দীর্ঘ ধারাবাহিক আন্দোলনের মাধ্যমে নারীসমাজ ১৯৯৩ সালে বৈশ্বিক ঘোষণা লাভ করে, ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা মানবতার বিরুদ্ধে সহিংসতা’। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৪৩ বছর পর আবারও পৃথকভাবে বলতে হয়, নারীর অধিকার মানবাধিকার। তার অর্থ মানবাধিকারের মৌল সনদগুলোতে নারীর অধিকারহীনতা ও পশ্চাৎপদতার ভিন্ন মাত্রা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়নি বা বিবেচিত হয়নি।
১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার ডমিনিক্যান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা, মিনার্ভা মিরাবেল—এই তিন বোনকে হত্যা করা হয়।
১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালন শুরু হয়। ১৯৯৩ সালের ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে নারী-পুরুষের অসমতা ও বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। মানবাধিকার সম্মেলনে দিবসটি বৈশ্বিক স্বীকৃতি পায় এবং ১৯৯৯ সাল থেকে জাতিসংঘ ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ’ হিসেবে গ্রহণ করে। এর পর থেকে বিভিন্ন দেশে নারী আন্দোলন, সরকারি-বেসরকারি সংগঠন, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষে দিনটি পালন করে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, জেন্ডারভিত্তিক এই সহিংসতা প্রতিরোধ ও নির্মূলে বৈশ্বিক ও জাতীয়ভাবে কণ্ঠ যত উচ্চকিত হচ্ছে, সহিংসতার মাত্রা যেন সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্বরতার ধরন, নৃশংসতার মাত্রা অতীতের সব উদাহরণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পরিচালিত ‘বাংলাদেশে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতন চিত্র : ২০১৭’ সমীক্ষায় দেখা যায়, দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৬ জন, ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে ২২ জন এবং গণধর্ষণের মতো বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়েছে একজন শিশু। এখানে সংখ্যাটি বড় নয়। মুখ্য কথা হলো, এত অল্প বয়সের শিশু এই লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এখানে পাঁচ বছরের শিশু অথবা ৮০ বছরের নারী বা তার সামাজিক অবস্থান বিবেচ্য নয়, নারীর প্রতি সমাজের একই দৃষ্টিভঙ্গি, সে নারী এবং সে কারণেই তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
সমীক্ষায় আরো দেখা যায়, ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ গৃহবধূ, যাদের সংখ্যা কর্মজীবী নারীর তুলনায় অনেক বেশি। আমাদের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন সমাজ অনেক সময় নারীর বহির্মুখী হওয়ার সঙ্গে নারী নির্যাতনের সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করে। সেটা যে কত ভ্রান্ত, এই তথ্য তা প্রমাণ করে।
নারী নির্যাতনের ধরনগুলো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। বর্তমানে প্রযুক্তি ব্যবহার, নারীকে শুধু উত্ত্যক্ত বা ধর্ষণ করেই ঘটনার ইতি টানছে না; বরং ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে বা পর্নোগ্রাফি তৈরি করে ব্যবসা করছে।
ব্যক্তিজীবনে নারীর অধিকারের ক্ষেত্রগুলো এখনো বৈষম্যপূর্ণ। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, সম্পত্তিতে নারীর সমঅধিকার স্বীকৃত নয়। সিডও সনদে নারীর ব্যক্তি অধিকারের দুই নম্বর এবং ১৬১(গ) নম্বর ধারা এখনো সংরক্ষিত। ১৯৯৩ সালের মানবাধিকার সম্মেলনের ঘোষণায় আবার সিডও সনদের আলোকে বলা হয়, নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে বাধা সৃষ্টি করে এমন প্রথা, ঐতিহ্য, আচার প্রক্রিয়াকে রাষ্ট্র অনুমোদন দেবে না। জনজীবন ও ব্যক্তিজীবন নারীর অধিকারের এই বৈষম্য ক্ষমতার কাঠামোয় নারীকে অধস্তন করে রাখছে। ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক উন্নয়ন নারীর অবস্থানের সামাজিক সূচককে উন্নীত করছে না।
যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এসেছে আজকের #মি টু আন্দোলন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যায় ১৯৮০ সালে যখন নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় তখন বলা হয়, নারী আন্দোলন কি এখন ব্যক্তির ‘Bed room’-এ ঢুকবে। ব্যক্তির একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় বলে কিছু থাকবে না। সেই ক্ষেত্রে ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে ‘পারিবারিক সুরক্ষা আইন’-এর মতো অগ্রসর আইন। যে আইন নারীকে স্বগৃহে নিরাপত্তা দেবে। পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালে নারীদের ‘নীরবতা ভাঙার’ আহ্বান জানায় নারী আন্দোলন। আজকের নারী সাহসী হয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের কথা #মি টুর মাধ্যমে প্রকাশ করছে।
বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক কর্তৃক যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে নানা সময়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে এ অভিযোগের বিচার হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। সীমিতসংখ্যক হলেও নারী তার কথা বলা শুরু করেছে।
এবারের জাতিসংঘের নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষের স্লোগান হচ্ছে—‘Hear me too’. এখন সময় এসেছে এই কথা সমাজে প্রতিষ্ঠা করার যে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ও সহিংসতা শুধু নারীর সমস্যা নয়। এটা সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমস্যা। এই সমস্যার মূল কারণ নারীর প্রতি সমাজের অধস্তন দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতার কাঠামোয় নারীর অধস্তন অবস্থান। ফলে নারীর প্রতি সংঘটিত যেকোনো ধরনের সহিংসতার মূলে রয়েছে নারীর ওপর প্রাধান্য বিস্তারের মনোবৃত্তি, যা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনুমোদন করা হয়। অনেক সময় মনে হয় যৌন হয়রানি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর। প্রকৃত পক্ষে কি তাই? এ যুদ্ধ হচ্ছে প্রচলিত সমাজের রীতি, আচার, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। যার নানা অভিঘাত এরই মধ্যে নানামুখী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অবলোকন করা যাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতাকে একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে হবে, গ্রহণ করতে হবে বহুমাত্রিক কার্যক্রম এবং যা বাস্তবায়নে থাকবে নারী-পুরুষের সমন্বিত ভূমিকা।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ