স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সুবর্ণ জয়ন্তীর দোরগোড়ায় উপস্থিত হয়েছে। এই অর্ধশতকে বাংলাদেশকে পার হতে হয়েছে অনেক চড়াই-উতরাই। রাজনৈতিক জীবনে ঘটেছে পঁচাত্তরের আগস্টের মতো পৈশাচিক ঘটনা, দেশ জিম্মি হয়েছিল স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে। বাংলাদেশের রয়েছে অনেক অর্জন ও অগ্রগতি; পাশাপাশি মোকাবেলা করতে হচ্ছে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ, রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি যেমন সমগ্র বিশ্বকে বিস্মিত করছে, একইভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্বলতা অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৭৩-৭৮ সময়কালে। বর্তমানে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চলমান। বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মোটাদাগে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) প্রথম নারীর সমতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয়। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্য উল্লেখ করা হয়। চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উল্লিখিত রয়েছে। আমরা জানি, বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮(২) ধারায় নারীর সব অধিকার এবং ২৮(৪) ধারায় নারীকে অগ্রসর করে নেওয়ার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গ্রহণের নির্দেশ আছে। তার পরও নারীর সমতা বিষয়টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লেখের ক্ষেত্রে আমাদের ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এই সময়কালে জাতীয় ও বৈশ্বিক নানা পদক্ষেপ, নীতি ও ঘোষণা প্রভাব ফেলেছে এই অন্তর্ভুক্তিতে। যেমন—এই সময়ে অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন, ঘোষিত হয় এমডিজি ইত্যাদি। ১৯৯৭ সালে গ্রহণ করা হয় জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই নীতিমালা গোপনভাবে পরিবর্তনসহ নানা টালবাহানার মধ্য দিয়ে চলেছে, ফলে এর প্রভাব নারীর জীবনে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না।
সামগ্রিকভাবে নারী উন্নয়নে সরকারি পরিকল্পনার এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নারীর অবস্থা ও অবস্থান বিবেচনা করতে হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৪ শতাংশ নারী। অর্থাত্ অর্ধেক জনসংখ্যা নারী। ১৯৭০ সালের নারী এবং ২০২০ সালের নারীর অবস্থা মোটাদাগে বিশ্লেষণ করলে একটি মৌলিক পার্থক্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সেটা হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর সক্রিয় ভূমিকা নেই, যদিও ক্ষমতার কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ বিশেষভাবে ঘটছে না।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৯০ শতাংশ নারী। পোশাকশিল্প শ্রমিক হিসেবে নারীর এই আগমন দেশের সামগ্রিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের তরুণী ও কিশোরীরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখছে। কর্মসূত্রে অচেনা শহরে এসে তাদের নিজেদের জায়গা করে নিতে হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা বা অন্য কোনো সুযোগ তাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। তাদের এই আগমনকে আমরা একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব বলতে পারি, কিন্তু তাদের জীবন বিকাশে সহায়ক ভূমিকা বিশেষভাবে নেওয়া হয়নি। নারীকে কর্মক্ষেত্রে দেখার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সূচনা পোশাকশিল্পে নারীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বলা যায়; কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির মানদণ্ড সৃষ্টিকারী এই নারীদের সংখ্যা এখন ক্রমহ্রাসমান।
আমরা জানি, বাংলাদেশের শ্রমবাজারে ৩৬.১৪ শতাংশ নারী, যাঁরা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতে কাজ করে থাকেন। তবে এখনো নারীদের ৯১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। ফলে সম মজুরি, সম সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা—সব কিছু থেকেই তাঁরা বঞ্চিত হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীর শ্রম জিডিপিতে যুক্ত হয় না।
কৃষিক্ষেত্রে ২৩ ধরনের কাজের মধ্যে ১৮টিতেই যুক্ত রয়েছেন নারীরা, কিন্তু জমির মালিকানা না থাকায় কৃষক হিসেবে নারীরা স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। এই সময়কালে সৃষ্ট নারীদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কর্মক্ষেত্র হচ্ছে উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা। যাঁরা নারী উদ্যোক্তা হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন গৃহিণী। বিবিএস-এর জরিপে দেখা যায়, ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারী, যাঁরা আয়মূলক কাজ করেন, তাঁদের ১২ শতাংশ উদ্যোক্তা। এই নারী উদ্যোক্তাদের সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। মূলধন সমস্যা এখনো নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া, ঋণ পাওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে শর্তপূরণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। তবে এরই মধ্যে সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১০ শতাংশ হারে ঋণ প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আইটি সেক্টরেও নারীরা এখন কাজ করছেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। দেশে নারীশিক্ষার হার ৭০ শতাংশ, তবে ঝরে পড়ার হারের মাত্রাও কম নয়। মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার ৪৭ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫২.১৭ শতাংশ এবং উচ্চশিক্ষায় ৬০.০৬ শতাংশ। তবে শিক্ষার হারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে শিক্ষানীতি ও পাঠক্রম। রাজনৈতিক সমীকরণের নামে ভারসাম্য আনার অপচেষ্টা শিক্ষানীতি ও পাঠ্যসূচি পাল্টে দিচ্ছে, সেখানে অসাম্প্রদায়িক মানবিক ও সমতার দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ অর্থাত্ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে নারীর অবস্থান খুব তাত্পর্যপূর্ণ পর্যায়ে আসতে পেরেছে বলা যাবে না। জাতীয় সংসদে নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা মোট ৭২। এর মধ্যে ৫০ জন হচ্ছেন সংরক্ষিত আসনে এবং ২২ জন সাধারণ আসনে। ২০১৩ সালের আরপিওতে রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে, যা কোনো রাজনৈতিক দলে নেই। আমরা জানি, সংরক্ষিত নারী আসন একটি সাময়িক ব্যবস্থা, মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া। নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি—সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন; কিন্তু সম্প্রতি সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন প্রথা ২৫ বছরের জন্য বহাল রাখার সরকারি সিদ্ধান্ত নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে বহুদূর পিছিয়ে দেবে। সংরক্ষিত আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দলের নারী কর্মীদের অভিযোগ—যাঁরা প্রতিদিনের মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক কর্মে যুক্ত, তাঁদের মনোনয়ন না দিয়ে পিতা-স্বামী বা অন্য কোনো বিবেচনায় সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল, যখন ১৯৯৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদে সংরক্ষিত নারী সদস্য আসনে প্রবর্তিত হয় সরাসরি নির্বাচন এবং পরে ২০০৯ সালে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টি এবং সরাসরি নির্বাচন চালু হয়। এই সিদ্ধান্ত নারীসমাজের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। অনেক নারী উত্সাহ-উদ্দীপনা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন; কিন্তু পরবর্তীকালে অবকাঠামোগত সুযোগের অভাব, পুরুষ সহকর্মীদের অসহযোগিতা, সর্বোপরি নির্বাচিত নারীদের কাজ করার ক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীনতা ও সমন্বয়হীনতা প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। সামগ্রিকভাবে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের চিত্র এখনো প্রতীকী। পেশিশক্তি, অর্থের প্রাধান্য, সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অনুপস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে প্রধান বাধা হয়ে বিরাজ করছে।
বাংলাদেশের নারীর অবস্থানের সামগ্রিক আলোচনায় দেখা যায়, নারীর ক্রমবিকাশমান ভূমিকা বাংলাদেশের অবস্থানকে যখন ভিন্ন মাত্রায় উন্নীত করছে, বৈশ্বিক সূচকে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, তখন নারীর বাস্তব অবস্থানের সামাজিক সূচক কোন পর্যায়ে সেই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক সূচকে নারীর অগ্রযাত্রার প্রতিফলন সামাজিক সূচকে দৃশ্যমান হচ্ছে না। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সমতার দৃষ্টিভঙ্গি ও মর্যাদা নারীর জীবনে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। নারীকে প্রতিমুহূর্তে শিকার হতে হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক বহুমুখী প্রতিবন্ধকতা ও সহিংসতার। সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নারীকে ক্ষমতার কাঠামোতে প্রকৃত অংশীদার করছে না। নারীর বিকাশের জন্য অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করে এবং তা সুশাসনের দ্বারা বড়ভাবে অর্জিত হবে।
নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ সৃষ্টি হলেও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার কাঠামোগত ভিত্তি এখনো সার্বিকভাবে তৈরি হয়নি। এই কাঠামোগত ভিত্তি তৈরির জন্য প্রয়োজন জেন্ডার সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানবসম্পদ এবং জেন্ডার সমতার বহুমাত্রিকতার নিরিখে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, কাঠামোগত নানামুখী সুচিন্তিত পরিকল্পনা, নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
বিগত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের নারী দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে, এই পথপরিক্রমণে বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, অর্জন হয়েছে অনেক কিছু, এখন এই অর্জন রক্ষা ও সম্ভাবনা বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারীর অধিকার।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ