বিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোটা সময় কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন এ দেশের মানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথি। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। সত্য, কল্যাণ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় বিশ্বস্ত থেকে তিনি দেশের জনগণকে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় আজীবন ব্রতী ছিলেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর এই মহীয়সী নারী চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।
তাঁর প্রয়াণের এক দশকের বেশি অতিবাহিত হলেও ‘জননী সাহসিকা’র অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হয় আন্দোলন-সংগ্রামে।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও বহু প্রতিকূলতার মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ দিনাতিপাত করছে। এই দীর্ঘ সময়ে নানা ক্ষেত্রে বহু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অনেক অর্জন আছে। কিন্তু রাজনৈতিক সন্ত্রাসের ফলে সেই অর্জন সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থবহ হয়ে উঠছে না। কৃষি সাফল্যের সুফল কৃষক ভোগ করতে পারছে না। রাজনৈতিক দলগুলোতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব গণতন্ত্রকে স্থবির করে তুলেছে। নারী এভারেস্ট বিজয়ী হচ্ছে, দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় একাধিক নারী অধিষ্ঠিত রয়েছে। এর পরও নারী শিকার হচ্ছে ভয়াবহ সহিংসতার। উগ্র সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সমাজ বিকাশকে ব্যাহত করার অপচেষ্টায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। একদিকে আছে দেশ ও রাষ্ট্রে উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রাম, অন্যদিকে রয়েছে জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করার নানা অপচেষ্টা। বহুমুখী দ্বন্দ্বে আকীর্ণ এই সমাজ জনগণকে যখন দিশাহারা করে তুলেছে, তখনই স্মরণ করতে হচ্ছে মানবতাবাদী কবি সুফিয়া কামালকে। সমাজ বিকাশের, মানবমুক্তি আন্দোলনের অভিযাত্রায় তাঁর প্রজ্বলিত মশালের আলোর পথরেখা ধরেই অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। মানবকল্যাণপ্রয়াসী কবি সুফিয়া কামালের মানসগঠনে নারী আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার প্রভাব ছিল অপরিসীম। সুফিয়া কামালের রচনা ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। তাই তাঁর সংগ্রামী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি ব্যয় করেছেন নারীকে সচেতন করা, সংগঠিত করা ও নারী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সুফিয়া কামালকে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী হিসেবে পেয়ে গর্বিত। নারী আন্দোলনের এক পর্বে ১৯৯২ সালে তিনি বলেন, ‘নারীমুক্তি মানেই মানবমুক্তি। ‘ তাঁর কথার অনুরণন ভেসে আসে জাতিসংঘের ‘Women’s right is human right’ ঘোষণায়।
বাংলাদেশে নারীর মানবাধিকার পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে, নারীর জীবনে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। যুগ যুগ ধরে বহমান নারী আন্দোলনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে সে সম্ভাবনার। আর এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম সুফিয়া কামাল। এই আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় তিনি বুঝেছিলেন ‘প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী হলেই নারীমুক্তি হয় না। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র এবং সমাজের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রায়ণ করতে হবে। বাস্তব ক্ষেত্রে তাই আজও দেখা যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রে গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবের ফলে নারীর মৌলিক অধিকার আজও অর্জিত হয়নি। বর্তমানে বাংলাদেশে সামাজিক নানা সূচকে নারীর অগ্রগতি চিহ্নিত হলেও পারিবারিক ক্ষেত্রে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আজও অস্বীকৃত। সংসদের নারী আসনে সরাসরি নির্বাচনের দাবি উপেক্ষিত। স্থানীয় সরকারে নির্বাচিত নারী সদস্যের দায়িত্ব পালনে প্রতিকূলতার বিষয় অমীমাংসিত। সাম্প্রতিক নারীর বিবাহ উপযোগী বয়স নিয়ে যে তুঘলকি প্রস্তাব নিয়ে আসা হচ্ছে তাতে কন্যাশিশুর কৈশোরকে খর্বিত করবে। এভাবে মৌলিক অধিকারগুলো উপেক্ষিত রাখা হয়েছে, অবদমিত করা হচ্ছে, এর সঙ্গে রয়েছে নৃশংসতম অপরাধ, নারীর প্রতি সহিংসতা। এই সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পৃক্ততা।
একুশ শতকের নারী আন্দোলন আজ সম্মুখীন নতুন বাস্তবতার। কবি সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, ‘একুশ শতকের মানুষেরা যদি মানবধর্ম পালন না করে, তাহলে একুশ শতকের কোনো মূল্য নেই। ‘ তাই একুশ শতকে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, চিন্তাচেতনায় সমৃদ্ধ মানুষকে মানবকল্যাণে ব্রতী হতে হবে নারীমুক্তি তথা মানবমুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুফিয়া কামালের প্রদর্শিত পথ ধরে। কারণ সুফিয়া কামাল ছিলেন মুক্তি, সাম্য, অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও বৈষম্যহীনতার প্রতীক। এসব মানবিক গুণের প্রতীক সুফিয়া কামাল নামের প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করে আমরাও হতে পারি মানবমুক্তি আন্দোলনের কর্মী।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ