‘ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ—আসুন, এ অপরাধের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই’—এটাই এবারের আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের স্লোগান। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে তৎকালীন বিশ্ব পেয়েছিল দুটি প্রত্যয়, নারীর অধিকার মানবাধিকার এবং নারী নির্যাতন মানবাধিকার লঙ্ঘন। ১৯৯৩ সালের সেই প্রত্যয়ের অনুসরণে ২০১৯ সালে এসেও বলতে হচ্ছে নারী নির্যাতন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। লিঙ্গভিত্তিক এই নির্যাতন নারী-পুরুষের বৈষম্যের একটি বর্বর প্রকাশ।
পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি এই সহিংসতার অন্যতম প্রধান কারণ। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ কথা সত্যি, বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্যাতনের পদ্ধতিতেও যুক্ত হচ্ছে নৃশংসতার নতুন নতুন মাত্রা।
১৯৯৫ সালে চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত বেইজিং কর্মপরিকল্পনা ও ঘোষণার ১২টি উদ্বেগপূর্ণ ক্ষেত্রের একটি ছিল ‘নারী ও সহিংসতা’। সেখানে বলা হয়, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা যেমন হরণ করে, তেমনি এই অধিকার ক্ষুণ্ন ও বাতিল করে। সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা সেই ধরনের তৎপরতা। যার ফলে নারীর শারীরিক, যৌন অথবা মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি বা বিপর্যয় ঘটে বা ঘটতে পারে। একই সঙ্গে এর দ্বারা বোঝানো হয় উল্লিখিত ধরনের তৎপরতা, দমন-পীড়ন বা স্বাধীনতা হরণের হুমকি, যা জনজীবন বা ব্যক্তিজীবন যেকোনো ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করা হয় বা হতে পারে।
১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নারী নির্যাতনবিষয়ক ঘোষণায় বলা হয়, নারীর অধিকারগুলো হবে : জীবনের অধিকার, সমতার অধিকার, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার, আইনের দৃষ্টিতে সম-নিরাপত্তার অধিকার, সব ধরনের বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার অধিকার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সেবা লাভের অধিকার, ন্যায্য ও অনুকূল কর্মপরিবেশের অধিকার, কোনো প্রকার নির্যাতন অথবা অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ অথবা অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন আচরণ ও শাস্তি না পাওয়ার অধিকার। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূলধারায় নারীকে যুক্ত করার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নারীর সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতন থেকে মুক্ত হওয়া।
বাংলাদেশের নারী নির্যাতন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী যদিও কোনো একক সত্তা নয়, শ্রেণি, বয়স, পেশা, সামাজিক অবস্থানের তারতম্য থাকলেও সে নারী এটাই তার প্রধান পরিচয় এবং এ কারণে তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। চার বছরের শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, আবার ৮০ বছরের বৃদ্ধাও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। নুসরাতের মতো মাদরাসার ছাত্রী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে, আবার পেশাজীবী নারী রূপা গণপরিবহনে কর্মস্থলে আসার পথে বাস ড্রাইভার কন্ডাক্টর দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মী মিতুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে রক্ষকদের দ্বারা। কখনো মা-মেয়ে একসঙ্গে ছেলের বয়সী তরুণ-যুবকদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে শিক্ষক যৌন হয়রানি করছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সংঘটিত নির্যাতনের তিন হাজার ৪৪৩টি ঘটনার মধ্যে ধর্ষণ এক হাজার ৪১টি, গণধর্ষণ ১৭৮টি, ধর্ষণের চেষ্টা ১৯৫টি, যৌন নিপীড়ন ১৪০টি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ মোট এক হাজার ৫৫৪ ধর্ষণসংশ্লিষ্ট নির্যাতন বিশ্লেষণ করেছে, যেখানে দেখা যায় প্রায় ৫০ শতাংশ নারী ধর্ষণের মতো বর্বর পশুত্বপূর্ণ নির্যাতনের শিকার। এখানে নির্যাতনকারীর মধ্যে রয়েছেন পরিবারের নিকটতম সদস্যসহ বাবা-চাচার মতো অভিভাবক, রয়েছেন শিক্ষক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, গণপরিবহনের কর্মী ও অন্যান্য। বর্তমান সময়ে নারী নির্যাতনের আরেকটি ভয়াবহ ধরন হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। নারী নির্যাতনের কাজে ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হচ্ছে।
নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার নেই কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র। নিজ গৃহ যা কি না হওয়ার কথা সর্বাপেক্ষা নিরাপদ, সেই গৃহে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে সর্বাধিকসংখ্যক নারী—৮০ শতাংশ। গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পথে-ঘাটে, যত্রতত্র নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনের কারণও হচ্ছে নানামুখী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিশোধ, সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান, পরকীয়া পুরুষের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়া ও চাহিদা না মেটাতে অপারগতা জানানো ইত্যাদি অজুহাতে নারী নিপীড়িত হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে রয়েছে যে যাঁরা নির্যাতনের শিকার হননি তাঁরাও সব সময় নির্যাতনের আতঙ্কে ভোগেন।
নারী নির্যাতনের মূল কারণ যদি আমরা চিহ্নিত করতে চাই, তা হলে দেখি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং ক্ষমতার কাঠামোয় নারীর অধস্তন অবস্থান ও নারীর ব্যক্তি অধিকারের অস্বীকৃতি। এসবের পেছনে রয়েছে পুরুষত্ব (Masculinity)। সমাজ কর্তৃক সৃষ্ট জেন্ডার ধারণার মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আগ্রাসী পুরুষত্ব মনোভাব। জন্মের পর শিশুকে সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে নারী ও পুরুষ হিসেবে তৈরি করা হয়। ফলে উভয়েরই মানুষ হয়ে ওঠা হয় না, দুই পক্ষই হয় খণ্ডিত মানুষ। সম্প্রতি ‘পৌরুষ-এর সংজ্ঞা বদলাতে হবে’ এই শিরোনামে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি শামীম আহমেদ লিখেছেন, ‘পুরুষত্বের যে ভয়ংকর গুণাবলি আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের মানুষ করে তোলেনি, বরং অমানবিক করে তুলেছে। আবেগহীন পাথরসম পাষাণ, যা আমাদের সমাজে হানাহানি, কাটাকাটি ও হিংস্র্রতা ও অন্যান্য নেতিবাচক কাজের নিয়ামক করে তুলেছে। সময় এসেছে পুরুষত্বের সংজ্ঞা বদলানোর। সময় এসেছে পুরুষের আবেগী কোমল হৃদয়ের মানুষ হওয়ার। ’
বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের চিত্রের পাশাপাশি নারীর অগ্রগতি ও অর্জনের পরিচয়ও রয়েছে। সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয়তা, রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ, নারীশিক্ষার হার বৃদ্ধি, আগের তুলনায় নারীর সচেতনতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি এখন দৃশ্যগোচর। নারীর অগ্রগতির লক্ষ্যে প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে নানা ধরনের নীতি, কর্মপরিকল্পনা, বিধান এবং সংবেদনশীল আইন। কিন্তু এসব অর্জন ও প্রাপ্তিকে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে তুলছে নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ও নির্যাতন।
আজ রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতির লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হলে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের কথা ভাবতে হবে। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও নির্মূলের জন্য সমন্বিত বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। বুঝতে হবে নারী নির্যাতন ব্যক্তিগত ইস্যু নয়, জেন্ডার ও মানবাধিকার ইস্যু। এর জন্য নারী নির্যাতনের মূল কারণগুলো দূরীকরণে কাঠামোগত প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান জেন্ডার সংবেদনশীল আইনের প্রয়োগ, প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন ও সংস্কার, ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য সুশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কাজে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জনপ্রশাসন ও বিচারিক কাজে যুক্ত কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ, পাঠক্রমে জেন্ডার ও মানবাধিকার বিষয় গুরুত্বসহকারে যুক্ত করা ইত্যাদি বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। নারী নির্যাতনবিরোধী সমাজ মানস তৈরি করার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি, পাঠ্যসূচিকে জেন্ডার সংবেদনশীল ও নারী-পুরুষের সমতার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করা, গণমাধ্যমের জেন্ডার সংবেদনশীল ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সিডও সনদের সম-অধিকারের ধারণার অনুরূপ সিডও সনদের ২ নং ও ১৬-(১) (গ) ধারায় স্বাক্ষর প্রদানসহ নারীর ব্যক্তিজীবনের অধিকার তথা বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নারীর মানবাধিকার তথা রাষ্ট্রের মানাবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজন বহুমাত্রিক সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ। এ সমন্বিত বহুমাত্রিক কর্মসূচির প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও সমাজের সম্মিলিত ধারাবাহিক ভূমিকা।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল