ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় যে নবজাগরণ ও নবজিজ্ঞাসার উন্মেষ ঘটে, সেখানে সমাজের নানা কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা ও অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সঞ্চারিত হতে থাকে। সেই প্রতিবাদে নারীর অবমাননাকর ও মানবেতর জীবনের প্রতিও দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। এর আগে নারীর অবস্থান নিয়ে তেমন প্রশ্ন কেউ তোলেনি। রেনেসাঁর এই প্রগতিশীল ও অগ্রসরমাণ চিন্তার সম্প্র্রসারণ ছিল রোকেয়ার চিন্তা-চেতনা ও কর্ম।
রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের চিন্তার পরম্পরা হচ্ছেন রোকেয়া। কিন্তু বাংলার নবজাগরণের মুক্তবুদ্ধি চর্চার বিশ্লেষণে রোকেয়ার নাম তেমন উচ্চারিত হয় না।
প্রকৃত সমাজচিন্তক হচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, গভীর বিশ্লেষণ সমসাময়িক কাল অতিক্রম করে ভবিষ্যতের পথরেখা নির্ণয় করে। রোকেয়া ছিলেন সেই ধারার সমাজচিন্তক। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, রামমোহন দিয়েছেন বাংলার নারীকে প্রাণ, বিদ্যাসাগর দিয়েছেন জীবন। আমরা বলতে পারি, রোকেয়া দিয়েছেন নারীকে আত্মমর্যাদার সচেতনতা। রোকেয়া মনে করতেন, এই আত্মমর্যাদা ও অধিকার নারীকে আদায় করতে হবে; নিজে জাগতে হবে, অন্যকে জাগাতে হবে। তিনি মনে করতেন, নারীকে আত্মশক্তি বিকাশের মাধ্যমে সুযোগ গ্রহণের যোগ্য হতে হবে। তিনি গুরুত্ব দিলেন নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও অবরোধের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে। তিনি বলেছেন, ‘কন্যাগুলোকে সুশিক্ষিত করিয়া কর্মক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক। ’
রোকেয়ার বিশিষ্টতা ও আধুনিকতা এখানেই যে তিনি নারীকে দেখেছেন মানুষ হিসেবে। তিনি বলেছেন, ‘ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন—অগ্রসর হউন সকলে। সমস্বরে বল আমরা মানুষ। ’ মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার আদায়ের আহ্বান তিনি জানিয়েছেন, যা আজকের নারী আন্দোলনের মূল বক্তব্য—নারীর অধিকার মানবাধিকার। রোকেয়ার আগে বা সমসাময়িক কালে অনেকে হয়তো নারীশিক্ষা ও উন্নয়নের কথা বলেছেন, কিন্তু নারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা ও অধিকার রয়েছে—এমন অগ্রসর চিন্তা তেমন একটা পাওয়া যায় না।
রোকেয়ার সব লেখা ও কাজ নারীর মানবাধিকারকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন নারীবাদী সমাজচিন্তক। তিনি নারীবাদী তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। ভারতবর্ষের নারীর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থানের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন এবং তা পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে নারীমুক্তির পথরেখা নির্দেশ করেছেন। নারীর অধিকার, নারীমুক্তি নিয়ে এর আগে ম্যারি ওলস্টোনক্র্যাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, ভার্জিনিয়া উলফসহ অনেকের ভাবনার সামঞ্জস্য রয়েছে তাঁর লেখনীতে। আত্মমর্যাদাহীন নারীর মধ্যে আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলা ছিল তাঁর লেখা ও কর্মের মূলমর্ম। তাঁর রচিত ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচূর’, ‘পদ্মরাগ’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’সহ বিভিন্ন রচনা সমাজে নারীর অবমাননা ও নিগ্রহের চিত্র তুলে ধরেছে তীব্রভাবে। সমাজের পুরুষতান্ত্রিকতার রূপ রোকেয়া তাঁর রচনায় তুলে ধরেছেন। পুরুষতন্ত্রের আফিমে বুঁদ হয়ে রয়েছে সমাজমানস, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার কথা তিনি বারবার বলেছেন। তিনি যেমন বলেছেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কি রূপে? কোনো ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কত দূর চলিবে। পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে—। ’ নারী-পুরুষের এই অভিন্ন অধিকারের ধারণা হচ্ছে লিঙ্গসমতা, যা নারী ও পুরুষকে মানব হিসেবে দেখার লেন্স। নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্যের কারণ চিহ্নিত করা এবং এ ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে রোকেয়ার সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ বক্তব্য ছিল। তিনি বলেছেন, ‘আমরা অকর্মণ্য পুতুল-জীবন বহন করিবার জন্য সৃষ্টি হই নাই, এ কথা নিশ্চিত। ’ আজ নারীবাদী আন্দোলন, নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনের যে ভাষা, যে দর্শন তা রোকেয়ার লেখনীতে তেজোদীপ্তভাবে উঠে এসেছে। নারী-পুরুষের স্বার্থ সম্পূরক। রোকেয়া বলেছেন, ‘আমাদের উন্নতির ভাব বোঝার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি, একটি পরিবারে পুত্র ও কন্যার যে সমকক্ষতা থাকা উচিত, তা আমরা চাই। যেহেতু পুরুষ সমাজের পুত্র, আমরা সমাজের কন্যা…পুরুষের সমকক্ষতা পাওয়ার জন্য আমাদের যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। ’ বৈশ্বিকভাবে জাতিসংঘের সিডও সনদ একই কথা বলছে। বৈষম্য অর্থ ‘নারী-পুরুষ ভিত্তিতে যেকোনো পার্থক্য, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক অথবা অন্য যেকোনো ক্ষেত্রে মৌলিক স্বাধীনতা স্বীকার ও ভোগ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে, তা-ই বৈষম্য। ’ আজ থেকে শত বছর আগে নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে রোকেয়ার সাহসী উচ্চারণ আমাদের বিস্মিত করে।
রোকেয়া যে শুধু তত্ত্বকথা উচ্চারণ করেছেন তা-ই নয়, তিনি পথনির্দেশ করেছেন এবং সেই পথে একজন অ্যাকটিভিস্ট বা কর্মী হিসেবে হেঁটেছেন। তিনি নারীকে সচেতন ও সমবেত করার প্রয়াস নিয়েছেন। সংগঠন গড়েছেন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম। তিনি এই সংগঠনের মধ্য দিয়ে নারীমুক্তির লক্ষ্যে বহু কাজ করেছেন। শামসুন্নাহার মাহমুদ যখন তাঁর জীবনী লিখতে চেয়েছেন, রোকেয়া বলেছেন, ‘তুমি আঞ্জুমানে খাওয়াতিনের কাগজপত্র দেখো। আমার জীবনী পেয়ে যাবে। ’ রোকেয়া অবরুদ্ধ মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার জন্য সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করেছেন, অর্থ জোগাড় করেছেন। তবে স্কুল পরিচালনায় বাধা ও আঘাত কতটা প্রচণ্ড ছিল তা বোঝা যায় তাঁর কথায়, ‘স্কুলটা যে এত ঝঞ্ঝাপাত, এত শিলাবৃষ্টি, এত অত্যাচার সহিয়া এখনো টিকিয়া আছে তাহা যথেষ্ট। ’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যদি সমাজের কাজ করিতে চাও, তবে গায়ের চামড়াকে এতখানি পুরু করিয়া তুলিতে হইবে, যাতে নিন্দা, গালি, উপেক্ষা, অপমান কিছুই তাহাতে আঘাত করিতে না পারে। ’ ভারতবর্ষের নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। নারী তীর্থ সংগঠনের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের সমাজে পুনর্বাসনের কাজ করেছেন। নারী তীর্থ আশ্রমের কার্যনির্বাহী কমিটির সভানেত্রী ছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে পুরো ভারতবর্ষ ও বাংলা যখন সুপ্ত, তখন রোকেয়া লিখেছেন ‘সুলতানার স্বপ্ন’, নারীর মানব হওয়ার কল্পকাহিনি। রোকেয়া তাঁর লেখা বিষয়ে বলেছিলেন, তিনি লিখছেন ‘দেশের বা মনুষ্য জাতির মঙ্গল সাধনের জন্য। ’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আচার, প্রথা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি নারী-পুরুষ কাউকেই পূর্ণ মানুষ হতে দেয় না। পুরুষ ও নারীকে ভিন্ন ভিন্ন ছাঁচে ঢেলে খণ্ডিত মানুষ করে রাখে। এই গূঢ় কথাটা রোকেয়া অনুধাবন করেছিলেন।
এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আজও নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধানতম প্রতিবন্ধকতা হয়ে রয়েছে। নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে প্রতিমুহূর্তে এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আজকে নারীর পদচারণ ও দৃশ্যমানতা সমাজের সব ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নারীর সক্রিয়তা নেই।
কিন্তু নারীর অগ্রগতির বাস্তবতা হচ্ছে নারী অংশগ্রহণ করছে। তবে অংশীদারি পাচ্ছে না, ক্ষমতায়ন ঘটছে, কিন্তু ক্ষমতায়িত হতে পারছে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ এখনো ন্যূনতম পর্যায়ে। নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে নারীর প্রতি সহিংসতা, যা বৈশ্বিক ও জাতীয়ভাবে বিশেষ উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। করোনার এই মহামারিকালে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাতিরিক্ততাকে জাতিসংঘ ছায়া মহামারি হিসেবে অভিহিত করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সহিংসতার ক্ষেত্রে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও বাল্যবিয়ে নারীর অগ্রগতির যেসব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সেখানে বিশেষ হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। নারীমুক্তির পথে বিপুল বাধা মোকাবেলার পথরেখা ও প্রেরণা খুঁজে পাওয়া যায় রোকেয়ার লেখায় ও কর্মে। শত বছর আগে রোকেয়া যা বলেছেন, সেই ভাষায় আজও নারীকে কথা বলতে হচ্ছে, তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা আজও প্রাসঙ্গিক।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ