাধে সরকার গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে। বাস্তবায়ন চিত্র তুলে আনতে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, ট্যানারি প্রতিষ্ঠান, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, চাতাল, হোসিয়ারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান, গৃহশ্রমসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক ও পরিবেশ এবং তার সঙ্গে নারী হিসেবে নারী শ্রমিকের আইন অনুযায়ী সমকাজে সমমজুরি ও প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার অবস্থার মূল্যায়ন কিভাবে হয়—গ্যাপ কী তা বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিতের উদ্যোগ যে সরকার এবং তার প্রতিনিধিদের, তা কি তাঁরা অকপটে স্বীকার করেন? মনিটরিং ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনার বাস্তব চিত্র কি তাঁরা বিবেচনায় নেবেন না? সরকারের প্রতিনিধিরা কাদের স্বার্থকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেবেন, শ্রমজীবী নারীদের পক্ষ থেকে এসব বিষয় তুলে ধরা আজ জরুরি। আরো জরুরি শ্রমিক স্বার্থ রক্ষাকারী সংগঠন প্রতিষ্ঠানের কাছে নারী শ্রমিকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অধিকার আদায়ে তাদের কাছে কতটা গুরুত্ব পায় এবং তারা ভূমিকা গ্রহণ করে সে বিষয়টিও তুলে ধরতে উদ্যোগী হওয়া। তার সঙ্গে নারী শ্রমিক, শ্রমজীবী নারীর প্রত্যেকের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রাপ্য আইনি অধিকার বিষয়ে অবহিত হওয়া এবং আদায়ের পথ নিয়ে সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া, কারণ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ক্ষমতা তৈরি হয় নিজের ভেতর থেকে, যন্ত্রণাবিদ্ধ মানুষই নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করে আর সেই শক্তিকে সংগঠিত করে সংগঠিতভাবে প্রতিকার এবং নতুন পথ নির্মাণে এগিয়ে যায়। নারীর এই শক্তি যত দৃঢ় হয়, ততই তার চলার পথের বাধা অতিক্রম সহজ হয়। মনীষী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের যে আহ্বান—‘ওঠ জাগো গো ভগিনী-বুক ঠুকে বল-আমরা মানুষ। ’ আর তাঁর মানসকন্যা সুফিয়া কামালের আহ্বান পথের কাঁটা সরিয়ে দাও আজ নারী আন্দোলন কর্মীদের কাছে, শ্রমজীবী নারীদের কাছে এই বার্তাই তুলে ধরছে—যেন নারীরা দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করে।
আপন তেজে জ্বলার শক্তি আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়েই অর্জন করতে হবে, দৃশ্যমান করতে হবে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাফল্য অনেকখানি নির্ভর করে ভুক্তভোগীর শক্তিময় কার্যকর ভূমিকার সফলতার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালের ২০ জনু থেকে ২০১৯-এর ২০ জুন কবি সুফিয়া কামালের ২০তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর শক্তিময় রূপ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দ্রোহী ভূমিকাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায়।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ