নারী-পুরুষের সামাজিক সম্পর্ক হচ্ছে জেন্ডার। শারীরিক পার্থক্য নিয়ে নারী ও পুরুষ জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সমাজ ও সংস্কৃতি যখন এই পার্থক্য এবং অন্যান্য কারণে তাদের ওপর সামাজিক নানা অর্থ আরোপ করে পৃথক করে ফেলে তখনই তা হয়ে ওঠে জেন্ডার। তাই জেন্ডার এক ধরনের সামাজিক নির্মাণ। শারীরিক পার্থক্য জৈবিক বলে সেই পার্থক্য দূর করা যায় না। কিন্তু সামাজিক নির্মাণ বলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য দূর করে জেন্ডারবান্ধব সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।
নারী-পুরুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংজ্ঞাই জেন্ডার। সামাজিক লিঙ্গীয় বৈষম্য প্রকৃতির তৈরি নয়। প্রকৃতি ছেলে ও মেয়ে তৈরি করে। সমাজ তাকে বৈষম্যের ভিত্তিতে পুরুষ ও নারীতে পরিণত করে। সমাজই তৈরি করেছে পুরুষালি ও মেয়েলি বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি বৈষম্য তৈরি করেনি, তৈরি করেছে নারীর পুনরুৎপাদন কাজের জন্য ভিন্ন অঙ্গ। পার্থক্য শুধু এইটুকুই। বৈষম্য তৈরি করেছে মানুষ অর্থাৎ সমাজ। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে যে বৈষম্য, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, কালো-সাদা, নারী-পুরুষের মধ্যে যে ব্যবধান এসবই সমাজের তৈরি। জেন্ডার বৈষম্যের মাশুল শুধু নারীকেই দিতে হয় না, পুরুষ এবং সাধারণভাবে সমাজকেও এর জন্য মাশুল দিতে হয়।
উচ্চ মজুরির কর্মসংস্থানে পুরুষদেরই প্রাধান্য দেখা যায় এবং কম মজুরির কাজে নারীর আয় পুরুষের আয়ের ৫০-৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ২০-৫০ শতাংশ কম। বিশ্বের ৯৬ কোটি বা ৯৬০ মিলিয়ন এবং নৃ-জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশই নারী। কম মজুরির নিকৃষ্ট কর্মে নারীর অংশগ্রহণ যতটা বেড়েছে, উচ্চ মজুরি ও উচ্চস্তরের মর্যাদাসম্পন্ন কাজে নারীর অংশগ্রহণ সেই তুলনায় নগণ্য মাত্রায়ও বাড়েনি। এই কম মজুরির শ্রমে নারীর কেন্দ্রীভবন সবচেয়ে দৃশ্যমান হলো গার্মেন্টস কারখানায়, যেখানে গোটা বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে নারী এবং তা ম্যানুফ্যাকচার শিল্পের নারীর শ্রমশক্তির এক-পঞ্চমাংশকে ধারণ করে। অন্যদিকে ভালো মজুরির ক্ষেত্রে নারীর অবস্থান পে-স্কেলের একেবারে শেষ প্রান্তে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নারী যারা ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের সঙ্গে জড়িত তারা মূলত শ্রমিক অপারেটর বা প্রোডাকশন ওয়ার্কার মাত্র। মাত্র পাঁচ ভাগ নারী প্রফেশনাল ও টেকনিক্যাল পেশায় নিয়োজিত এবং মাত্র ২ শতাংশ প্রশাসনিক ও ম্যানেজার পদে। অনুরূপভাবে সার্ভিস বা পরিসেবা খাতেও অধিকাংশ নারী শ্রমিক কাজ করলেও মাত্র ১৪ শতাংশ নারী প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপক পদে এবং ৬ শতাংশের কম ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপক পদে নিযুক্ত। শ্রমঘন ও সরল প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পগুলোতে নারী শ্রমের কেন্দ্রীভবন নারী শ্রমশক্তির কোণঠাসাকরণের সবচেয়ে দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত।
বিশ্বের সর্বত্র এখনও ‘নারীর কাজ’ বা ‘পুরুষের কাজ’_ এভাবে চিহ্নিত করে অর্থনৈতিক শ্রমকে লিঙ্গীয় ভিত্তিতে পেশাগত পৃথকীকরণ করা হয়ে থাকে। যেমন_ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে ৫০০ ধরনের কৃষিবহির্ভূত পেশার প্রায় ৪৫ শতাংশ শ্রমশক্তি লিঙ্গীয় ভিত্তিতে গঠিত। যেখানে হয় শুধু নারী, নয়তো কেবল পুরুষ মোট শ্রমশক্তির ৮০ ভাগ। জাপানে দিবাযত্ন কেন্দ্র, হাসপাতাল কর্মী, নার্স, কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক, গৃহকর্মী, চাকরানী, পেশাদার আনন্দদানকারী ইত্যাদি পেশায় ৮০ ভাগই হলো নারী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের ৮০ ভাগ শ্রমশক্তিই নারী। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে মোট নারী শ্রমিকের ৭১ ভাগ সার্ভিস বা পরিসেবা খাতে নিযুক্ত। এশিয়া ও আফ্রিকায় অধিকাংশ নারী শ্রমিক বিশেষ করে সাব-সাহারা অঞ্চলের ৮০ ভাগেরও বেশি নারী সবচেয়ে কম মজুরিতে কৃষি কাজে নিয়োজিত এবং এক-তৃতীয়াংশের বেশি নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে যুক্ত। সারা দুনিয়ার নারীরা তাদের সহকর্মী পুরুষের চেয়ে অনেক কম মজুরিতে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে থাকে। নারীরা শ্রমের বাজারে সবচেয়ে বিলম্বে প্রবেশ করলেও অর্থনৈতিক মন্দার বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বরূপ কর্মচ্যুতির শিকার কিন্তু প্রথম হয় নারীরাই।
এশিয়ায় কর্মজীবী নারীর হার এখন ৪৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫৪ শতাংশ হয়েছে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ৩৮ শতাংশ থেকে হয়েছে ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ এশিয়ায় ৪৪ শতাংশ। দু’দশক আগে যা ছিল ২৫ শতাংশ। যেসব অঞ্চলে নারীর অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল সে সব দেশেও এই হার বৃদ্ধি পেয়েছে। লাতিন আমেরিকায় ২২ থেকে ৩৪ শতাংশ, উত্তর আফ্রিকায় ৮ থেকে ২১ শতাংশ হয়েছে। এমন কি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোতে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ নানা সামাজিক ধর্মীয় কারণে নিরুৎসাহিত হলেও ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শ্রমবাজারে নারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি কিন্তু এখনও নারীর অর্থনৈতিক অধিকারকে নিশ্চিত করেনি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীরা আজও বহুমুখী বৈষম্যের শিকার। নিয়োগ ও পদোন্নতির বেলায় অসম মানদণ্ড, প্রশিক্ষণের অসম সুযোগ, সমান কাজের অসম মজুরি, ঋণ ও উৎপাদনমূলক সম্পদ লাভের সুযোগ, নির্দিষ্ট কতগুলো পেশায় যোগদান নিষিদ্ধকরণ, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসম অংশগ্রহণ ইত্যাদি হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যের আংশিক চিত্র মাত্র।
লেখক : সভাপতি, মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল