বিশ্বজুড়েই একদিকে যেমন নারীর ওপর অব্যাহত ধর্ষণ, যৌন সহিংসতাসহ বহুমাত্রিক নির্যাতন চলছে অপরদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ বৈষম্য নিয়েও জোরেশোরে আন্দোলন প্রচারণা চলছে। তাই এসব বিষয়ে যারা ন্যূনতম ওয়াকিবহাল আছেন এটুকু জেন্ডার ধারণা তাদের হয়ে থাকবে আশা করা যায়, সমাজ কর্তৃক নারী-পুরুষের মাঝে কাজ, পোশাক, চালচলন দিয়ে বিভাজন রেখা সৃষ্টি করে দেওয়ার নাম লিঙ্গ বৈষম্য। প্রতিমূহূর্তে এই বৈষম্যের মুখোমুখি আমরা হই কিন্তু এই বৈষম্য যে নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রধান অন্তরায় তা বুঝেও যে কেন বুঝি না সেটা এক বিরাট প্রশ্ন।
পূজা উপলক্ষে সেদিন এক জায়গায় একটি ভোজের আয়োজন ছিল। মস্ত বড় গামলায় বড় হাতা দিয়ে ভোজের প্রসাদ মাখা হবে। ভোগের সব রান্না করেছে যারা তারা সব নারী। সকল বাজার করেছে সেও এক নারী। কিন্তু যখন একজন নারী সেই প্রসাদ মাখতে যাবে তখন কয়েকজন নারী-পুরুষ বাধা দিল এই বলে- এটা অনেক শক্তির কাজ। কোনো নারীর পক্ষে করা সম্ভব না। একটি ছেলে বীরদর্পে এগিয়ে এলো সে কাজ করতে। বলল- সরেন, আমি করে দিচ্ছি। ওই নারী এর আগে আর সে কাজ করেননি তাই একটু অগোছালোভাবে করছিলেন। কিন্তু তার আত্মবিশ্বাস ছিল শেষপর্যন্ত কাজটা পারবেন। সেই ছেলে আর দু’একজন নারী বলতে থাকলেন, দিয়ে দাও। এসব ছেলেদেরই কাজ। নারী আর পুরুষে কি এমনি এমনি পার্থক্য আছে? ছেলেটির হাতে ছেড়ে দিলেন নারী।
তিনি চেয়ে দেখলেন ছেলেটা তার গায়ের জোরে কাজটি সারছে বটে তবে এসব কাজ করে সে অভ্যস্ত এবং সে স্বীকারও গেল যে সে এর আগে বহুবার করেছে। আদতে যে কোনো কাজের জন্যই যে গায়ের জোরের চেয়ে কৌশল ও অভ্যাসটা বেশি জরুরি। তা নারী-পুরুষের কাজের মাঝে বিভাজন টেনে দেওয়া এই সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষরা সে হোক নারী বা পুরুষ মানতেও চান না বুঝতেও চান না। তাই এক গামলা প্রসাদ মেখেই ছেলেটা যখন অধৈর্য চলে গেল তখন সেই নারীই একাধারে গামলার পর গামলা প্রসাদ মেখে শ’দুয়েক লোককে বিতরণ করলেন। কোনো পুরুষ এসে সহযোগিতা করেনি।
চোখের সামনে নিজের ঘরে পরের ঘরে মানুষ এখন দেখে অভ্যস্ত। আদতে নারী-পুরুষের কাজের কোনো বিভাজন হয় না। ইচ্ছে থাকলে ও চেষ্টা করলে নারী-পুরুষ সকলেই সব কাজ করতে পারে। যে নারী বাইরে চাকরি করেন তিনিই ঘরে ফিরে রান্নাবান্না করেন। ঘর সামলান। সন্তান সামলান। কারওর আরও এক্সট্রা কারিকুলাম একটিভিটিজও থাকে। সবকিছুতেই তারা সমান পারদর্শী।
এতো গেল নারীর কথা। পুরুষদেরও কেউ কেউ আছেন যারা সব পারেন। আমাদের অফিসের সজলদা কর্মস্থলের কোয়ার্টারে একা থাকতেন। তাও কোনো বুয়ার সাহায্য নিয়ে নয়- ঘর মোছা, কাপড় কাচা, বাসন মাজাসহ নানারকম রান্নাবান্না করতেন। সে রান্না নেহায়েত ডাল, আলু বা ডিম সেদ্ধ নয়। গৃহস্থ পরিবারে যেভাবে নানা পদের তরকারি-ভাজা-বড়া, লাবড়া, ডাল চচ্চড়ি, ঝোল, কালিয়া, চাটনি, মাংস-পোলাও রান্না করে খায় সজলদা সেভাবেই রান্না করে খেতেন। তাও একা একা নয়। নানাজনকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছেন। আমরা অনেকে অনাহুত হয়েও খেয়েছি। খুবই সুস্বাদু তার রান্না। সজলদাকে অবশ্য সবাই বাহ্বা দিত। হয়তো তিনি একা থাকতেন বলে। কিন্তু আমার চেনা একজন রমণী মাস্টার স্ত্রী ও পুত্রবধূকে ঘরের কাজে সাহায্য করতেন বলে পাড়ায় তাকে নিয়ে এই বলে হাসাহাসি হতো যে তিনি নামে যেমন রমণী কাজেও তেমন রমণী! অবশ্য রমণী মাস্টারের তাতে থোড়াই পরোয়া করতেন।
আবার আমাদের খেলার সঙ্গী আরতির বাপ ভাই ছিল না বলে সংসারের সব বাজার সেই করত। আর শুধু তার বাজার নয়, পাড়াপড়শির বাজারও করে দিত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে যার যার পাইপয়সা ফেরত দিত। আরতি শুধু বাজার করত যে তাই নয় সে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে মাছও ধরত। লাকড়িকোটা সংগ্রহ করত। কিশোরী আরতির এহেন সক্ষমতার জন্য তার মা নিজের বৈধব্য ও ছেলেসন্তান না থাকার কারণে কোনো অসুবিধায় পড়েনি। যদিও পাড়াপড়শি আক্ষেপ করে বলত- আহা রে, আরতির মার একটা যদি ছেলে থাকত আর অকালে বিধবা না হতো তবে কি আর আরতিকে মেয়েমানুষ হয়ে ছেলেমানুষের কাজ করা লাগত?
আরেকজন বিধবা ছিল কল্যাণের মা। কল্যাণ ছেলে হলেও শিশু ছিল। দু’তিনটে শিশু সন্তান ও তার নিজের ভরণপোষণের কোনো উপায় ছিল না কল্যাণের মায়ের। পেটের দায়ে সে একটিন কেরোসিনসহ এমন কিছু দরকারি জিনিসপত্র বাজার থেকে কিনে এনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করত। বাজার দূরে ছিল।
বাড়ির পুরুষমানুষ কাজের ধান্ধায় সকাল সন্ধ্যা বাইরে থাকে। একপোয়া কেরোসিন বা আধসের লবণ বা একটা ম্যাচ কিনতে বাজারে যাওয়ার সময় পায় না। তখন বাড়ি বয়ে দিয়ে যাওয়া কল্যাণের মা ভরসা। আর ব্যবসা করে কোনোমতে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এই সমস্ত খরিদ্দাররাও কল্যাণের মায়ের ভরসা। আজ থেকে প্রায় চার যুগ আগে যে গ্রাম্য নারী ব্যবসা করে সংসার চালাতে জানত তার আত্মসম্মানবোধ ছিল টনটনে। সে কারও কাছে কোনো সাহায্যের জন্য হাত পাতে না। তাই তার খড়ের ঘরের চালের খড় বাতাসে উড়ে গেলে বা পচে গেলে মই টেনে চালে উঠে বাঁশ-বেত দিয়ে চাল বান্ধে। হাওর থেকে খড় এনে চালের ছাউনি দেয়।
শুধু নারী হওয়ার কারণে প্রাত্যহিক প্রয়োজনে পরের মুখাপেক্ষী না হয়ে প্রচলিত ধারণায় পুরুষের কাজ করা স্বনির্ভর দুই নারী ও কিশোরী গ্রামীণ জীবনেও ব্রাত্য ও হাসির পাত্র ছিল। কিন্তু যারা আরতি বা কল্যাণের মায়ের মতো স্বনির্ভর না হয়ে অন্যের মুখাপেক্ষী থাকত তারা ছিল করুণার পাত্র। তাদের কালে-ভদ্রে দয়া করে সাহায্যকারীরা অনুগ্রহভাজন করে রাখত। আসলে পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে গড়া মগজ ও মননের মানুষ নারীর ঘরে-বাইরের সক্ষমতা সহ্য করতে পারে না। তারা চায় নারী সব কাজে সব ক্ষেত্রে পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকুক। পুরুষের চেয়ে ছোট হয়ে থাক। যদি ছোট করে রাখা না যায় যদি তাকে অধীন করে রাখা না যায় তবে তো তাকে শাসন করা যায় না। তাকে শোষণ করা যায় না। সমাজে শাসন শোষণ অব্যাহত রাখতে হলে মানুষে মানুষে শাসক ও শোষিতের সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। আর তার ভিত তৈরি হয় পরিবার থেকে। পরিবারে শাসন শোষণ কায়েম করতে পুরুষতন্ত্র নারীকে দুর্বল করে রাখে। তাকে প্রতিমুহূর্তে মনে করিয়ে দেওয়া হয়। তুমি নারী। তুমি পুরুষের মতো সক্ষম নও।
তোমার কাজ ঘরে। তোমার কাজ এটা নয়। তোমার কাজ ওটা। কিন্তু তারা ভুলে যায় যে একজন পুরুষকে নারীই জন্ম দেয়। দশমাস দশদিন বা নয়মাস বিশদিন যাই হোক না কেন এতগুলো দিন একজন নারী পুরুষকে তার গর্ভে ধারণ করে। তারপরও আরও অনেকগুলো বছর তাকে লালন করার বোঝাও যে নারীই বহন করে। এত বোঝা বহন করে সেই নারী যে কখনোই অশক্ত হতে পারে না সেটা মাথামোটা পুরুষতন্ত্র ভাবতেও পারে না। আর শুধু গর্ভধারণের বোঝা তো নয়, সংসারের পুরোটা বোঝাই তো তারা নারীর মাথায় তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভার থাকে আর বলে অবলা নারী। সে কথা শুনতে শুনতে গোয়েবলসীয় তথ্যের মতো নারী নিজেও মনে করে সে অবলা। সকলেই তাই আর আরতি বা কল্যাণের মা হতে পারে না। কিন্তু স্বনির্ভর হলেই-বা কি? দু’চারজন আরতি বা কল্যাণের মা হয়ে নারীর ক্ষমতায়ন তো করা যায় না।
ছোটবেলায় মামার গ্রামে দেখেছি বৈশাখ মাসে ধান কাটার ভরা মৌসুমে যখন কামলার অভাব হতো তখন কোনো কোনো কৃষক পরিবার বাড়ির মেয়েদের সেই কামলার কাজে লাগিয়ে দিত। তেমনি একজন কৃষক আপ্তর আলী তার দুই বউকে দিয়ে কামলার কাজ করাত। আপ্তর আলী তো আমাদের সমাজের সেই মানুষ যারা মনে করে নারীর কাজ ঘরে আর পুরুষের কাজ বাইরে। তারা আরও মনে করে নারীরা হচ্ছে বুদ্ধিগত ও শরীরগতভাবে এমন দুর্বল প্রাণী যারা কোনোভাবেই পুরুষের সমকক্ষ নয়। অথচ প্রয়োজনের বেলায় সেসব কথা তাদের মনে থাকে না। তাই আপ্তর আলী অবলীলায় তার দুই বউয়ের মাথায় দুই মণ ধানের বস্তা তুলে দিত আর সেই বউয়েরা অনায়াসে দুই কিলোমিটার পথ হেঁটে তা বহন করে বাড়িতে নিয়ে আসত। বাড়ি এনে তা আবার রোদে শুকিয়ে বাতাসে উড়িয়ে গোলায় তুলে রাখত তারাই। ধান সেদ্ধ করে আরেক দফা শুকিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে চাল করে মাড়াই ভরে রাখত। অবশ্য তার আগে ধানের বীজ থেকে চারা তৈরির কাজও তারা করেছে।
শুধু জমিনের হাল দেওয়া, চারা রোপণ করা আর ধান কাটার কাজটা করেনি কারণ সে আপ্তর আলী তা করতে দেয়নি বলে। কিন্তু যদি আপ্তর আলী তা করতে বলত তবে বাকি সব কাজও তারা অনায়াসে করে দিত। কারণ তারা জেনেছে আপ্তর আলী যা বলবে সেসব কাজ তাদের করতে হবে। এটাই নিয়ম। নারী পরের অধীন। সে যখন যার অধীনে থাকবে সে তাদের যা করতে বলবে তাই তাদের করতে হবে। সেজন্য ঘরের কাজ বলতে রান্নাবাড়ার কাজসহ ঘর-গেরস্থালির সকল কাজ সেরেও তারা আস্ত গাছ কুড়াল দিয়ে ফালি ফালি করে সারা বছরের লাকড়ি বানাত। গোয়ালের ছয় সাতটি গরুকে গোসল করানো, ঘাস খাওয়ানো আর দুধ দোহানের কাজ যা সাধারণত পুরুষের কাজ বলে ধরা হয় তাও করত তারা। এত সবকিছুর পরও আপ্তর আলী বউদের কোনো দোষ পেলে তাদেরকে মারধর করতে একটুও দ্বিধাবোধ করত না। বলত, আমার খাইয়া আমার পইরা আমারেই ঠ্যাং দেখাস? ঠ্যাং ভাইঙ্গা লুলা কইরা রাখমু। বউ দুটো ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ভাবত সত্যিই তো তারা আপ্তর আলীর নিকট খাওন-পিন্ধনের জন্য ঋণী। তাই তারা অনুতপ্ত হতো। বারবার ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে এরকম ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে অঙ্গীকার করত। দিনে তিনবেলার ভাত আর সালুন, বছরে দুই জোড়া চিকন পাড়ের নীল বা সবুজ শাড়ি এই ছিল তাদের খাওন-পিন্ধনের নমুনা। এইটুকুর মূল্যের সঙ্গে তাদের পরিশ্রমের মূল্যের বিচার করার ক্ষমতাও ছিল না। এমনকি এর যে তুল্যমূল্য করা যায় তাই তো তারা জানত না।
উপরে আপ্তর আলী ও তার দুই বউয়ের যে গল্প উল্লেখ করা হলো তা আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের গল্প। কিন্তু চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর পরে কি গল্পের প্রেক্ষাপট বা বিষয়বস্তু খুব একটা বদলেছে? কোথাও কোথাও এক আধটু বদলালেও সর্বত্র যে বদলায়নি তা আমাদের চারপাশে একটু চোখ বোলালেই বোঝা যায়।
আজকের দিনেও আমরা যখন গ্রামে বা শহরতলীর পাড়াগুলোতে নারীদের অধিকার সচেতন করার জন্য উঠান বৈঠক করতে যাই তখন দেখা যায় মেয়েরা প্রথমে সেই বৈঠকে আসতে চায় না। সেখানকার অর্গানাইজার যিনি তিনি বারবার তাগিদ দিয়ে যদিও বা তাদের নিয়ে এলেন তারা দাঁড়িয়ে থাকে। বসতে চায় না। অনেক বলার পর কিছুক্ষণ বসেই চলে যেতে চায় কাজের দোহাই দিয়ে। অথচ তাদের যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনি কী করেন; সেই পুরনো উত্তর আসে- ‘কিছু করি না!’ আবার যখন প্রশ্ন করা হয়, ‘তাহলে যে কাজ আছে বলে চলে যেতে চাইলেন?’
তারা বোকার মতো একগাল হেসে বলবে- অ! ইতান তো সংসারের কাজ। ইতান কাজে কি আর পয়সা মিলে? আর শুধু এরা নয় এমনকি, শহর গ্রামের মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত নারীদেরও যদি প্রশ্ন করা হয়, কী করেন তখন যারা কোনো চাকরিবাকরি করেন না, মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, না আমরা কিচ্ছু করি না। কিন্তু তারাও সেই সকাল থেকে রাত বারোটা ঘর সংসারের কাজ করেই চলেছেন। ইদানীং মেয়েদের গতানুগতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্কুল, কলেজ, প্রাইভেট টিউটর বা কোচিং সেন্টারে যাওয়া-আসা, বাজার করা, পরিবারের লোককে ডাক্তার হসপিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া, ব্যাংকে গিয়ে টাকা তোলা, বিদ্যুৎ-গ্যাসবিল জমা দেওয়ার বিচিত্র সব কাজ। দম ফেলার অবসর নেই এক একজনের। তাও তারা নাকি কিছু করেন না। সেই বিদেশি কবিতার ডায়লগ- সব কাজ করার পরও আমার বউ কোনো কাজ করে না। অর্থাৎ যে কাজ করলে পয়সা আসে না সে কাজ কোনো কাজ নয়। যা পুরুষরা মনে করে এবং তারা নারীদের মনে-মগজেও এই ধারণা এমনভাবে প্রবিষ্ট করিয়েছে যে দিনের আঠারো ঘণ্টা সংসারের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি দেওয়ার পরও পঁয়তাল্লিশ বছর আগের আপ্তর আলীর দুই বউয়ের মতন আজকের অধিকাংশ নারীও মনে করেন তারা কোনো কাজ করেন না। যেহেতু ওই কাজ করে হাতে টাকা আসে না।
তবে উঠান বৈঠকের আলোচনায় বোঝা যায়, পঁয়তাল্লিশ বছর আগে পরে এইটুকু পার্থক্য সূচিত হয়েছে যখন তাদের বুঝিয়ে বলা হয়Ñ ঘর-গেরস্থালির কাজ বলে যে কাজকে তারা মূল্যহীন ভাবেন সেই কাজ অন্য কোনো লোককে দিয়ে করাতে হলে যদি দিনে দেড় দুই ঘণ্টা কাজের জন্য মাসে দু’হাজার টাকা গুনতে হয় তখন দিনে যারা আঠারো ঘণ্টা কাজ করেন সে কাজের জন্য যে কিছু কাজ না-করা নারীদেরও সংসারের কাছে মাসে আঠারো থেকে বিশ হাজার টাকা পাওনা হয় সে হিসাব তারা করেন কিনা? এমন প্রশ্ন শুনে প্রথমে তারা হাসে তারপর গম্ভীর হয়ে মাথা চুলকে বলে- হ আপা, কথা তো ঠিকই কইছেন! আসলে আমরা তো এইভাবে হিসাবনিকাশ কইরা দেখি নাই। ঠিকই তো আমরা তো তাইলে অন্যের খাওন খাই না নিজের খাওনই খাই। খাইয়াও আরও পাওনা থাকে। কিন্তু সংসারের মানুষ তো স্বীকার যায় না। কেবল আমরারে ঋণী কইরা রাখে।
শিক্ষিত নারীরা বলে, আমাদের সমান শিক্ষা নিয়ে বড়রা যে চাকরি করে সেই শিক্ষা দিয়ে কি আমরা তা করতে পারতাম না? কিন্তু আমরা তো নিজের ইচ্ছায় চাকরি করতে পারি না যদি পরিবার সহযোগিতা না করে, অনুমতি না দেয়। আমরা মেয়েমানুষ। ঘরের কাজই আসল কাজ। আমরা বাইরে গেলে ঘর চলে কীভাবে? সন্তান মানুষ করে কে?
তাই তো মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে গেলে সংসার সামলায় কে? রান্নাবান্না ঘর-গেরস্থালি চালায় কে? সন্তানকে দেখাশোনা করে কে? তা এই সংসার ও সন্তানের মালিক কে? অবশ্যই পুরুষ। কারণ এখনো কোনো মা সন্তানের অভিভাবক নয়। পুরুষের ইচ্ছে না হলেই নারীকে ঐ সংসারে ছেড়ে যখন তখন চলে যেতে হয়। আর সংসার সন্তানের জন্য আজও নারীকেই ছাড় দিতে হয়। কিন্তু কেন? কেন একজন নারী তার ইচ্ছেমতো কাজ বা পেশা বেছে নিতে পারবে না? যথাযথ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও একজন নারী কেন বাইরের কর্মযজ্ঞে যোগ না দিয়ে চিরকাল ঘরের কোণে পড়ে থাকবে এসব প্রশ্নের সমাধান হয়নি আজও। দুঃখের বিষয় হলো, এ সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগও নেই। অথচ এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ পরিবার ও সমাজ। কেননা মানুষ জন্মগতভাবেই প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। প্রকৃতি বলুন আর ঈশ্বর বলুন তারা কেউই মানুষকে প্রতিভা বিতরণে কোনো লিঙ্গভেদ করেননি।
জন্মগতভাবে প্রাপ্ত এই প্রতিভা নিবিড় চর্চার মাধ্যমে বিকশিত হয়। সেজন্য লাগে সুযোগ, লাগে পরিচর্যা। আজকাল পরিবার ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে অনেক নারী প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন। এখন তারা যদি বিকশিত প্রতিভার প্রয়োগ না ঘটাতে পারেন, লিঙ্গ বৈষম্য বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বা বাইরের পৃথিবীতে নারীর সম্ভ্রমের নিরাপত্তাজনিত কারণে এবং ঘর সংসার ও সন্তানের প্রয়োজনে ঘরে আটকে থাকেন তাহলে পরিবার ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ যে মাঠে মারা যায় তার হিসাব কেন হচ্ছে না? কিন্তু আজ হিসাব করার বড় প্রয়োজন। এই ঘরে আটকে থাকা কত লক্ষ কোটি নারী হতে পারত দেশের দক্ষ প্রশাসক, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, প্রকৌশলী, কৃষক-শ্রমিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী ও সাংবাদিকসহ আরও নানা পেশার নানাজন! হিসেব করা প্রয়োজন অর্ধেক জনগোষ্ঠীর লোককে যোগ্য হতে না দিয়ে বা তাদের অর্জিত যোগ্যতাকে কাজে না লাগিয়ে বা যোগ্য লোক যোগ্য জায়গায় স্থাপিত না হয়ে ঘরে পড়ে থাকায় কত প্রতিভার অপচয় হচ্ছে আর অন্যদিকে তাদের খালি জায়গায় কত অযোগ্য লোক নিযুক্ত রয়েছে। যোগ্য লোকের অভাবে অযোগ্য লোক দিয়ে কাজ করানোর ফলে দেশের কত উৎপাদন সময় ও অর্থের ক্ষতি হচ্ছে তারও হিসাব করা যে প্রয়োজন নীতিনির্ধারকরা তা কবে বুঝবেন? কিন্তু না। সময় হয়েছে সব কিছু দ্রুত বুঝে নেওয়ার।
এ প্রসঙ্গে হয়তো কেউ প্রশ্ন করতে পারে, দেশের আইনে নারীর যেকোনো কাজ করতে বাধা তো নেই। অনেক নারী তাদের পছন্দমতো পেশা নির্বাচন করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। পরিবার থেকে বাধা দিলে রাষ্ট্রের কী করার আছে? হ্যাঁ, এ প্রশ্নের আংশিক সত্যতা হয়তো আছে কিন্তু বিপরীত প্রশ্নও তোলা যায় যে কেন পরিবার মেয়েদের যেকোনো চ্যালেঞ্জিং কাজে যেতে বাধা দেয়? কেন শুধু ঘরের কাজেই আটকে রাখে? তবে এও মনে রাখতে হবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে রাষ্ট্রের আইন অনেক ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, রাষ্ট্র যখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেয়েদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস ও ৬০ শতাংশ কোটা চালু করল আর স্কুল-কলেজে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দিল তখন দেশে নারী শিক্ষার হার বেড়ে গেল। মেয়েরাও শিক্ষিত হয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে একদশকে এরকম একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টি হয়ে গেল দেশে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংবিধানকে উপেক্ষা করে গত পঞ্চাশ বছর ধরে প্রচলিত পারিবারিক আইনগুলো যা নারী পুরুষের মাঝে সম্পদ সম্পত্তির, সন্তান-সন্ততির অভিভাবকত্বের, বিবাহ বিচ্ছেদগত অধিকারের ক্ষেত্রে বিভাজন টেনে দেয় সেই সমস্ত আইন দিয়ে রাষ্ট্র চলছে। অথচ রাষ্ট্রের পক্ষে এই সমস্ত বৈষম্যমূলক আইন বাতিল করার এখতিয়ার সংবিধান তাকে দিয়েছে। সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ১ ধারায় বলা হয়েছে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন। ১৯-এর ২ ধারায় বলা হয়েছে মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যান্য বৈষম্য বিলোপ করিবার জন্য নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সর্ব সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুবিধা দান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। কিন্তু উল্লিখিত ধারাসমূহ প্রচলিত পারিবারিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ১. মৌলিক অধিকারের সহিত অসামঞ্জস্য সকল প্রচলিত আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হইলে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে। ২. রাষ্ট্র এই ভাগের কোনো বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনো আইন প্রণয়ন করিবে না এবং অনুরূপ কোনো আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনো বিধানের সাথে যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
শেষ করব লিঙ্গ বৈষম্যের কথা দিয়েই। বছর দেড়েক আগে দেশের একজন প্রতিথযশা শিক্ষাবিদ অনেকে যাকে বাতিঘর বলেন, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর বলেন তিনি বাঙালি নারীকে কেন শাড়িই শুধু পরতে হবে সে বিষয়ে বাঙালি নারীর আকার আকৃতি বিকৃত করে কত রকমের ব্যাখ্যা দিলেন। এই যদি হয় আলোকিত মানুষের বক্তব্য তখন নারী নির্যাতনকারী ধর্ষকদের রক্ষক এবং প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করবে তাকে বাইরের কর্মযজ্ঞে শামিল হতে নিরুৎসাহিত করে চার দেয়ালে বন্দি থাকার নসিহত দেবে এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে!
তাই মানবাধিকারে বিশ্বাসী মানুষকে লিঙ্গ বৈষম্যের মতো এই সমস্ত ফাজলামি আলোচনার টুঁটি চেপে ধরতে হবে। মনে রাখতে হবে, বৈষম্য মানবাধিকারের পথে পাহাড়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নারীর ক্ষমতায়ন মানুষেরই ক্ষমতায়ন। আমাদের সংবিধান সকল মানুষের ক্ষমতায়নের কথা বলেছে। সকল মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার কথা বলেছে। সংবিধান সমুন্নত রাখতে, মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখতে সকল প্রকার বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে রাষ্ট্র এবং নাগরিককেই দায়িত্ব নিতে হবে।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখা
সূত্র : খোলা কাগজ