নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার- এই বিষয়গুলো দেশকাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা থাকলেও এদের মধ্যে রয়েছে একটি সর্বজনীন সম্পর্কের সূত্র। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস- যে দিনটি দেশে দেশে নারী আন্দোলনের মধ্যে একটি মেলবন্ধন তৈরি করে। নারীর অগ্রগতিকে এই দিনে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়। দিনটি নারী আন্দোলনকারীদের সংহতির দিন।
উনিশ শতকে যখন পশ্চিমা বিশ্বে শিল্পের ব্যাপক বিকাশ ঘটে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রসার লাভ করতে থাকে, তখন শিল্প, কলকারখানায় নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আর বিশ শতকের শুরু থেকে কাজের পরিবেশ, শ্রমিকের মজুরি, কর্মঘণ্টা, ভোটের অধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়ে নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম বিকশিত হতে থাকে।
এই পটভূমিকায় ১৯১০ সালে সংগ্রামী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কোপেনহেগেনে। এই সম্মেলনে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেৎকিন আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপনের ধারণাটি উত্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব করেন, নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে বছরে একটি বিশেষ দিন নারী দিবস হিসেবে বিশ্বে প্রতিটি দেশে উদ্যাপিত হবে। এই সম্মেলনে ১৭টি দেশের শতাধিক প্রতিনিধি সমবেত হয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দল, কর্মজীবী নারী, ট্রেড ইউনিয়ন ও নানা সংগঠনের প্রতিনিধি। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ফিনল্যান্ডের সংসদে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত তিনজন নারী সদস্য। ক্লারা জেৎকিনের প্রস্তাব সব প্রতিনিধি সমর্থন করেন। এভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের সূচনা ঘটে, যা নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণার পরবর্তী দুই বছর অর্থাৎ ১৯১১ ও ১৯১২ সালে দিনটি পালিত হয় ১৯ মার্চ। ১৮৪৮ সালের ১৯ মার্চে প্যারি কমিউনের বিপ্লবের দিনটি স্মরণ করে এই তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, ওই বিপ্লবে ছিল নারীদের বিশেষ অংশগ্রহণ। ১৯১১ সালের ১৯ মার্চ সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয় অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও সুইজারল্যান্ডে। নারীর ভোটের অধিকার, কাজের অধিকার ও বৈষম্য দূর করার দাবি নিয়ে প্রথম নারী দিবস পালিত হয়। এই নারী দিবস পালনের কয়েক দিন পর ২৫ মার্চ নিউ ইয়র্কের পোশাক তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ১৪০ জনের অধিক নারী শ্রমিক মৃত্যুবরণ করেন। এই প্রাণহানির কারণ ছিল যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব। এর ফলে আমেরিকায় শ্রম আইন ও শ্রমিকদের কাজের ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং প্রতিবাদ শুরু হয়। এ ঘটনার পর ১৯১৩ সাল থেকে ১৯ মার্চের পরিবর্তে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী দিবস পালন শুরু হয় এবং কালক্রমে তার বিস্তার ঘটে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে, জাতিসংঘের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
১৯১০ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। জাতিসংঘ নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নানা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৭৫ সালকে নারীবর্ষ ঘোষণা, ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ সনদ (সিডো) গ্রহণ এবং এর পর থেকে চারটি আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চতুর্থ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে কর্মসূচি (বেইজিং কর্মপরিকল্পনা) মূল্যায়নের লক্ষ্যে নারীর মর্যাদাবিষয়ক কমিশনের (CSW) উদ্যোগে বেইজিং+৫, বেইজিং+১০, বেইজিং+১৫ মূল্যায়ন সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চে (৯-২০ মার্চ) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বেইজিং+২০ সম্মেলন; যেখানে মূল ফোকাস থাকবে বেইজিং ঘোষণার ২০ বছর পরবর্তী মূল্যায়ন এবং জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বেইজিং কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্জন ও চ্যালেঞ্জগুলো নির্দিষ্ট করা ও করণীয় নির্ধারণ।
নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ক্রমে ক্রমে জাতিসংঘের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে পরিণত হচ্ছে। এই পটভূমিকায় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ উদ্যাপন অধিকতর তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে নারী দিবস পালনের সূচনাকালের কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের শেষাশেষি। প্রগতিশীল নারী নেত্রীরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সীমিত আকারে গোপনভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রকাশ্যে প্রথম ‘নারী দিবস’ পালিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে। সভাপতিত্ব করেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। পরে ১৯৭০ সালের ৪ এপ্রিল এই সংগ্রাম পরিষদ মহিলা পরিষদ নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এভাবে বাংলাদেশে নারী দিবস পালনের সূচনা ঘটায়। ১৯৭১ সালে নারী দিবস পালন সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নিয়মিত প্রতিবছর নারী দিবস পালন করে আসছে। বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নারী দিবস পালিত হচ্ছে। এই দিনটি সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে পালিত হচ্ছে।
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের জাতিসংঘের স্লোগান হচ্ছে Empowering women, Empowering humanity : picture it অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন, মানবতার ক্ষমতায়ন : তৈরি করুন চিত্ররূপ।
এই স্লোগানের সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশে নারীর অবস্থানের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে বাংলাদেশের নারীর জীবনে এসেছে বেশ কিছু পরিবর্তন। নারীর অধস্তন অবস্থান বদলাতে যুক্ত হয়েছে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ। অধুনা সমাজের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারীর অংশগ্রহণ দৃশ্যমান নয়। নির্মাণ শ্রমিক থেকে সেনাবাহিনী- সব ক্ষেত্রে রয়েছে নারীর সফল পদচারণ। বাংলাদেশের নারী আজ হিমালয় জয় করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান লাভ করছে। নারী অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে সরকার গ্রহণ করেছে নানা নীতিমালা, বিধিবিধান, প্রণয়ন করেছে নারীবান্ধব আইন ও জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি আনছে যে পোশাকশিল্প সেখানে কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ নারী। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই খাতে নারীর নেই ন্যূনতম কর্মসহায়ক পরিবেশ ও নিরাপত্তা, নেই সমমজুরি। কৃষিকাজের ২২টি ধাপের ১৯টিতে রয়েছে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ। কিন্তু জমির মালিকানা না থাকায় নারী কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে; কিন্তু এই শ্রমশক্তির বেশির ভাগ যুক্ত হচ্ছে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ নারীর অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারছে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর অসম অবস্থান এবং সম্পদ ও সম্পত্তিতে অধিকারহীনতা। শুধু অংশগ্রহণের সংখ্যা বৃদ্ধি অবস্থানের পরিবর্তন আনতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম-অংশীদারি।
যখন বলা হচ্ছে ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘন’, সেই সময় কেবল নারী হওয়ার কারণে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৃহে, কর্মস্থানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, হাটবাজারে, রাস্তায় নারী হচ্ছে সহিংসতার শিকার। গবেষণায় দেখা যায়, ৮০ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার। জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নারীর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, প্রতিকূল পরিবেশে নারী তার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যতটা অগ্রসর হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র চাহিদানুসারে সেই সহায়ক শক্তি হিসেবে নারীর পাশে দাঁড়াচ্ছে না।
নারীর জীবনের নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নারীর অগ্রগতির সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। সেই সম্ভাবনাকে অগ্রসর করে নেওয়ার লক্ষ্যে করণীয় নির্ধারণ আজকের নারী আন্দোলনের কাজ। অংশগ্রহণ থেকে অংশীদারির বাস্তবায়নপ্রক্রিয়াকে অগ্রসর করতে হবে আজকের নারী আন্দোলনকে। নারীর মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠায় করণীয়গুলোর সুস্পষ্ট ছবি সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। এর অন্যতম হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত সিডো সনদ, জাতীয় ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের দাবি ও করণীয়গুলো তুলে ধরে সম্মিলিত উদ্যোগে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও নাগরিক সমাজের ভূমিকা আবশ্যিকভাবে থাকতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন, মানবতার ক্ষমতায়ন- এই সত্যটা গ্রহণ আজকের সমাজের দায়।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ