নারীর জন্য সমমজুরি, কাজের ঘণ্টা কমানো, উন্নত কর্মপরিবেশ, ভোটাধিকারের দাবির আন্দোলনের পটভূমিকায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে উদ্ভূত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী অধিকারের বিষয়গুলো দেশ-কালভেদে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করলেও এদের মধ্যে রয়েছে সর্বজনীন সম্পর্ক। ৮ মার্চ এই সর্বজনীন সম্পর্কের প্রতীক। বিভিন্ন দেশে ও বৈশ্বিকভাবে এই দিনটিতে নারীর অবস্থান ও অগ্রগতি মূল্যায়ন করা হয়, ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা হয়।
এটি নারী আন্দোলনকারীদের সংহতির দিন।
এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস এমন এক সময় পালিত হচ্ছে, যখন বেইজিং চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের ২৫ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে। এই সময় বেইজিং পিএফএর ২৫ বছর পর্যালোচনা অর্থাৎ বেইজিং+২৫ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
২০৩০ সালের মধ্যে ‘কেউই রবে না পিছে’ শীর্ষক টেকসই উন্নয়নে যে আন্তর্জাতিক ঘোষণা রয়েছে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive development) উন্নয়নের কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে। সব মিলিয়ে এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবস একটি নতুন মাত্রা লাভ করছে। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগান হচ্ছে, ‘I am Generation Equality : Realizing Women Rights.’ অর্থাৎ ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমি সমতার প্রজন্ম। ’ ১৯১১ সালে যখন প্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয় তখনকার পরিপ্রেক্ষিত থেকে আজকের পরিপ্রেক্ষিতে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। আজকের দিনে নারীর অধিকার ও সমতার বিষয়টি শুধু নারী ইস্যু নয়, সমাজ বিকাশ ও মানবাধিকার ইস্যু। যেমনটি অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘নারী উন্নয়নের লক্ষ্য নয়, উন্নয়নের বাহক। ’ নারীর মানবাধিকার বিষয়টি গভীরভাবে ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত, যেখানে প্রোথিত রয়েছে নারীর অধস্তন অবস্থান। জেন্ডার সমতাপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সমতার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন প্রজন্ম তৈরি হতে হবে। ব্যক্তি হচ্ছে সমগ্রতার অংশ, ব্যক্তির আচরণ, মনোজগৎ, দৃষ্টিভঙ্গি বৃহত্তর সমাজে প্রভাব ফেলবে। প্রত্যেকের জন্য সমতা প্রতিষ্ঠায় একে অপরকে ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করতে হবে, জেন্ডার মূল্যবোধে আঘাত হানতে হবে, গতানুগতিকতা ভাঙতে হবে, বৈচিত্র্যকে মূল্য দিতে হবে, বিভাজনকে অস্বীকার করতে হবে।
২০২০ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই দিনে বাংলাদেশের নারীরা কেমন আছে? এই পর্যালোচনায় গেলে প্রথমেই ভয়াবহ যে চিত্র আমাদের সামনে আসে তা হচ্ছে, নারীর প্রতি সহিংসতা। সহিংসতার বহুমাত্রিকতা ও বর্বরতা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির একটি হিসাবে আমরা দেখি, যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বেশির ভাগ হচ্ছে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা। নির্যাতনের এই চিত্রের তুলনায় নির্যাতনকারী ও ধর্ষকের বিচার ও শাস্তির সংখ্যা ন্যূনতম। বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধীকে অপরাধ করতে সাহস জোগায় ও নতুন অপরাধী তৈরি করে। নারীর প্রতি সহিংসতা হচ্ছে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। বাল্যবিবাহ আইন পাদটীকাসহ অনুমোদিত হওয়ায় এর মধ্য দিয়ে কন্যাশিশুকে নির্যাতনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তার ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হচ্ছে।
ক্ষমতার কাঠামোয় নারীর অংশীদারির জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা একটি মৌলিক বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ এখনো প্রতীকী। রাজনীতির কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে অংশীদারিটা বিশেষ নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মৌলিক প্রশ্নে ঘটেছে পশ্চাদ্গামিতা। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি, জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন। কেননা সংরক্ষিত নারী আসন একটি সাময়িক ব্যবস্থা, যা মূলধারার রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি নারী আন্দোলনের দাবির বিপরীতে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের ব্যবস্থা আরো ২৫ বছর থাকবে—এই মর্মে সপ্তদশ সংশোধনী আইন ২০১৮-এর অনুমোদন দেওয়া হয়। এই ব্যবস্থা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে একটি পশ্চাত্মুখী পদক্ষেপ। নারী-পুরুষের সমতা ও ক্ষমতায়ন বিষয়ে সরকারের সব ঘোষণা, নীতি ও পরিকল্পনার সঙ্গে এটি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে সিডও সনদের সম-অধিকার, সমসুযোগ, সমফল অর্থাৎ সমতার নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত।
সম্পদ ও সম্পত্তিতে নারীর অধিকার এখনো স্বীকৃত নয়। ব্যক্তিজীবনে নারীর অধিকারহীনতার ক্ষেত্রগুলো নারীকে অধস্তন করে রাখছে। বিয়ে, বিয়েবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকারে নারীর সম-অধিকার এখনো স্বীকৃত নয়। ব্যক্তিজীবনে নারীর প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলোতে সমতা আনার লক্ষ্যে নারী আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে অভিন্ন পারিবারিক আইনের দাবি জানিয়ে আসছে। এর সঙ্গে বিপরীতভাবে দেখা যাচ্ছে, সিডও সনদের ২ ও ১৬(১)-এর ধারা এখনো সংরক্ষিত।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা প্রতিষ্ঠায় বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নারীর জন্য গৃহীত সরকারি বিভিন্ন নীতি ও সিদ্ধান্তের মধ্যে পারস্পরিক সাংঘর্ষিকতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মধ্যে ব্যাপক ফারাক। বস্তুত উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় সব নাগরিকের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগের অভাব দেশের ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান। নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুযোগ সেখানে আরো কম। নারীরা প্রধানত দুটি কারণে উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারে না। প্রথমত, সম্পদ ও সুযোগহীনতা, দ্বিতীয়ত নারীর সক্ষমতার প্রশ্ন। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট খাতওয়ারি বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ। জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণীত হচ্ছে, এখন প্রয়োজন এই জেন্ডার বাজেট নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমতায় কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার পরিবীক্ষণ।
নারীর সমতা ও ক্ষমতায়নের জন্য চারটি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রথমত, ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নারীর মালিকানা স্থাপন। দ্বিতীয়ত, মানসম্মত কাজের পরিবেশ ও মজুরি। তৃতীয়ত, শান্তি, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতা। চতুর্থত, সর্বস্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের নারী এই চারটি ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার। আজকের নারী তার যে অমিত সম্ভাবনা প্রদর্শন করছে, সেই সম্ভাবনা অগ্রসর করে নেওয়ার জন্য জরুরি হচ্ছে সিদ্ধান্ত ও বাস্তবায়নে সমন্বয়, রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম বাস্তবায়নে জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ, যেখানে সরকারের সদিচ্ছার প্রশ্নটি মুখ্য। সেই সঙ্গে চাই জেন্ডার সমতার দৃষ্টিভঙ্গিসংবলিত সামাজিক শক্তির বিকাশ ও দৃঢ়ভূমিকা।
সমতার প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে চাই সমতার দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানবসত্তা। এই মানবসত্তা গড়ে উঠতে পারে সামগ্রিক জীবনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং বহুমাত্রিক প্রয়াসের মাধ্যমে, যে প্রয়াস হবে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী চেতনা সৃষ্টিকারী। সেখানে নারী-পুরুষ, বালক, কন্যা, তৃতীয় লিঙ্গসহ সবাই জাতি, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানবসত্তা হিসেবে বিবেচিত হবে। গড়ে উঠবে সমতার প্রজন্ম, থাকবে না কোনো বিভাজন।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কন্ঠ