পত্রিকার একটা প্রতিবেদনে দেখলাম সন্তান মেয়ে হয়েছে জেনে হাসপাতালেই ঝগড়ায় লিপ্ত হয় বাবা। তারপর নবজাতক মেয়েসন্তানটিকে হাসপাতালে রেখে বাবা-মা দুজনেই পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা হয়তো সচরাচর ঘটে না। সকল পরিবারেও এখন আর মেয়েসন্তানকে অতটা গুরুত্বহীন মনে করা হয় না। ধনী-গরিব গ্রাম শহর নির্বিশেষে প্রায় সব মা-বাবা তাদের মেয়েসন্তানকে যথেষ্ট আদর-যত্নও করে থাকেন। স্কুল-কলেজেও পাঠান। মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানো বা উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্নও দেখেন এখন অনেকে এবং এই স্বপ্নের ফসল হিসেবে দেশে আজ অগণিত মেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, আমলা, বিজ্ঞানী, আইন বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী যারা যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে দেশের জন্য অবদান রেখে চলেছেন। আছেন প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক যারা চারদিকে আলো ছড়াচ্ছেন। এদের সফলতা আরও অসংখ্য মেয়ে ও তাদের মা বাবাকে অনুপ্রাণিত করছে।
এর ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলে শিক্ষার্থীদের থেকে মেয়ে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ তুলনামূলক বেশি এবং পাবলিক পরীক্ষায়ও এরা ভালো ফলাফল করে। কিন্তু মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার সময়েই এই হার কমতে থাকে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত যারা ভর্তি হয় তারাও সকলে পরীক্ষা পর্যন্ত আর যেতে পারে না। যারা সেটা পারে তাদেরও অধিকাংশ শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষাটা চালিয়ে যেতে পারে না। মাঝপথে গতি থেমে যায়। এই থেমে যাওয়া পড়া শেষ করতে না পারার কারণ হিসেবে অনেকেই অর্থনৈতিক সমস্যা, অভাব অনটনের কথা বলেন। কিন্তু আসল কারণ অন্য। পরিবার যতই মেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে বিনিয়োগ করুক না কেন এখনো পর্যন্ত মেয়েদের জন্য তার চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং প্রধান কর্তব্য হিসেবে মনে করে একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ের আয়োজন করা। মেয়েটার পড়ালেখা শেষ করে একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে তাকে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ না দিয়ে পাত্রের জন্য অস্থির হয়ে পড়েন তারা। আর এই ভালো পাত্রের সংজ্ঞা হলো যার আয় রোজগার ভালো। এখন সেটা সে ব্যবসা বা চাকরি বা চুরি ডাকাতি করে বা কারও পেশিশক্তি হয়ে যে করেই করুক। সে যদি তেমন লেখাপড়াও না জানে কিন্তু বিদেশে হোটেলের ডিশ ওয়াশার, ওনিয়ন বা পটেটো কাটার হোক কিংবা হোক রাস্তার ঝাড়ুদার তাও সই যদি তার রোজগার ভালো হয় তবুও সে ভালো পাত্র অথবা পাত্রের বাবার বাড়ি আছে, দালানকোঠা আছে, প্রচুর ফসলের জমি আছে, ব্যবসা ও ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। তাতে সে মাতাল হোক, বদমাশ হোক, লম্পট হোক, বদমেজাজি হোক। সে ভালো পাত্র। আর সেরকম পাত্রের জন্য মেয়েদের বাবা ও পরিবার হামলে পড়ে। যার যেমন সামর্থ্য আছে জামাইকে খুশি করতে অকাতরে ব্যয় করে। কিন্তু তবু মেয়েকে সম্পত্তি দেবে না। মেয়ের বিয়ে দিতে যার সাম্যর্থ্য নেই তারা আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে হাত পাতে ভিক্ষে করে। তারা বলে, মেয়েকে পার করতে হবে তো এমনকি এদের কাজকে সাপোর্ট করা একটা গোষ্ঠী আছে। তারাও বলে- করবে কী, মেয়েটাকে পার করতে হবে না!
তার মানে কী দাঁড়াল পরিবারের কাছে মেয়েটা শেষপর্যন্ত একটা বোঝা একটা দায়। সেজন্যই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ঘাড়ের এই বোঝা নামানোর জন্য এত আয়োজন এত তোড়জোড়। কিন্তু নিজেকে কন্যাদায়গ্রস্ত মনে করা পিতারা যদি মেয়েটাকে বোঝা না ভেবে আরেকটু এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় যদি স্বাবলম্বী হওয়ার সময় দেয় তাহলে ওই মেয়েটা পরিবারের বোঝাত নয়ই বরং সে সংসারের সকল বোঝা বইতে সক্ষম হয়। মূলত সংসার বা পরিবার মনে করে এরকম কিন্তু লেখাপড়া শিখে স্বাবলম্বী হোক আর না হোক মেয়েরা কখনই বোঝা নয়, উল্টো সারাজীবন বেগার খেটে তারা সংসারের সকল বোঝা বহন করে।
কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দিয়ে মা-বাবা ঘাড়ের বোঝা হালকা করতে চাইলেও সবসময় যে বোঝা নেমে যায় তা কিন্তু নয়। বোঝা নামানোর নামে তড়িঘড়ি করে যেখানে-সেখানে বিয়ে দেওয়ার ভুলের খেসারত হিসেবে অনেকের ঘরেই মেয়েটা শেষপর্যন্ত বোঝা নিয়ে ফিরে আসে। কেননা শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে তো সে একা আসে না, সঙ্গে করে দু’একটি সন্তানও নিয়ে আসে। তাই দেখা যাচ্ছে বিয়ে নারীর জীবনের মুক্তি নয়। বরং বিয়ে তার জন্য একটা দাসত্বের চুক্তি ছাড়া কিছু নয়। কিছু ব্যতিক্রম বা খুব সামান্য একটা অংশের নারী ব্যতীত বিয়ে নামের ওই অনুষ্ঠান অধিকাংশ নারীর জীবনের সমস্ত আশা আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন সাধনা, ইচ্ছা অনিচ্ছা, ভালোলাগা মন্দলাগার অধিকার হরণ করে নেয়।
কিন্তু বিয়ে একটি ছেলের জীবন থেকে কিছুই কেড়ে নেয় না। তার জীবন থেকে কোনো কিছু বিয়োগ হয় না কেবল যোগ হয়। বিয়ে তাকে অন্তত একজনের ওপর তার কর্তৃত্ব করার সুযোগ এনে দেয়।। যদি সে ভিখারিও হয় তব্ওু সে বিয়ের কারণে একজনের প্রভু হয়ে ওঠে কর্তৃত্বকারী বা নিয়ন্ত্রণকারীর ভূমিকা পালন করে। তাই দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মেয়েটি যে অনার্স মাস্টার্সের পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় হয়েছিল আর তার প্রেমিক যে শুধু ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিল বিয়ের পর স্বামী হয়েই সে তার মেধাবী প্রেমিকার জীবনের নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে যায়। সে মেয়েটিকে বিসিএস পরীক্ষায় আর বসতে দিল না। কারণ সে জানে তার স্ত্রীকে বিসিএসে বসার সুযোগ দিলে চাকরিটা ওরই আগে হবে। সে বলে দুজনে চাকরি করলে সংসার কে দেখবে ছেলে-মেয়ে দেখবে কে মেয়েটি যতই মেধাবী হোক তার ভালোবাসার প্রতি দুর্বলতা, সংসার ও ছেলে-মেয়ের প্রতি দুর্বলতা থাকেই। এই দুর্বলতা তাকে আপস করতে বাধ্য করে। আদতে তাকে বাধ্য করে পিতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা তাকে বলে তোমাকে একটা বেছে নিতে হবে। সংসার না ব্যক্তিস্বাধীনতা প্রেম না আত্মসম্মানবোধ মাতৃত্ব না মর্যাদা সংসার, প্রেম, মাতৃত্ব এসব কিছুর প্রতি দুর্বলতা অপরাধ নয়, মানবিক বিষয়। আত্মসম্মানবোধ, ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের অধিকারও মানুষের মানবিক দাবি। এদের একটির সঙ্গে আরেকটির বিরোধ থাকার কথা নয় কিন্তু পিতৃতন্ত্র সবসময় সংঘাত লাগিয়ে দেয়।
জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। অথচ এই সমাজ সংসার জন্মের পর থেকেই একটি মেয়েকে ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রথা আচরণ ও বিশ্বাসের কথা বলে থামিয়ে দেয়। ছেলেতে-মেয়েতে এমন বিভাজন রেখা টেনে দেয় যে মেয়েটা বেড়ে ওঠে দুর্বল হয়ে। নতজানু হয়ে। তার সাহসের অভাব। আত্মবিশ্বাসের অভাব। তাকে অন্যকে অবলম্বন করে চলতে শেখানো হয়। কেউ যদি এই বিভাজন রেখা অতিক্রম করতে চায় তাকে পেছন থেকে টেনে রাখা হয়।
অথচ চোখের সামনে অনেক দৃষ্টান্ত আছে মেয়েরা লতা নয়। তারা আজ বৃক্ষ হয়ে উঠেছে অনেকে। কাউকে অবলম্বন করে নয় বরং তারাও অনেকের অবলম্বন হয়ে উঠতে পারে।
দাসপ্রথা সেই কবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নারীর দাসত্ব আজও ঘোচেনি। কেন ঘোচেনি কারণ একজন নারীর জীবনসঙ্গীর সঙ্গে সম্পর্ক হয় স্বামী বা প্রভুর। যে স্বামীর অধিকার নিয়ে ঠিক করে দেয় তার স্ত্রী কোথাও যাবে কি যাবে না, কার সঙ্গে কথা বলবে, কী রকম পোশাক পরবে! চাকরি করবে নাকি শুধু সংসার করবে কখন এবং কয়টা সন্তান নেবে।
এই যে পরিবারে নারী-পুরুষের অসম অবস্থান বৈষম্যে ভরা জীবনযাপন, অসম মর্যাদা বা নারীর মর্যাদাহীনতা তা দেখে একটি ছেলেশিশু যখন বেড়ে ওঠে সে তার অবচেতনেই নারীকে শাসন করতে শেখে এবং নিজেকে সে নারীর থেকে উৎকৃষ্ট ভাবতে থাকে। পরিবার থেকেই এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা এই কর্তৃত্ববাদিতা ছড়িয়ে পড়ে গোটা সমাজে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও তাকে সমর্থন দেয়। যদিও রাষ্ট্রের সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকদের জন্য সমঅধিকার ও সমমর্যাদার কথা বলেছে। সংবিধানের অনেকগুলো ধারায় ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিকদের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান মর্যাদার কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তব জীবনে নারী পুরুষের মাঝে অধিকার, মর্যাদা ও সুযোগ লাভের বেলায় যে পাহাড়সমান বৈষম্য তা তো ওপরের আলোচনায় বলা হয়েছে। বৈষম্য প্রকট। কারণ বাস্তব জীবনে সংবিধানের ধারা প্রয়োগের ব্যবস্থা নেই। সেখানে সবকিছু প্রচলিত আইন, প্রথা ও ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসরণ করে চলে। তাই উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে কোথাও নারীরা সীমিত অধিকার তাও বেশিরভাগ কাগজে কলমে পায় কোথাও আদৌ পায় না। সম্পদ-সম্পত্তিতে অধিকারহীনতার কারণেই নারীকে সারা জীবন কারও না কারও অধীনস্থ থাকতে হয়। যে পুরুষ তাকে জন্ম দিল সে যেমন তার অভিভাবক তেমনি আবার কালক্রমে সে যে পুরুষকে জন্ম দেয় একদিন সেও তার অভিভাবক হয়ে ওঠে। আর যে পুরুষ নিজের পূর্ণতার জন্য একজন নারীর পানি গ্রহণ করে ওই নারী ছাড়া কার্যতই সে অর্ধেক-অসম্পূর্ণ সেও বৈবাহিক অসম ব্যবস্থার কারণে ওই নারীর প্রভু, কর্তা ও নিয়ন্ত্রণকারী হয়ে যায়।
কিন্তু ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক ব্যক্তিগত ও গণজীবনে সমান অধিকার সমান সুযোগ লাভের অধিকারী সংবিধানের বেশ কয়েকটি ধারায় বারবার এসব কথা বলার পরও আর একটি ধারায় এও বলা হয়েছে, সমস্ত প্রচলিত আইন ও প্রথা ওই সমস্ত ধারার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ তা আপনাআপনি বাতিল হয়ে যাবে।
এখন কথা হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সংবিধান পড়ে না তাই সংবিধানপ্রদত্ত নাগরিক অধিকার বলে নারী তার প্রাপ্য অধিকার তো দূরে থাকুক জানতেও পারছে না। প্রচলিত পারিবারিক আইন অনুযায়ী নারীর জন্য যেটুকু অধিকার আছে সেভাবেই সব চলছে। কিন্তু রাষ্ট্র তো জানে সব। রাষ্ট্রই সংবিধান প্রণয়ন করেছে তাই অসামঞ্জস্যপূর্ণ আইন বাতিল করে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার নারী যাতে ভোগ করতে পারে সে ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করেনি। জাতিসংঘ সিডো সনদ বা নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপের দলিলেও সেসব কথাই আছে। যে দলিলে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশও স্বাক্ষর করেছে। অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছে রাষ্ট্রে নারীর প্রতি সকল বৈষম্য দূর করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু সেই পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মের দোহাই দিয়ে সিডো সনদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা সংরক্ষণের নামে সম্পদ সম্পত্তিতে এবং বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব সংক্রান্ত নারীর সমঅধিকারের সুযোগ আটকে রেখেছে।
রাষ্ট্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি বা ধর্মের রক্ষকদের এমন আচরণে এটাই বোঝা যাচ্ছে ধর্মের বিধিবিধান যেন শুধু নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রাপ্তির মাঝেই নিহিত আছে। অথচ ধর্মের মূল মর্মবাণী যা হলো মানবতাÑ যা লঙ্ঘন করাই মূলত অধর্ম সেই মানবতা চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। ধর্মের বিপরীতে যে সমস্ত কাজ অধর্ম বলে ধর্মগ্রন্থগুলোতে বলা হয়েছে সেই সমস্ত কাজ- চুরি ডাকাতি, জোর করে অন্যের অধিকার হরণ, ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, লাম্পট্য, বদমায়েশি, নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, গুম, খুন সমানে চলছে। তখন ধর্মের ধ্বজাধারীরা বা এদের পৃষ্ঠপোষকতা করা ধর্ম নষ্ট হচ্ছে বলে টুঁ শব্দটি করে না। তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যায় কেবল নারীকে সম্পত্তির সমান ভাগ দিলে। পরিবারে সমাজে সমান মর্যাদা দিলে। পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্র এদের পৃষ্ঠপোষকতা করে।
এদের আবদার রাখতে রাষ্ট্র ভুলে যায় সংবিধানের ৭, ৯, ২৬, ২৭, ২৮ ধারার কথা, ভুলে যায় সিডো সনদ বাস্তবায়নের রাষ্ট্রের অঙ্গীকারের কথা।
ভুলে যায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সকল আন্দোলনে নারী সমাজের অবদানের কথা। রাষ্ট্র ভুলে থাকে এই দেশের কৃষক নারীদের কথা, গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা যাদের প্রতিদিনের প্রতি ফোঁটা ঘামের রক্ত জল করা শ্রমের কাছে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঋণের পাহাড় জমেছে। জমেছে গৌরবের প্রবৃদ্ধির ঋণ। তাই দিনে দিনে বহু বাড়িয়েছে দেনা কিন্তু এ দেনা এ ঋণ কেউ স্বীকার করে না। এ ঋণ স্বীকার করলে যে নারীকে সমঅধিকার ও সমমর্যাদা দিতে হয়! আর নারীকে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার দিলে যে তার ওপর শোষণ নির্যাতন চালানো যায় না! দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীকে শোষণ করে মুষ্টিমেয় শোষকদের জন্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এই লিঙ্গীয় বৈষম্য জিইয়ে রাখা তাই লিঙ্গীয় রাজনীতির চিরাচরিত কৌশল।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ পঞ্চাশ বছর ধরে এই দেশে নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে এবং প্রায় তিন দশক ধরে আন্দোলন করছে দেশের সকল নাগরিকের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করার দাবিতে।
অভিন্ন পারিবারিক আইন হলো সকল ধর্মের নাগরিকদের জন্য একই রকম পারিবারিক আইন যার বাস্তবায়ন হলে সম্পদ সম্পত্তিতে, বিয়ে বিচ্ছেদ ও সন্তানের অভিভাবকত্ব বিষয়ে নারী-পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। যে অভিন্ন পারিবারিক আইন রচনা করেছেন দেশের বিদগ্ধ আইনবিদগণ আর যা সংবিধান ও সিডো সনদের আলোকে।
কিন্তু সরকার যায় সরকার আসে নারীদের জন্য অনেক কিছু হয় এমনকি তার ক্ষমতায়নের জন্য জোরেশোরে আওয়াজও ওঠে কিন্তু সমঅধিকার ও সমমর্যাদার কথা কেউ বলে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, উন্নয়নের নামে কিছু টাকা আর কিছু উপকরণ দিলে সেটা উন্নয়নই হয় ক্ষমতায়ন হয় না। ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন সমঅধিকার ও সমমর্যাদা। তাই যতদিন নারীর সমঅধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত না হবে আন্দোলন চালু রাখতে হবে।
স্বাতী চৌধুরী : কথাসাহিত্যিক, নারী অধিকারকর্মী ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সূত্র : খোলা কাগজ