নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সেই উক্তি যা কোটি কোটিবার কোটি কোটি কণ্ঠে উদ্ধৃত হয়েছে- আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দেব। বলতে চাই, মায়েদের মানে নারীদের শুধু শিক্ষা নয়, শিক্ষার সঙ্গে ক্ষমতাবান করে দাও তবে জাতি শিক্ষিত হবে; যদি শিক্ষার অর্থ হয় সভ্যতা তবে নারীকে ক্ষমতাহীন করে রেখে সভ্য বা শিক্ষিত জাতি গড়া সম্ভব নয়। এখন দেশে শিক্ষিত নারী অনেক। শিক্ষার একটা ক্ষমতা থাকলেও শিক্ষা সকল নারীকে ক্ষমতায়িত করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার পরও লক্ষ লক্ষ নারীকে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় না। তাকে আর্থিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল রেখে অনেক অশিক্ষিত পুরুষ তাকে ডমিনেট করছে। এসব নেতিবাচক দৃষ্টান্ত পুরুষতন্ত্রী মানুষকে এই বার্তাই দেয়- নারী তুমি যত শিক্ষিত হও না কেন তোমার স্থান পুরুষের নিচে।
আর এমন ভাবনা নারী-পুরুষের বৈষম্য কমাতে নিরুৎসাহিত করে। নারীর ওপর শোষণ পীড়ন চালাতে প্রণোদনা জোগায়। তাই দেশ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণসহ সকল প্রকার শোষণ নির্যাতন বন্ধ করতে হলে আগে দরকার জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা। কেবল এর মাধ্যমেই সভ্য জাতিসত্তা হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারব আমরা। কেননা চকচকে দালানকোঠা, চমৎকার যানবাহন, রাস্তাঘাট আর ঝকঝকে পোশাক পরা তেলতেলে শরীর কখনই সভ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। বনের অনেক হিংস্র জীবজন্তু আছে যাদের দেহ মসৃণ আর সুন্দর। তাও মানুষই সভ্যতা সৃষ্টি করেছে উন্নত রুচিবোধ, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি তার মমত্ববোধের মাধ্যমে মানবিকতার উন্মেষ ঘটিয়ে। কিন্তু মানুষে মানুষে ব্যবধান বা বৈষম্য সৃষ্টি করে মানুষই সে সভ্যতাকে ধ্বংসের পথে এনে দাঁড় করিয়েছে। তাই মানবিক চর্চার ভিতর দিয়ে তাকে আবার তার সভ্যতার বিনির্মাণ করতে হবে। সেজন্য বৈষম্যের মূল উৎপাটন করতে হবে মানুষের মন থেকে। তার পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। তবে এগিয়ে আসতে হবে সমাজকেও। কারণ মানুষের মনের ভিতর যে নারীর প্রতি ক্রূরতার, অমানবিকতার জঞ্জাল সৃষ্টি হয়ে আছে তার জন্য সমাজেরও অনেক দায় আছে। এ প্রসঙ্গে তাই দু’একটি গল্প শোনা যাক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফকিরাপুলের গোড়ায় একটি প্রায় আধা অন্ধ বা অন্ধের ভেক ধরা ভিখারি থালা নিয়ে হাত পেতে ভিক্ষা করে। তবে তার রুক্ষ ময়লা চুল, দাড়ি আর ধুলোমলিন পোশাকের ভিতর জীর্ণ-শীর্ণ শরীরেও প্রচন্ড পুরুষালি তেজ। বারবার হাত পাতার পরও কেউ দুটো টাকার ভিক্ষে দেয়নি। তাই ক্ষেপে যায় সে। ক্ষেপে গিয়ে তেজের প্রচন্ডতা তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া দুজন মধ্যবয়সী নারীর ওপর বর্ষণ করে। তার প্রকাশ করার ভঙ্গিটা সরাসরি নয়। ওই নারী দুজনকে টার্গেট করে তার ভিক্ষার সঙ্গীকে সম্বোধন করে বলছে, মা গো মা! অতলা মাগী দেখলাম, অতলা মাগীর ঠাঁই হাত বাড়াইলাম একটা মাগী দুইডা টেকা দিল না। শালার মাগীরা…।
তার সঙ্গী বলে, মাগীরার কাছে বোধহয় টেকা নাই। থাকলে না তরে দিব? সঙ্গীর সান্ত্বনায়ও সে নিরস্ত হয় না। বরং দ্বিগুণ তেজে দগ্ধ হয়ে সে বলে, নাই তে ফুটানি মারাইয়া রাস্তায় বাইর অইছে ক্যান?
সেই সঙ্গী জবাবে কি বলেছিল মধ্যবয়সী নারী দুজন আর শোনেননি। তাদের কাছে খুচরো টাকা ছিল না বলে ভিক্ষে দিতে না পেরে এমনিতেই লজ্জিত ছিলেন। তারপর ফকিরের মুখে গালাগালি শুনে তারা দ্রুত হেঁটে সেখান থেকে সরে যান। তারা বলেন, কী দুনিয়া আইল গো, রাস্তার ফকিরেও গালাগালি করে!
ওই দুজন সহজ সরল নারী মনে করেন বর্তমান দুনিয়াটাই শুধু খারাপ, যেখানে রাস্তার ফকিরও গালাগালি করে। কিন্তু তারা এর ব্যাখ্যা খুঁজতে যান না বা এর কারণ খুঁজতে অতীত ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করেন না। তারা ভাবেনও না রাস্তার ফকিরও একজন নারীকে মাগী বলে সম্বোধন করে কেন? হয়তো ভাবার মতো সময় তাদের নেই বা ওইটুকু বিস্ময় আর তাদের মস্তিষ্ককে তেমন আলোড়িত করতে পারে না। তাই বিস্ময়ের বুদ্বুদ হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে তারা নিত্য ঘরকন্নায় মজে যান। কিন্তু রাস্তার ফকির জানে সে একজন পুরুষ। যেমন নারীরা জানে তারা একজন নারী তাই অনেক কিছু আড়াল করতে হয় অনেক ক্ষেত্রে পালিয়ে যেতে হয়। সমাজ তাদের এভাবেই শিখিয়েছে। কিন্তু রাস্তার ফকিরও তার পৌরুষের মহিমা জানে। সে আরও জানে, নারীরা নারী হিসেবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে দুর্বল। কখন নারীর দাম তার মতো ভিখারির থেকেও কত কম। নারী সম্পর্কে তার অর্জিত এই জ্ঞান তাকে সাহস জুগিয়েছে বা বলা যায় একটা অহংকার এনে দিয়েছে। যে কারণে নারী ছাড়া যেহেতু তারচেয়ে কম দামের আর কেউ নেই তাই সে তাদেরকে মাগী বা আরও অশ্লীল কিছু বলার অধিকার রাখে। আর এই বলতে পারাটা, গালাগালি বা অশ্লীল সম্বোধন তার একটা অস্ত্র, এটাও সে জানে। এমনকি এটাও জানে যে দু’চারজন মুখরা নারী ছাড়া আর সকলেই গালি নামের এসব অস্ত্রের কাছে কুপোকাত হয়।
নারীর কাছে ভিক্ষার হাত বাড়ানোর পর ফকির হয়েও সে যে সেই নারীদের প্রতিই অশ্লীল বাক্যবাণ প্রয়োগ করল এ স্পর্ধা তাকে দিয়েছে পুরুষতন্ত্র। নারীর প্রতি এই অশ্লীল গালিগালাজকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার লাইসেন্স দিয়েছে পুরুষতন্ত্র। ‘পুরুষতন্ত্র’ শব্দটি উচ্চারণ করলে, এ নিয়ে কথা বললে, এর কঠোর ধারক-বাহকরা তেলে বেগুনে জ¦লে ওঠেন। অথচ পুরুষতন্ত্রে শিশুকাল থেকেই অশ্লীলতা ও গালাগালিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের পাঠ নিয়ে বেড়ে ওঠে অধিকাংশ পুরুষশিশুরা। এ অস্ত্র তারা তাদের খেলার সঙ্গীর সঙ্গে ঝগড়ার সময় ব্যবহার করে কিন্তু কিছু না বুঝেই তার অস্ত্রটা যার ওপর প্রয়োগ করে তিনি একজন নারী। ওই প্রতিপক্ষ শিশুর মা ও বোন। এবং শুধু শিশু নয়, শিশু থেকে সকল বয়সের পুরুষই তার প্রতিপক্ষ পুরুষকে ঘায়েল করতে চায় তার মা-বোনদের প্রতি অশ্লীল বাক্যবাণ বর্ষণ করে। ছোট শিশুটি যে নর-নারীর অন্তর্গত শারীরিক সম্পর্কের ক্রিয়া প্রক্রিয়ার কিছুই বোঝে না সেও যখন তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য প্রতিপক্ষের মা-বোনকে ধর্ষণ করবে বলে হুমকি দেয় তখন আতঙ্ক হয়, কান্না পায় এই কারণে, এসব নিষ্পাপ শিশুদের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতির পরিবর্তে ঘেন্না লাগে বলে। তাদের যে মুখ থেকে আধো আধো বোল শোনার কথা আমাদের সেই মুখ থেকে যখন আবর্জনা ও জঞ্জাল বের হয় ভাবতে পারি না এরা বড় হলে কী হবে বা কী করবে?
সেদিন ভিড়ের মধ্যে কয়েকটি উঠতি বয়সের ছেলেকে বলতে শুনি- ‘ধর্ষণ হইলে খালি ছেলেদের দোষ! এই যে মেয়েগুলো বেপর্দা চলতাছে তার কোনো দোষ নাই?’ মেয়েগুলোর দিকে চেয়ে দেখলাম। তারা নিজেদের বন্ধুদের সঙ্গে উচ্চস্বরে হাসাহাসি করছিল। ওই ছেলেগুলোর কাছে সেটাই বেপর্দা। এমন কথা শুনে মুখ চুলবুল করে, পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। নিজেকে সামলে বলি, তুমি মোবাইল ফোনে কী করছ? আদতে ছেলেটি তখন তাতে হিন্দি সিনেমার ধেই ধেই নৃত্য দেখছিল। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বলল, যাই দেখি আপনাকে বলব কেন? আমি বললাম, তাহলে ওই মেয়েগুলো হাসাহাসি করছে তাতে তোমার কী? তার উত্তর ছিল ‘মেয়েরা এমন বেপর্দা চলবে কেন?’
আচ্ছা! তা মোবাইলে তুমি যা দেখছ, তোমার কথামতো তারা তো আরও বেশি বেপর্দা! তবে তুমি মগ্ন হয়ে তাদের দেখছ কেন? নাকি তোমার এসব দেখার রাইট আছে? কেন? ছেলে বলে?
সে একটু থতমত খায় প্রথমে। পরে সামলে নিয়ে নিজের ধারণা ঠিক প্রমাণ করতে বলে, ‘আমাদের, ছেলেদের জন্য এমন কোনো বাধা-নিষেধ নেই।’ অ! তাহলে তোমরা বেপর্দা নারী দেখতে চাও আবার নারী যাতে বেপর্দা না হয় সেটাও চাও তাই না? বাবা রে, একসঙ্গে কি দুটো সম্ভব? আচ্ছা ধরো, সব নারী যদি তোমাদের ইচ্ছামতন পর্দানশীন হয় তবে মোবাইল ফোনে যা দেখছ তা তো আর তৈরি হবে না। ঠিক তো? তাহলে এই যে তোমাদের দেখার ইচ্ছে যা দেখার রাইট আছে বলে তুমি বা তোমরা মনে করো, তা দেখবে কী করে? এবার সে স্তব্ধ হয়। তবে সেটা আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে, লজ্জা বা ভুল হয়েছে বলে নয়। কারণ পুরুষতন্ত্র ছেলেদের জন্য লজ্জা পাওয়াটাকেই লজ্জাজনক বলে ছেলেদের কানমন্ত্র দিয়েছে। তাই নিজেদের পুরুষ প্রমাণ করতে ওরা নির্লজ্জতার পাঠ নেয় শৈশব থেকেই। অতএব সে ক্রুদ্ধ হয়। ক্রোধ প্রকাশ করতে সে আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। তখন তার এক বন্ধু তাকে নিয়ে চলে যায়।
আমাদের আশপাশে এমন মনোভাবাপন্ন বিভিন্ন বয়সী পুরুষ বসবাস করে বা এদের মাঝেই নারী ও কন্যাশিশুকে বসবাস করতে হয় বলেই তো আজ নারীর শরীর কোথাও নিরাপদ নেই। শিকারি হায়েনার মতো তারা সারাক্ষণ ওত পেতে থাকে। আজ যে একটি মেয়ে ধর্ষণের পর মৃত্যুবরণ করল কেননা তাকে শুধু ধর্ষণই করা হয়নি তার সঙ্গে বিকৃত যৌনাচারের মাধ্যমে এত আঘাত করা হয়েছে যে সেই আঘাত ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে এই ঘটনায় জড়িত একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে স্বীকারোক্তি দিয়েছে যে সে এই কাজের জন্য দায়ী। এ নিয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়া সরব। এটা থাকবে কিছুদিন। অনেকে নসিহত করবে- নারী সংগঠনগুলো কী করছে? এমনভাবে বলবে যেন তারা নারী সংগঠনের কর্মীদের বেতন দেয় যেজন্য এর বিরুদ্ধে কেবল নারী সংগঠনগুলোকেই অ্যাকশনে যেতে হবে। অন্যরা কেবল আহা উহু করে দায়িত্ব শেষ করবে। বিষয়টা যেন এরকম যে, নারী সংগঠনগুলো অ্যাকশনে গেলেই মানে রাজপথ কাঁপালেই রাতারাতি ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে অথবা একটা দুটোর শাস্তি হলেই তা বন্ধ হয়ে যাবে।
আদতে বিষয়টি অত সরল নয়। দেখলাম এই নিয়ে দুদিন ধরে টেলিভিশনে টক শো হচ্ছে। ধর্ষণ কেন বাড়ছে, কেন থামছে না, কেন এত নিষ্ঠুরতা? মনোবিদ, অপরাধ বিজ্ঞানীরা এর নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বা তাদের কাছে থেকে ব্যাখ্যা জানতে চায় টক শোর সমন্বয়কারী। বলি কে শোনে এসব কথা? বছরের পর বছর ধরে নারী- সে শিশু কিশোরী তরুণী যে কোনো পর্যায়ের হোক এমনকি প্রায় মধ্যবয়সী নারীদের ওপরও বিকৃত যৌন নির্যাতন হচ্ছে আর টেলিভিশনে বছরের পর বছর ধরে এজাতীয় টক শো হচ্ছে। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ হচ্ছে তাতে কি সমাজ মানস পরিবর্তন হচ্ছে নাকি রাষ্ট্র এর আলোকে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে!
তাই আমাদের যেতে হবে ঐ সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণের বক্তব্যের মূলে- যে মনে করে, খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে মেয়েগুলোর উচ্চস্বরে হাসাহাসিটাও বেপর্দা, বোরকা না পরা বা আঁটোসাঁটো বোরকা পরা হলো বেপর্দা এবং একারণে মেয়েরা ধর্ষিত হলে ছেলেদের কোনো দায় নেই এবং যে মনে করে একজন ছেলে হিসেবে সিনেমার অশ্লীল নৃত্য ও প্রায় উদোম গায়ের মেয়েদের কিংবা পর্নোগ্রাফি দেখার অধিকার তার আছে। আমাদের যেতে হবে সেই ভিখারির মনোবিকলনের মূলে, যে ভিক্ষা না দেওয়ার অপরাধে পথচারী নারীদের গালাগাল দেয় আর ক্ষমতাহীন নারীর রাস্তায় বের হওয়াকে অন্যায্য মনে করে। যেতে হবে ফুলের মতো যে শিশুরা তার খেলার সঙ্গীর মা-বোনকে ধর্ষণ করবে বলে হুমকি দেয় তার মূলে।
ঐ তরুণ যে কথাগুলো বলেছে সে তো আর এখনো কোনো বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেনি যে নিজে থেকে এসব বলেছে। আদতে সে যা বলেছে তা এই সমাজের শেখানো বুলি যা শুধু সে ধারণ করেছে এবং সারাজীবন বহন করে যাবে যা বহন করে আছে ঐ ভিখারি আর তারা তা রপ্ত করেছে সেই শৈশব থেকে। ওই শিশুগুলো যখন কাউকে ধর্ষণ করার হুমকি দেয় তার অভিভাবক তাকে বাধা দেয় না। বাধা দেবে কী, শিশুগুলো তো তার বাবা কাকা ভাইদের থেকেই শুনতে শুনতে শেখে। সমাজ এদের বাধা দেয় না। এখনো সমাজ কোনো ধর্ষককে কোনো লম্পটকে ঘৃণা করে না। সমাজ থেকে অপাংক্তেয় করে না। একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে অভিভাবক তা লুকিয়ে রাখতে চায় কারণ তাতে মেয়েটির বিয়ে হবে না। কিন্তু যে ছেলে একটি ধর্ষক বা লম্পট তা জানাজানি হলেও তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে কেউ আপত্তি করে না। যদিও বা তার বিরুদ্ধে এখন অভিযোগ ওঠে তাকে বাঁচানোর কত ফন্দিফিকির খোঁজা হয়। শুধু ছেলেটির পরিবার নয়, সমাজের লোক, পুলিশ প্রশাসন, আইনের যারা রক্ষক তারা সকলেই। বলা হয়, মেয়েটির পোশাক এই ছিল, মেয়েটি চরিত্রহীন ছিল, মেয়েটি কেন ওইখানে গেল বা মেয়েটি স্বেচ্ছায় গেছে ধর্ষিত হতে সেজন্য তার বয়স বাড়িয়ে দেওয়া হয় আর ছেলেটির বয়স কমিয়ে দেওয়া হয় যাতে সাজা হলেও জুবেনিল আইনে তার সাজা লঘু করা যায। যেমন মাস্টারমাইন্ডের মেয়েটির বয়স সতের। কিন্তু তার বাবা-মা’র কথা গ্রহণযোগ্য হয় না। গ্রহণযোগ্য হয়, ধর্ষক দিহান হাসপাতালে ভর্তির সময় যে লিখেছে উনিশ সেটা।
আবার দিহানের মা একটা আবেদন করে জানাচ্ছেন, তার ছেলেকে যেন ধর্ষকের তকমা না দেওয়া হয়। তিনি বলছেন, তার ছেলে এই কাজ করেছে তবে এটা ধর্ষণ নয়! ছেলেমেয়ে স্বেচ্ছায় এই কাজে লিপ্ত হয়েছিল। দিহানের মা একজন নারী। তবে সাধারণ নারী। তার সমস্ত আবেগ তার সন্তানকে ঘিরেই। তাই ধর্ষক ছেলেকে বাঁচানোর এই কৌশল যে নারীত্বের অপমান এটা সে বুঝতেই পারছেন না। বুঝলেও সন্তানের মা হিসেবে সন্তানকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু অন্যদের এত দায় কেন?
তবে দিহানের মায়ের আকুল আবেদন- ‘আমার ছেলের গায়ে ধর্ষকের তকমা দেবেন না’। বিষয়টা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। হয়তো দিহানের পরিবার সমাজের এমন একটা অবস্থানে বিলং করছে যেখানে ছেলেটা ধর্ষক হলে, মা হিসেবে বা পরিবার হিসেবে হেয় হওয়ার আশঙ্কা আছে বা ছেলেকে নিয়ে তার যে উচ্চবিলাসী স্বপ্ন ছিল তাতে ওর ক্যারিয়ার ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে জেনে সে আতঙ্কিত। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষক ছেলেদের মায়েদের মনে ও পরিবারের মনে যদি এই আতঙ্ক বিরাজ করার মতো অবস্থা তৈরি করে দেওয়া যায় তাহলে পরিবেশ পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করবে। অবশ্য কথা উঠছে, কোনো বাবা-মা চায় না, তাদের ছেলে ধর্ষক হোক। কিন্তু হয়ে গেলে তাকে শাসন করার বাবা-মা কজন পাওয়া যাবে খুঁজে দেখেন। শাসনের পরিবর্তে দেখবেন প্রশ্রয়ের সুর- ছেলে মানুষরা তো এরকম কিছু করবেই। তা না হলে কীসের পুরুষ? তাকে এভাবে পুরুষ হওয়ার পাঠ দেয় পরিবার ও সমাজ। পুরুষ হওয়ার পরও যখন ঘরে বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে অফিসে, কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায় বাসে ট্রেনে সুযোগ পেলেই যে কোনো বয়সী নারী ও শিশুকে যৌন হয়রানি করে, ধর্ষণ করে তখনো পরিবার সমাজ-পুরুষ মানুষের এরকম দোষ একটু থাকবেই বলে প্রশ্রয় দেয়। তার সঙ্গে অফিসিয়াল নন-অফিসিয়াল সমস্ত কাজই চলে এমনকি তাকেই হয়তো সামাজিক বিচারকাজেরও কর্তা হিসেবে মেনে নেয় সমাজ।
কিন্তু যদি পুরুষ হওয়ার সুযোগে এই সমস্ত লাম্পট্য, বদমায়েশীর জন্য লম্পট, বদমাশ ধর্ষকদের বিরুদ্ধে ছিছিক্কার উঠত, যদি এদের বিরুদ্ধে শুধু আদালত নয় পরিবার সমাজ সকলেই কঠোর হতো তবে দিহানের মায়ের মতো সকলেই ছেলের গায়ে ধর্ষকের তকমা লাগার ভয়ে শঙ্কিত হতো। সেই শঙ্কা একটা ছেলেকে ধর্ষক হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করত। পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান থেকে বিচ্যুত হওয়ার ভয়ে একটা লম্পট, বদমাশ পুরুষরা তার লালসাকে সংযত করত। আর দেশে এভাবে গাণিতিক হারে ধর্ষকের সংখ্যা বেড়ে যেত না।
তবে এখানেই কথা শেষ নয়। শুরু করেছিলাম যে কথা দিয়ে সেকথা আবারও বলছি; নারীর ওপর যৌন শোষণসহ সকল রকম নির্যাতন সমূলে বন্ধ করতে হলে পরিবার থেকে শুরু করে সর্বত্র নারীর ক্ষমতায়ন যে আগে জরুরি সেটা সকলকে বুঝতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। একটা শিশু জন্ম নিয়েই তার পারিবারিক অবস্থান থেকে বুঝে যায় সংসারে নারীর কোনো মর্যাদা নেই। সে তার মাকে নিগৃহীত হতে দেখে দেখে তার অবচেতন মনে গেঁথে নেয় নারীর সঙ্গে যা হয় সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব ব্যতিক্রমী পরিবারে নারীর মর্যাদা উচ্চ, যেখানে নারীর ক্ষমতা আছে, সমতা আছে, সেই পরিবারে বড় হওয়া ছেলে শিশুরা পরিণত বয়সে কোনো নারীকে অসম্মান করে না। তারা নারীর লাঞ্ছনায় মনুষ্যত্বের অবমাননাই প্রত্যক্ষ করে। নারী নির্যাতনকে মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করে। আর এরাই যুগে যুগে রামমোহন হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর হয়ে জন স্টুয়ার্ট মিল হয়ে নারীর অধিকারের জন্য লড়াই করে। কিন্তু রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জন স্টুয়ার্ট মিলের সংখ্যা সবসময়েই প্রয়োজনের তুলনায় কম এবং তাদের পথেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মোল্লা-পুরোহিত ও সামাজিক বিধিনিষেধ। আর ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা ক্ষমতার আসন টলে যাওয়ার ভয়ে এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
পুরুষতন্ত্রের ধারকরা মনে করে নারীর ক্ষমতায়নে তাদের ক্ষমতার আসন টলে যাবে কিন্তু তারা বোঝে না যে নারীর ক্ষমতায়ন হলে প্রকারান্তরে পুরুষও আরও অধিক ক্ষমতায়িত হবে। কারণ দিন শেষে পুরুষ ঘরে ফেরে একজন নারীর কাছেই সে হোক তার জননী, ভগিনী, জায়া, কন্যা বা কন্যাসম পুত্রবধূর কাছে। অধিকাংশ পুরুষই তাদের শত্রু নয়, প্রিয়জন মনে করেই বাইরের ত্রিতাপ জ¦ালা জুড়াতে এদের শরণ লয়। তাই ক্ষমতাকে যদি ইলেকট্রিক পাওয়ারের সঙ্গে তুলনা করি আর তাদের প্রিয় নারীরা ক্ষমতাবান হন তাহলে সংসারে ডাবল পাওয়ারের বাল্ব জ¦লে ওঠে সব অক্ষমতার অন্ধকার দূর করে চারিদিক ঝলমল করে দেবে। আবারও স্মরণ করি, নেপোলিয়ন ও তার বিখ্যাত সংলাপ ‘আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব’।
আজ সম্রাট নেপোলিয়নের কথা বদলে দিয়ে বলতে হবে- একটি জাতি সভ্যতার সঙ্গে, জ্ঞানের সঙ্গে এবং আর্থিকভাবে তখনই ক্ষমতায়িত হবে যখন শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সকল নারী পুরুষ সমান সমান ক্ষমতা ও মর্যাদাবান হবে। তখন একটা ভিক্ষুক ভিক্ষা না পেলে কোনো নারীকে মাগী বলবে না। কোনো শিশু তার খেলার সঙ্গীর মা-বোনকে ধর্ষণ করার হুমকি দেবে না। কোনো উঠতি তরুণ তার সমবয়সী তরুণীদের পোশাক চলাফেরা নিয়ে কথা বলার স্পর্ধা দেখাবে না। কাজটি মোটেই সোজা নয়। তাই আসুন আমরা সকলে মিলে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টির জন্য লড়াই করি।
স্বাতী চৌধুরী: কথাসাহিত্যিক; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
সূত্র : খোলা কাগজ