আমাদের দেশ উন্নত থেকে উন্নততর হচ্ছে। তার প্রমাণ হিসেবে আমরা বলি আমরা অর্থনীতিতে কত এগিয়েছি। আমাদের শহরগুলোর উঁচু উঁচু ইমারত, ঝলমলে বিপণিবিতান, রাস্তাভর্তি গাড়ি, এমনকি গ্রামেও মাইলের পর মাইল পাকা রাস্তা, পাকা দালানকোঠা। আমাদের মফস্বল শহরেও বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ। আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে। আরও অনেক কিছুতে এগিয়ে গেছি আমরা, এ রকম নানান বাহাস আমাদের। আমরা এতই উন্নত যে আমাদের গলি-ঘুপচিতেও তিন পা এগোলেই শিক্ষালয়। শুনেছি উন্নত দেশে যে কেউ ইচ্ছে করলেই যেকোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে পারে না। প্রতিষ্ঠান তৈরির আগে সরকারি অনুমোদন লাগে। দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য নীতিমালা থাকে। অনেক নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমতি নিয়ে তবেই কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে। কিন্তু আমাদের উন্নত দেশে এসব ছাড়াই রাতারাতি ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নানান কিসিমের শিক্ষালয়, কী এর উদ্দেশ্য, তাতে জনস্বার্থ আছে কি নেই, তাদের কার্যক্রম রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, সেসব দেখার জন্য কি সুনির্দিষ্ট লোক আছে এবং তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে কি না, আমজনতা কিছুই জানে না। এক শ গজ দূরত্বে দুই-তিনটি কিন্ডারগার্টেন, দুই-তিনটি মাদ্রাসা। এই যে এক শ গজের ভেতর এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটা বাড়ির দুই-চারটি কক্ষ নিয়ে গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানে না আছে খেলার জায়গা, না আছে মানসম্মত শিক্ষক, না আছে শিক্ষা কারিকুলাম। যা খুশি পড়াচ্ছে, শেখাচ্ছে। সেসব কে দেখে?
সেদিন দুপুরে ভাইঝিকে কোচিং সেন্টারে দিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছি। শহরের কোনো এলাকার একটি পুকুরপাড়ে বসে পুকুর, আশপাশের ঘরবাড়ি ও চলন্ত মানুষ দেখছি। কতগুলো শিশু-কিশোর পুকুরপাড়ের এ-মাথা থেকে ও-মাথাজুড়ে পায়চারি করছে। কয়েকজনকে ডেকে কথা বলতে চাইলাম। অনেকেই এড়িয়ে গেলেও দুটি শিশু কাছে এল। তারা মাদ্রাসার ছাত্র। বয়স আট-দশ বছর। দুই বছর হলো এখানে পড়ছে, তার আগে কিছুদিন সরকারি স্কুলে পড়েছে। তাদের বাবারা বিদেশে থাকেন। ‘স্কুল ছেড়ে মাদ্রাসায় পড়তে এলে কেন?’ বলল, স্কুল থেকে মাদ্রাসা ভালো। মাদ্রাসার হুজুররা সম্মানিত লোক। কিন্তু স্কুলের শিক্ষক বুড়ো হলেও কেউ পুছে না। মাদ্রাসায় পড়ে তারাও একদিন হুজুর হবে। বাংলা বই পড়ে কি না, জানতে চাইলে বলে, একটা বাংলা বই আছে। কিন্তু সেটা বেশি পড়ানো হয় না। তারা বাংলা ছড়া-কবিতাও শেখে না। সেদিন বাংলা নববর্ষ ছিল। এ বিষয়েও তারা কিছু জানে না। বলে, আমরা ইতান (মানে নববর্ষ পালন) করি না। শিশু দুটোকে কথা বলতে দেখে একটু বড়রা ওদের ডেকে নিয়ে গেল। বোঝা গেল একজন অচেনা নারীর সঙ্গে কথা বলাটা ওদের পছন্দ নয়। একটু পর তারা আবার রাস্তায় ফিরে এল। সঙ্গে বড় দুজন। পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে গেল, মাদ্রাসা ভালো। স্কুল বাজে জায়গা। স্কুলে সব সন্ত্রাসী, নেশাখোর ও বাজে লোক তৈরি হয়।
একটা ভাত টিপলে যেমন হাঁড়ির পুরো ভাতের খবর পাওয়া যায়, ওপরে বর্ণিত শিশুদের কথাবার্তা শুনেও বোঝা যায় ওখানে কী সব হচ্ছে। দেশের শিশুদের একটা অংশ যারা সংখ্যায় মোটেই কম নয়, তারা বাংলা ভাষার বই পড়ে না, বাংলা কবিতা, গান ও সংস্কৃতির কিছুই জানে না। তারা জানে স্কুলের শিক্ষকেরা সম্মানিত নয়, শিক্ষার্থীরা সবাই সন্ত্রাসী ও খারাপ।
কথা হচ্ছে, এই যে গলি-ঘুপচির প্রতিষ্ঠানগুলো কোমলমতি শিশুদের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে তাদের সরল মনে শিক্ষার নামে নানা রকম বিষ ঢোকাচ্ছে, সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে, তার খোঁজখবর কি রাখছেন যাঁদের তা রাখার কথা? রাখলে এসব হচ্ছে কী করে? দেশে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে কথা উঠলে তা অস্বীকার করেন নীতিনির্ধারকেরা। ঠেকায় পড়লে বলেন, এসব প্রতিরোধের দায় নাগরিক সমাজেরও আছে। এই যেমন সেদিন এক জায়গায় বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার সম্পর্কে অভিযোগ উঠলে উপস্থিত সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বললেন, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিস্তার ঠেকাতে মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তন দরকার; কিন্তু সেটা একা সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। হ্যাঁ, কোনো কাজই সরকারের একার নয়; বিশেষ করে সেটা যখন জনগণের সরকার হয়। আর সরকারে যাঁরা আছেন তাঁরা তো জনগণেরই অংশ। কাজেই মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনে সরকারসহ সব সচেতন মানুষের ভূমিকা থাকা অবশ্যই উচিত।
তবে এমন কিছু কাজ আছে, যা কেবল সরকারই করতে পারে। যেমন ওপরে যে শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হলো, তা কি কোনো নাগরিক সমাজের পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব? হেফাজতের মামুনুলের বিপক্ষে কী বলেছিলেন ঝুমন দাশ? বলেছিলেন, লোকটি সাম্প্রদায়িক উসকানি দিচ্ছেন। ভণ্ড মামুনুলের বিরুদ্ধে কথা বলাকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার দোহাই দিয়ে কতগুলো নিরীহ মানুষের ওপর হামলা হলো, জেল খাটলেন ঝুমন দাশ। সম্প্রতি হৃদয় মণ্ডল ছাত্রদের বিজ্ঞান শেখাতে গিয়ে জেলে গেলেন।
যখন-তখন সংখ্যালঘু কারও বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগ দিলেই যাচাই-বাছাই ছাড়াই মামলা হয়ে যায়, নিরপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে জেলে আটকে রাখা হয়। অথচ সংখ্যালঘুদের মন্দিরে হামলা, বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ঘটলে এর বিচার হয় না। কিন্তু এদেরও তো অনুভূতি আছে, তাদের মর্মেও আঘাত লাগে। সেসব বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিচার। দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে এসব বন্ধ হতো। শাস্তি দিয়ে যদি অ্যাসিড নিক্ষেপ বন্ধ করা যায়, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করা যাবে না কেন? কারণ রাজনীতি। ভোটের ও ক্ষমতার রাজনীতি। মৌলবাদীরা ক্ষমতা ও ভোটের দাবার ঘুঁটি। সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী সংখ্যালঘুদের থেকে সংখ্যায় বেশি। তাদের বিচার করলে যদি ভোট হারিয়ে যায়, তাই ভয়! না হলে সরকার ভয় পাবে কেন? তার হাতে ক্ষমতা। অপরাধীর বিচার হবে। তারা কোন ধর্মের, কোন দলের—এসব দেখার কথা ছিল না। সংবিধানেও বলা আছে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গনির্বিশেষে রাষ্ট্র থেকে সমান সুযোগ লাভ করবে। কিন্তু এখন কথায় কথায় সবকিছুতে নব্বই ভাগের অগ্রাধিকার দাবি করা হয়। বাকি দশ ভাগ তবে কিছুই না! আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ-জাতীয় আবদারের প্রতিবাদ করা হয়নি; বরং ভোটের ও ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে অসহায় সমর্পণ দেখি। জামায়াতিদের কাছে, হেফাজতিদের কাছে সমর্পণ।
নাগরিক সমাজের মাঝেও হেফাজতি, জামায়াতি, মৌলবাদীরা আছে। আর আছে বিরাট একটা অসচেতন সমাজ। যারা নিজেরাই নানা রকম শোষণের শিকার হয় অসচেতনতার কারণে। বাকি রইল সচেতন ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ। তারা তো আদর্শগতভাবে সংখ্যালঘু। তবু প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিকারের পাশাপাশি মানুষের মনোজগতে পরিবর্তনের জন্য তারা তাদের কাজ করছে। কিন্তু এখানে এসেই ঠেকে যেতে হয় তাদের। ধর্মের আফিম খাইয়ে রাখা বিশাল অর্বাচীন জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে গেলে অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ ঘাড়ে এসে পড়ার ভয় এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে যে মানুষ শঙ্কিত! অথচ এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই হতে পারত বড় সহায়ক। দিনের পর দিন মানুষের মনোভূমিতে যে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বীজ রোপিত হচ্ছে, রাষ্ট্র তার আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমেই তা উপড়ে ফেলতে পারত। কিন্তু যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাঁরা কি নির্মোহভাবে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের গোড়ায় নিড়ানি দিয়ে এ সমাজমানস থেকে সব আগাছা উপড়ে ফেলতে পারবেন?
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : আজকের পত্রিকা