জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস এবং ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ দেশে দেশে পালিত হয়। অন্যান্য দিবসের মতো এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে।
১৯০৮ সালের ৮ মার্চ অসংখ্য নারী শ্রমিকের বিক্ষোভ এবং পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ এই দিনটিকে বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে। ১৯১০ থেকে নারীদের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ক্রমগৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
নেপথ্যে রয়েছে জানা-অজানা বহু নারীর নিরলস পরিশ্রম এবং জীবন উৎসর্গকৃত রক্তাক্ত অধ্যায়।
১৯৪৬ সালে জাতিসংঘে নারীর মর্যাদাবিষয়ক কমিশন গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে গৃহীত হয় সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ। ১৯৭৫ সাল আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ, ১৯৭৬-৮৫ পর্যন্ত নারী দশক, ১৯৭৯ সালে সিডও সনদ গ্রহণ এবং এরই মধ্যে চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। নারীর মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের উদ্যোগে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বেইজিং+ মূল্যায়ন সভা অনুষ্ঠিত হয়। বেইজিং+২৫-এর সভা কভিড-১৯-এর কারণে স্থগিত আছে। নারীর জন্য বিশেষ বিশেষ দিবস, সনদ, সম্মেলন, মূল্যায়ন সভা থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২৫ নভেম্বরকে আরেকটি বিশেষ দিবস হিসেবে কেন গ্রহণ করে?
ডোমেনিকান রিপাবলিকে রাফেল লিওনিভাস ট্রুজিলো প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিন দশক শাসন করেন। স্বৈরশাসক ট্রুজিলোর অত্যাচারে দেশবাসী অতিষ্ঠ থাকে। বিশেষত নারীরা যখন-তখন তাঁর ভোগের সামগ্রীতে পরিণত হন এবং নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জনমনে এর জন্য ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না মোটেও। মিরাবেল সিস্টার্স হিসেবে পরিচিত ভগিনীত্রয় প্যাট্রিয়া, মিনার্ভা আর মারিয়া তেরেসা এই লৌহকঠিন শাসকের দেশবাসী ও নারীর ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় অবস্থান নেন। চার বোনের এক বোন আদেল মিরাবেল কোনো রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন না। কিন্তু তিন বোনের মৃত্যুর পর তাঁদের ছেলে-মেয়েদের লালন-পালন করা এবং বোনদের স্মৃতিতে প্রথম মিরাবেল সিস্টার্স ফাউন্ডেশন ও মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার কাজ তিনিই করেন। মিরাবেল ভগিনীত্রয়ের ইতিহাস দেশের জনগণ ও নারীসমাজের জন্য প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ইতিহাস। বড় বোন প্যাট্রিয়া প্রথাগত উচ্চশিক্ষা না নিয়েই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর বক্তব্য, ‘We cannot allow our children to grow up in their corrupt and tyranical regime. We have to fight against it.’ মিনার্ভা ছিলেন সবচেয়ে সপ্রতিভ এবং প্রতিবাদী। আইনে ডিগ্রি নিয়েও ট্রুজিলোর যৌন উত্পীড়নের শিকার হয়ে আইন পেশার লাইসেন্স নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। বহু নির্যাতন সহ্য করে তিনি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। নিজ সংগ্রাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘It is a source of happiness to do whatever can be done for our country that suffers so many anguishes.
It is sad to stay with one’s arms crossed.’ ছোট বোন মারিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ শেষে তিনিও একই পথে চলেন এবং বলেন, ‘We shall continue to fight for that which is just.’ প্রেসিডেন্ট ট্রুজিলোর নির্দেশে সিক্রেট পুলিশ ফোর্স নির্মম নির্যাতন চালিয়ে নির্ভীক এই তিন বোনকে ১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর হত্যা করে। ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন সংগঠনের ২০০ নারী প্রতিনিধি এক সম্মেলনের মাধ্যমে ২৫ নভেম্বরকে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৮৩ সালে ভিয়েনার মানবাধিকার সম্মেলনে তা সমর্থিত হয়। এই ধারাবাহিকতায় জাতিসংঘ মিরাবেল ভগিনীত্রয়ের সম্মানে দিনটিকে বিশেষ দিবস হিসেবে গ্রহণ করে। এই দিবসের পেছনে রয়েছে নারীর দেশপ্রেম, অন্যায়-অবিচার এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কিন্তু এই দিবস ও পক্ষ পালনের শেষ পাঁচ বছরের প্রতিপাদ্য এক নজরে দেশে দেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থানকে বুঝতে সাহায্য করে।
2015@End violence against women and girls.
2016@Raise money to end violence against women and girls.
2017@Leave no one behind end violence against women and girls.
2018@Hear me too.
2019@Generation equality stands against rape.
2020@Fund, respond, prevent, collect.
প্রতিটি প্রতিপাদ্য স্পষ্ট করে যে একুশ শতকের পৃথিবীতেও নারী সমতাপূর্ণ মানব অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং দৈহিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত ও নিপীড়িত। দেশভেদে শুধু মাত্রাভেদ রয়েছে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি আমরা ফিরে তাকাই, তবে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রেক্ষাপটে নারী উন্নয়নে আমাদের অর্জন অনেক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় এবং প্রশংসনীয়। সংসদে, সরকারে, সশস্ত্র বাহিনীতে, সব পর্যায়ের সরকারি-বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে ও চ্যালেঞ্জিং পেশায় আমাদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দেশে ও অভিবাসী হিসেবে নারীর শ্রমের অবদান উল্লেখযোগ্য। অথচ প্রদীপের নিচের অন্ধকার রয়ে গেছে। পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের জন্য হিংস্রতা, যৌন উত্পীড়ন-নির্যাতন, বাল্যবিয়ে, এসিড সন্ত্রাস, নারীপাচার ও অপহরণ, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, সাইবার ক্রাইম, হত্যা, আত্মহত্যায় বাধ্য করা, ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, অভিবাসী নারী শ্রমিকের নির্যাতিত ও লাশ হয়ে ফেরা নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, এমনকি মর্গেও নারী নিরাপদ নয়। এভাবে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি জাতিসংঘও উদ্বেগ জানিয়েছে।
দেশের নারী ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীরা সব সময়ই গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসনের দাবি জানিয়ে আসছে। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান এক বড় হুমকি। কভিড-১৯ মহামারির মধ্যে দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, অবাধ পর্নোগ্রাফি-মাদক, ক্ষমতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পরিপুষ্ট বেপরোয়া সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নারীর নিরাপত্তা এখন অনিশ্চিত।
সব মিলিয়ে এক কঠিন সময়ে নারীসমাজ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ২৫ নভেম্বর শুধু নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পালনীয় দিবস নয়, এর সঙ্গে জড়িত সব ধরনের মানবাধিকার আদায়ের সংগ্রাম, গণতন্ত্র-সুশাসন-সমতা আদায় ও সব বিভাজন বিলুপ্তির সংগ্রাম। কভিড-১৯ আক্রান্ত সময়কালে আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন ও প্রতিরোধের এই বিশেষ দিন এবং পক্ষ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের কাছে সবিশেষ হয়ে উঠুক।
নারী নির্যাতনের ও বৈষম্যের বিদ্যমান কারণগুলো দূরীকরণে রাষ্ট্রের সদিচ্ছা যেমন আবশ্যকীয়, তেমনি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সচেতনতা জরুরি। তার জন্য নারীর মানবাধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাস, নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ইতিহাস ফিরে দেখা ও মূল্যায়নের প্রয়োজন তাই জরুরি।
লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ