আজ আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস ২০২২। বিশ্বের সকল আগত-অনাগত কন্যাশিশুদের প্রতি জানাই আজকের দিনে শুভেচ্ছা ও স্বাগত। দিবস পালনের মাধ্যমে বিভিন্ন দিবসের তাৎপর্য নিয়েই পালিত হয় দিবসটি। প্রতিটি দিবসের প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে একটি বার্তা জনসম্মুখে চলে আসে। দিবস পালনের তুলনায় বেশি না হলেও কম করে হলেও মানুষের মনে প্রভাব পড়ে। এতে করে খানিকটা হলেও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। আমরা এখনো দেখি পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি ছেলে এবং মেয়ে শিশুর প্রতি বৈষম্যের চিত্র। সেক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরে শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী পরিবার (পিতা-মাতা দু’জনেই উপার্জনক্ষম) পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষা পূরণের অপেক্ষা না করে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনেক পুরনো শ্লোগান ‘এক হলে ভালো হয়, দুইয়ের পরে আর নয়’ এই শ্লোগানকে ধারণ করে পরিবারের অভিভাবকের অনেক প্রকার আপত্তির মুখে দুটো কন্যা সন্তান হলেও বংশের প্রদীপ পুত্র সন্তান কামনা না করে তাকে যোগ্য করে তুলতে কোনো প্রকার বৈষম্য রাখেন না। তবে সে সংখ্যাটি নগন্য। শহর এবং সাবলম্বী পরিবারের বিপরীতের চিত্র হাওর বেষ্টিত গ্রামাঞ্চলের কন্যাশিশু প্রতি লিঙ্গবৈষম্য প্রকট। সেক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে একটি পুত্র সন্তানের আশায় ৬/৭ টি কন্যা সন্তান পৃথিবীর আলো দেখে ঠিকই। এই সমাজে অবহেলা অনাদরে বেড়ে ওঠা কন্যাশিশুরা হয় পরিবার ও সমাজের বোঝা।
সারাবিশ্বে জাতিসংঘ রাষ্ট্র সমূহে প্রতিবছর ১১ অক্টোবর তারিখে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করা হয়। এই দিবসকে মেয়েদের দিনও বলা হয়। লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা এই দিবসের অন্যতম উদ্দেশ্য। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র সমূহ হলো শিক্ষার অধিকার, পরিপুষ্টি, আইনী সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা, নারীর বিরুদ্ধে হিংসা তথা বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধ করা। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, প্রথম বারের থিম ছিলো বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, দ্বিতীয় বার মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্র অভিনব করে তোলা, তৃতীয় ও চতুর্থ বারের থিম কৈশোরকে ক্ষমতা সম্পন্ন করা ও হিংসা চক্র বন্ধ করা ও কৈশোর কন্যার ক্ষমতা ২০৩০’র পথ প্রদর্শক’’, ২০১৬ সালে থিম ছিলো মেয়েদের উন্নতি= লক্ষ্যর উন্নতি, ২০১৭ সালের প্রতিপাদ্য ‘মেয়েদের ক্ষমতায়নে জরুরী সহায়তা ও প্রতিরোধ পরিকল্পনা’, ২০২১ সালের প্রতিপাদ্য ‘শিশুর সঙ্গে শিশুর তরে বিশ্ব গড়ি নতুন করে’। কন্যাশিশুর নিরাপদ ও কল্যাণকর জীবন গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে দিবস পালনের মাধ্যমেই শুরু হয় কন্যা শিশু দিবসের পথচলা। এই পথচলা কন্যাশিশুর জন্য আশানুরূপ মসৃণ এখনো অনেক বাকি।
জন্মের পূর্বে ভ্রুণ নির্ণয়ের সুযোগ থাকার কারণে কখনো কখনো গর্ভের শিশুটি কন্যাশিশু জানার পরই ভ্রুণহত্যা বা গর্ভপাত করানো হয়।
প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কন্যা শিশুর ভূমিষ্টের বার্তাটি পৌঁছাতেও ছেলেশিশু এবং মেয়েশিশু হিসেবে বৈষম্য করা হয়। হিন্দুধর্মে উলুধ্বনি দিয়ে বার্তা পৌঁছানোর নিয়মেও দুটো উলুধ্বনি কম দেয়া হয় কন্যাশিশুর ক্ষেত্রে। এভাবেই বৈষম্যের মোকাবেলা করে পৃথিবীতে কন্যাশিশুর আগমন। কখনো সামাজিকভাবে কখনো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে একটি কন্যাশিশু বেড়ে ওঠাটাও হতে হবে আলাদা।
বিজ্ঞান প্রযুক্তির অবারিত সম্ভাবনার সুযোগ থাকা সত্বেও কন্যাশিশুটির হাতে খেলাধুলার সামগ্রী হিসেবে তুলে দেয়া হয় খেলানাবাটি, পুতুল, হাড়ি, পাতিল। কিন্তু ছেলেশিশুর বেলাতে উল্টো। সচেতনভাবেই আহারেও বৈষম্য করা হয়। তাকে পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়। পোশাক অলংকারের ক্ষেত্রেও থাকে বাধ্যবাধকতা। প্রতিদিন নানা প্রকার স্বাস্থ্যগত সমস্যার মোকাবেলা করেই কন্যাশিশু নারী হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে।
কন্যাশিশুর শিক্ষার সুযোগ প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পৌঁছানোর সংখ্যা নগন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শহর কিংবা গ্রামে উদ্যোমী মেধাবী মেয়েটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত সাহস করে পৌঁছাতে পারলেও উত্যক্তকরণ, যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি ঘটনার কথা অভিভাবককে জানালে অভিভাবক তাৎক্ষণিক লেখাপড়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে সংসারের বোঝা কমানোর জন্য তৎপর হয় পরিবারের সবাই। বাল্যবিবাহের শিকার হয় মেয়েটি। তখন সে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য দুটো থেকেই বঞ্চিত হয়। এই মেয়েটিই বিয়ের পর অধিক কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়ার ফলে তাক্ওে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হতে হয় এবং সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার ঘটনা অহরহ।
চলমান প্রথায় হাজারো বৈষম্যের শিকার কন্যাশিশু। একাধিক বা ততোধিক কন্যা সন্তানের জন্ম হলে নামকরণের ক্ষেত্রে নেতিবাচক শব্দের ব্যবহার মাধ্যমেও অবহেলা ও উপহাস করা হয়। যেমন-ইতি, সমাপ্তি, ক্ষমা, সীমা ।
সকল প্রকার লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে নিরাপদ ও কন্যাশিশু বান্ধব বিশ্ব গড়ার দায়িত্ব আমার, আপনার, সকলের। আসুন কন্যাশিশুর জন্য নিরাপদ বিশ্ব গড়ি।
লেখক : সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ও সভাপতি, সুনামগঞ্জ জেলা শাখা।
সূত্র : দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর