স্কুলের পাঠ্যসূচিতে তাঁর ‘তাহারেই মনে পড়ে’ কবিতা পড়তে গিয়ে কত কিশোর-কিশোরীর মনকে গভীরভাবে নাড়া দিত, তা আজকের কিশোর-কিশোরীর মনে কতখানি নাড়া দেয় জানি না। তাঁর কাব্যপ্রতিভা দিয়েই বাইরের জগতে যাত্রা শুরু হয়েছিল ঠিকই—কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে আসা অবরোধের অর্গল ভেঙে প্রথাভাঙা কাজে নিজেকে নিয়োজিত করা এবং অবশেষে অবরোধবাসিনী থেকে গণমানুষের, বুদ্ধিজীবীদের, সংস্কৃতিসেবী—সবার কাছে এক নিশ্চিন্ত নির্ভরতার আশ্রয়স্থল হয়ে দাঁড়িয়েছেন ছোটখাটো, মৃদুভাষী অথচ প্রথাভাঙা এক দৃঢ়চেতা নারী।
এই দেশ, এই সমাজে সর্বজনের আস্থায়, বিশ্বাসে যে অসাধারণ এক সংগ্রামী সত্তার উন্মেষ ঘটেছিল ১০৭ বছর আগে, তিনিই শতাব্দীর সাহসী জননী কবি সুফিয়া কামাল।
তাঁর কাছের-দূরের সব ধরনের, সব বয়সের নারী-পুরুষের মনে তিনি আশার সঞ্চার করেছেন, তাঁর অবারিত দ্বারে সবাইকে গ্রহণ করেছেন ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে।
দেশ ও জাতির সব ধরনের শুভ উদ্যোগের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বলা অপ্রাসঙ্গিক নয় যে ব্যতিক্রমী যেকোনো কাজে উদ্যোগী হতে, লক্ষ্যে স্থির থাকার জন্য যে চারিত্রিক দৃঢ়তা, নীতিবোধ আর কর্মসূচি নিয়ে সবার জন্য শুভ হয় এমন কিছু করার উদ্যোগ এবং তার সফলতার জন্য যে নৈতিকতাকে ধারণ ও লালন করতে হয়—সেটাই তাঁর ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে মণ্ডিত করেছে। দেশে শোষণ-বঞ্চনার শিকার অবহেলিত নারীসমাজের সার্বিক মুক্তির বিষয়টিও তিনি সমাজের সামনে, রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরেছেন দৃঢ়তা নিয়ে।
এ কথা সত্য যে কবি সুফিয়া কামাল নিজের জবানিতে বলেছিলেন, ‘আমরা জন্মেছি এক আশ্চর্য সময়কালে’; সেই উনিশ শতকে এই বাংলায় যে সামাজিক জাগরণ তৈরি হয় তাতে সমাজ সংস্কারমূলক কাজ, যা জনহিতকর কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তার সঙ্গে নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। দূর-অতীত ও নিকট-অতীতের ঘটনাবলি স্মরণ করায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে নির্ভীক সংগ্রামী, মানব দরদি সুফিয়া কামালকে সমগ্র জাতি, জাতির বিবেক অভিধায় ভূষিত করে তাঁর নেতৃত্বে পথ চলেছে শেষ অবধি। তিনি বলতেন, রাজনৈতিক কোনো দল তিনি করেন না, রাজনীতি বোঝেন না, রাজনীতি করেনও না। কিন্তু দেখা গেছে যখন যেখানে অন্যায়, অত্যাচার হয়েছে সেখানে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। তাঁর কাছে শুভবুদ্ধির সচেতন মানুষ যখন ছুটে এসেছে, সেই সময়ও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে, নিজেকে প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। বৈষম্য, অন্যায়-অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠনের হাত থেকে মুক্ত হতে যে প্রয়োজন সমতা, ন্যায়পরায়ণতা, ন্যায়বিচার আর শোষণহীন শান্তিপূর্ণ অবস্থা, যা মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া কখনোই সম্ভব নয়। আর সে কারণেই তিনি রাজনৈতিক ধারণাকে বিনির্মাণ করাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেছেন। রাজনীতির বিনির্মাণে প্রচলিত প্রথাকে তিনি আঘাত করেছেন প্রত্যক্ষ ও প্ররোক্ষভাবে রাজনীতির অঙ্গনে। সমাজ মানসে কী চলছে, আর কী চলা প্রয়োজন—সে বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে উঠে আসে সুফিয়া কামালের কথা, নারী আন্দোলনের কথা ও কাজে।
বলা হয়ে থাকে, প্রচলিত রাজনীতির ধারণায় শুধু পুরুষের রাজত্ব চলে বলেই পুরুষতান্ত্রিক মডেলই রাজনীতির ধারণার নির্ধারক। এখানে রাজনীতির অর্থ হচ্ছে ক্ষমতা, আধিপত্য আর প্রতিযোগিতা। এই ক্ষমতা বলতে আধিপত্য নিয়ন্ত্রণ ও বর্জনই হচ্ছে মূল কথা। সমাজচিন্তকদের মতে, নারী আন্দোলনকর্মীদের কাছে ক্ষমতা মানে মুক্ত স্বাধীন হওয়া, যুক্ত করা এবং সমতা প্রতিষ্ঠা করা। বাজার অর্থনীতির বৈষম্যের বিপরীতে জবাবদিহি ও কল্যাণমূলক অর্থনীতিকে আবাহন করে। কারণ এত করে মানুষ বিশেষত নারী, শিশু, অসুস্থ বৃদ্ধ প্রান্তিক জনগণের পাশাপাশি পরিবেশ, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়।
সুফিয়া কামাল চিন্তা-চেতনায় স্থির লক্ষ্যে পৌঁছার অঙ্গীকারে ছিলেন অনড়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আন্দোলন-সংগ্রামে মানুষের অভূতপূর্ব অংশগ্রহণই রাজনীতিতে এজেন্ডা বদল করতে পারে, অন্য কিছু নয়। কারণ জনগণই ক্ষমতার উৎস। এই জনগণকে নিয়েই সহিংসতা, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন ও ধর্মীয়-জাতিগত সাম্প্রদায়িকতা বন্ধের পথে অগ্রসর হওয়া যায় সাহস আর শক্তি নিয়ে। এর বিকল্প কিছু নেই।
সুফিয়া কামালের সাহস ও দৃঢ়তার প্রকাশ দেখা গেছে বারবার। যেকোনো রাজনৈতিক দুর্যোগে তাঁকে কেন্দ্র করে যে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তাও আজ ইতিহাসের পাতায়। গণতন্ত্র ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ নামে নারী সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে, সেই তিনিই ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদের সদস্যকর্মীদের নিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হন অন্যান্য সংগঠনের নারীদের সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিতে। ১৯৯৩ সালে ফতোয়াবিরোধী আন্দোলনে তিনি তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত মহিলা পরিষদকে নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের রাজপথের মিছিল আজও সমান উজ্জ্বল। ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশে থেকে শক্তি ও সাহস জোগান এবং অনুপ্রেরণা দান করেন শত সহস্র মানুষের মনে।
দূর-অতীতের কথায় আসে দ্বিজাতিতত্ত্ব্বের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত পাক-ভারতে বিভাগপূর্বকালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সমাজসেবার বিভিন্নমুখী কর্মকাণ্ডে তাঁর অংশগ্রহণ, এর সঙ্গে রোকেয়ার সমাজ সংস্কারমূলক কাজ ও লেখনীর মধ্য দিয়ে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আহ্বানকে মনেপ্রাণে ধারণ করা, নিজের জীবনে তা মান্য করা, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী নারীদের সঙ্গে বিশেষত সাবিত্রী দত্ত, রেনু চক্রবর্তী, মনিকুণ্ডলা সেন, লীলা রায়, জুঁই ফুল রায়, নিবেদিতা নাগ, মনোরমা বসুসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তিনি যুক্ত হয়েছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে আনোয়ারা খাতুন, দৌলতুন্নেসা, ডলি ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেন, আবার ১৯৫৫ সালে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে মহিলাদের প্রথম ঘেরাও আন্দোলন পরিচালনা করেন। সুফিয়া কামালের কর্ম ও জীবনধারার ওপর বিভিন্ন গবেষণা পর্যালোচনা আমাদের বলে দেয় তাঁর সৃষ্টিশীলতার কথা, মানবতা বোধের প্রতি তাঁর দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা, প্রগতিশীল সমাজ নির্মাণে তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা, শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদী রূপের কথা। নারী মুক্তি, মানব মুক্তির চেতনার অগ্রসেনানি এই ব্যক্তিত্ব কবি হিসেবে গভীর সংবেদনশীল এবং অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হয়েও রাজনীতির বোঝাপড়ায় ছিলেন অত্যন্ত সচেতন, সাহসী আর স্থির প্রতিজ্ঞ। তাঁর অন্তরের তাগিদে তিনি কবি—আর মানুষের প্রয়োজনে তিনি অকুতোভয় সংগ্রামী, বাইরের আহ্বানে তিনি ছুটে গেছেন রাজনীতির অঙ্গনের দাবি আদায়ের সংগ্রামে। তাঁর অন্যতম গুণ সৃজনশীলতা আর বুদ্ধিমত্তাকে সমানভাবে কাজে লাগিয়েছেন সাহিত্য সাধনা আর রাজনীতির ময়দানে।
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে সুফিয়া কামালের একুশ শতকের চাওয়াকে দেখতে গিয়ে দেখি বাজার অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভোগবাদিতার সংস্কৃতি, সম্পত্তি, মুনাফা, লোভ, অর্থের উন্মাদনা তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের মধ্যে বাস করেও জনগণের মতামত মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের সম্পদ লুট হয়ে চলেছে; বাড়ছে জাতিগত সংঘাত ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। বাড়ছে হানাহানি, রক্তপাত, মূল্যবোধ কেড়ে নিচ্ছে বাজার। ‘পাবলিক’ গণ্ডির সম্পর্ক অর্থ দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। আর ‘প্রাইভেট’ গণ্ডিতে আবদ্ধ হচ্ছে মানবিক সম্পর্কগুলো। সমাজে নারী-পুরুষে বৈষম্য তীব্র। নারীর ওপর পুরুষের শক্ত নিয়ন্ত্রণ, এমনকি সহিংসতা এবং বিভিন্নমুুখী নারী ও শিশু নির্যাতন গ্রহণযোগ্য হচ্ছে। ক্ষমতাধরদের ছত্রচ্ছায়ায় বখাটে তৈরি হচ্ছে, বিচার না করে তাদের রক্ষাও করা হচ্ছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে সামাজিক শক্তির সংগঠিত প্রতিবাদী পদক্ষেপ তেমনভাবে দেখা যাচ্ছে না, যখন দেখি নানা হিসাব-নিকাশের টানাপড়েন, নানা বিবেচনায় সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিবেক সচেতন মানুষের আগের মতো জনহিতকর কল্যাণমুখী কাজে ভূমিকা নেওয়ার সাহস আর দৃঢ়তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে, ভয়াবহ নারী-শিশু নির্যাতন যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্থায়িত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে—তা মোকাবেলার উদ্যোগ যথার্থভাবে দেখা যাচ্ছে না; তখন আবারও নারী আন্দোলনের অগ্রদূত সুফিয়া কামালকে আমাদের মনে পড়ে। মনে পড়ে তাঁর সাহস, দৃঢ়তা আর অনড় ভূমিকার কথা। ফিরে যেতে মন চায় সেসব দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে, তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সংগ্রামী মিছিলে আবার অংশগ্রহণ করার আকাঙ্ক্ষায়। সবাইকে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে এসে প্রতিবাদী হতে, ভূমিকা নিতে, তাঁর মতো সৎ, নির্ভীক, মানবতাবাদী, মানব দরদি মানুষের আহ্বানের আজ বড়ই প্রয়োজন। নারী আন্দোলনের কর্মীরা আজ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। জন্মদিনে জননী তোমায় স্মরণ করি বারবার।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ