১৮৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারী শ্রমিকদের ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি এবং সহায়ক কর্মপরিবেশের দাবিতে আন্দোলনের স্মরণে বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলনের উদ্যোগে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় সদস্যভুক্ত সব রাষ্ট্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এ দিবসটি পালন করা হয়।
নারী আন্দোলন এই দিবসকে কেন্দ্র করে একদিকে আন্দোলনের অর্জন উদ্যাপন করে, অপরদিকে নতুন করে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় জাতীয় ও বৈশ্বিক নারী আন্দোলন ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। শুধু শ্রমজীবী নারী নয়, সব নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নারী আন্দোলন বহুমাত্রিকতা পেয়েছে।
নারীবাদী লেখক, দার্শনিক, চিন্তক, আন্দোলনের কর্মী সবার ভাবনা, চিন্তা, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আজ সব পর্যায়ে এই সত্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চলছে যে, বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী সমাজ-উন্নয়নে ক্লান্তিহীন ভূমিকা রেখে চলেছেন, যার স্বীকৃতি দিতে এবং মূল্যায়ন করতে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আগ্রহী হয় না।
নানা মাত্রায় দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত সব দেশ একমত হয়েছে যে, জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই পারে এই বিশ্বকে স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে, একটি সমতাপূর্ণ মানবিক সমাজ গড়তে- যেখানে বিশ্বের কোনো প্রান্তের লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র সম্প্রদায়, স্থান, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থানভেদে কেউই উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পিছিয়ে থাকবে না।
এবার আন্তর্জাতিক নারী দিবসে জাতিসংঘের স্লোগান হচ্ছে- ‘গ্রামের ও শহরের নারী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা নারীদের জীবন বদলে দেয়ার এখনই সময়।’ এ বছর জাতীয় প্রেক্ষাপটে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম শর্ত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর সম-অংশগ্রহণ ও সমঅংশীদারিত্ব : জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনে চাই সরাসরি নির্বাচন।’
আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে নারীর জীবনে আজ অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। নারীরা আজ সমাজের সব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। নারীরা রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সৃষ্টিশীল, চ্যালেঞ্জিং সব কর্মকাণ্ডে তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার প্রমাণ রাখছে। তারা অর্থনৈতিক, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। কিন্তু আমরা জানি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশীদার নারী উন্নয়নের ফলাফলের সমঅংশীদারিত্ব থেকে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছে। নারীর বহুমুখী দারিদ্র্যের অবসান, সম্পদ-সম্পত্তিতে সমঅধিকার, অর্জিত সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অধিকারহীনতা এসবই এখনও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিদ্যমান। নারী আন্দোলন মনে করে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব।
নারী মুক্তি, নারীর অধিকার, নারী-পুরুষের সমতা এগুলো সবই রাজনৈতিক ইস্যু। নারীর ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন সবই রাজনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ‘Personal is political.’ একজন ব্যক্তি নারীর মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার, মর্যাদা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, দারিদ্র্যমুক্ত, মর্যাদাপূর্ণ, সহিংসতামুক্ত, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনসহ সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা, ব্যক্তিজীবনের সব পর্যায়ে পছন্দ-অপছন্দ, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা- সবই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা।
তাই নারী যাতে সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে, নিজের পক্ষে আনতে পারে, নারীর মানবাধিকার সুরক্ষিত হয়- সেজন্য প্রয়োজন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। এর জন্য প্রয়োজন একদিকে রাজনীতি-সচেতন নারী সমাজের একটি সক্রিয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থান, অপরদিকে একটি জেন্ডার সংবেদনশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠী; রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে সব পর্যায়ে নারী কর্মীদের ক্রিয়াশীল থাকার পরিবেশ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা। সমাজজীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনার সব পর্যায়ে নারীর ফলপ্রসূ ও কার্যকর অংশগ্রহণ।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের অন্যতম সূচক হল সংসদীয় কার্যক্রমে নারীর সমঅংশগ্রহণ ও সমঅংশীদারিত্ব, যা কিনা এখনও দেশে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদে এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন সংরক্ষণ এবং সরাসরি নির্বাচনের আইন করা এখনও সম্ভব হয়নি। এই দাবিতে নারী আন্দোলন দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সংলাপ করছে।
নারী আন্দোলনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০০০ সালেই এ সংক্রান্ত একটি খসড়া বিলের প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, সব জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের কাছে জমা দেয়। কিন্তু নীতিগতভাবে একমত হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই সংসদে এ বিল উত্থাপন করেনি। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, দুই-তিন মেয়াদের জন্য সংসদে এক-তৃতীয়াংশ নারী আসন সংরক্ষণ, সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি (৪০০ থেকে ৪৫০), পাশাপাশি দুটি অথবা তিনটি সাধারণ আসনের বিপরীতে একটি সংরক্ষিত নারী আসনে নারী-পুরুষ উভয়ের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। নারী আন্দোলনকারীরা মনে করে সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এ ধরনের একটি ব্যবস্থা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অর্জন করতে সক্ষম হবে; নারী একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে; মর্যাদা, অধিকার, দায়-দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার সঙ্গে তারা রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে। রাজনৈতিক আলোচনার প্রাধান্য নির্ধারণ করতে পারবে, জেন্ডার ইস্যু গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় আনতে পারবে, সমতাপূর্ণ বিশ্ব গড়ায় তারা ভূমিকা রাখতে পারবে। সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনীত নারী সাংসদদের দ্বারা এটি সম্ভব হচ্ছে না। এ কথা তারা নিজেরাও স্বীকার করেন।
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, এ রকম একটি বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিপরিষদ আগামী ২৫ বছরের জন্য সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনে পুনরায় মনোনয়ন প্রথা চালু রাখার প্রস্তাব করেছে, যা নারী আন্দোলনকে বিস্মিত ও হতাশ করেছে। আমরা মনে করি, এই প্রস্তাবনা নারীকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত না করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিযুক্ত করবে। বর্তমান সরকার এবং সরকারি দলকে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি এগিয়ে নিতে হলে নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবি ও অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। তাই আমরা পুনরায় দাবি জানাচ্ছি, অবিলম্বে সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক।
মালেকা বানু : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর