কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘অবলা’ কবিতায় নারীর জিজ্ঞাসা তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘কেন নিজে নাহি লব চিনে সার্থকের পথ/ কেন না ছুটাব তেজে সন্ধানের রথ/ দুর্ধর্ষ অশ্বেরে বাঁধি দৃঢ় বল্গাপাশে’
নারীর এই সার্থকতার পথ অনুসন্ধানের দিন ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সার্থকতার পথে সব বাধা-বিঘ্নকে অপসারণের আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়নের অঙ্গীকারের দিন ৮ মার্চ।
সার্থক বা আদর্শ মাতৃ বা দেবীরূপিণী নারী জীবনের যে চিত্র সাহিত্যে, ফিল্মে তুলে ধরা হয়, তা নারীর জীবনের একটি অংশ। প্রকৃতির সন্তান নারী ও পুরুষ।
নারী-পুরুষের সম্মিলনে বহমান থাকে প্রকৃতি। সমাজসভ্যতাকে বহমান করার জন্যও তাই প্রয়োজনে নারী ও পুরুষের সম্মিলিত অভিযাত্রা। নারীর জীবনধারা একটি ছকে ফেলে রাখার চেষ্টা সমাজ প্রগতির যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রাচ্যের নারী আন্দোলনের দার্শনিক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন—
‘মানুষের একটি অঙ্গ অচল হইলে সে কিভাবে উঠিয়া দাঁড়াইবে।
সমাজের একটি অঙ্গ দুর্বল হইলে সে সমাজও পঙ্গুত্ব অর্জন করিবে। ’
সুতরাং এককথায় বলা যায়, নারীকেও পুরুষের মতো পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সব সুযোগ সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। তাই বিংশ শতাব্দীতে উচ্চারিত হয়েছে ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’।
নারীর মানবাধিকার ধারণার বিকাশে ৮ মার্চের ইতিহাসের আছে গুরুত্বপূর্ণ সম্পৃক্ততা। ৮ মার্চ নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপিত হয় ১৯০৫ সালে। সমাজতন্ত্রী নারীদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে প্রস্তাব উত্থাপন করেন সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিন। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, যেকোনো আন্দোলনই সূচনা নির্দিষ্ট দিন দিয়ে শুরু হয় না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে নারী জাগরণের উন্মেষ দেখা যায়; যার ফলে নারী অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রথম যে সভা সংগঠিত হয় সেটি হলো ‘সেনেকা ফলস কনভেনশন’। ১৮৪৮ সালের ১৯ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় এই নারী অধিকার কনভেনশন। দাস প্রথাবিরোধী আন্দোলনের নেত্রীরা এই সভা সংগঠিত করেন। নারীর অধিকার আন্দোলনের প্রথম এই সভায় নারীর সামাজিক, নাগরিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার প্রয়োজন হলো এই কারণে যে নারীর অধিকার যে তার নাগরিক, সামাজিক অধিকার—এই উপলব্ধি প্রথম সভায় ব্যক্ত হয়েছিল। তবে উল্লেখ্য যে ১৯০৫ সাল থেকে নারী দিবসের যে সূচনা প্রস্তাব সেখানে নারীর মানবাধিকার ইস্যুটি প্রচ্ছন্নভাবে পরস্ফুিট ছিল না। নারী দিবস উত্থাপনের মধ্য দিয়ে নারীর মানবাধিকার ইস্যুটি ক্রমে বিকশিত হয়েছে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের উত্থাপিত প্রস্তাবে নারীর ভোটাধিকার এবং নারী শ্রমিকদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ—এই দুটি বিষয় আলোচনায় আসে। অনেক তর্কবিতর্কের পর দুটি দাবিই গৃহীত হয়। নারী দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ১৯১০ সালে জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে। এরপর ১১১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে সমাজের অভ্যন্তরীণ বিকাশ এবং নারী আন্দোলনের শক্তি অর্জনে নারীজীবনের পরিবর্তন নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। একই সঙ্গে নারীজীবনের সংকট, সমস্যারও পরিবর্তন হয়েছে। আন্দোলনের পথ ও কর্মসূচিতে এসেছে নতুন ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি। সামগ্রিকভাবে নারী আন্দোলনের অবস্থানের পর্যালোচনা করে নারী আন্দোলনকে অগ্রসর করার লক্ষ্য নির্ধারণের দিন ৮ মার্চ। ২০২১ সালের ৮ মার্চের এই দিনে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের মূল চ্যালেঞ্জগুলো উল্লেখের চেষ্টা করছি।
নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা
নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের জ্বলন্ত সামাজিক সমস্যা। শুধু নারীর জন্য নয়, রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য অমর্যাদাকর। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, ক্ষমতাসীনদের প্রভাবে তদন্ত বাধাগ্রস্ত করে অপরাধীকে ছাড় দেওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। বিচারের ক্ষেত্রেও দেখা যায় সহিংসতা প্রতিরোধে অতি পুরনো নীতি অনুসরণ করা হয়। আইনগত বিচারের ক্ষেত্রে সরকার গৃহীত আন্তর্জাতিক সনদগুলোর প্রয়োগ দেখা যায় না। সাম্প্রতিককালে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনাগুলোর তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এসব অপরাধের সঙ্গে তরুণরা সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে, যা কিনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও আতঙ্কজনক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার নানা দুর্নীতির ও সমাজবিরোধী কাজের সঙ্গে তরুণ-কিশোরদের সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টাই এর অন্যতম কারণ। স্মরণ রাখতে হবে, ধারাবাহিকভাবে ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতন শুধু সহিংসতার শিকার নারীর জন্য নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অপমান অনেক। অন্যদিকে এসব ঘটনার সমাধানে জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতাও দেখা যায় না। এই প্রসঙ্গে যে প্রশ্নটি রাখতে চাই সেটি হলো, নারী নির্যাতন বন্ধ করার দায় কি শুধু নারী আন্দোলন অথবা নারী সংগঠনের? যেহেতু সমাজ, রাষ্ট্র বা জনপ্রতিনিধিরা নারী-পুরুষের মর্যাদা সুরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ, সেখানে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জনপ্রতিনিধিদের অগ্রসর হওয়া কাম্য। রাষ্ট্রকে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং দায়বদ্ধতার সঙ্গে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দায়বদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার প্রসারের কালে দেখা যাচ্ছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর প্রতি অবমাননাকর, অরুচিকর বক্তব্য ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। ধর্ম প্রচারের নামে নারীর প্রতি যে অশ্লীল বক্তব্য প্রচার করে, তার কোনো বিচার হয় না। আর এসব ঘটনা সমাজে নারীর দুর্বল অবস্থানের নগ্ন প্রকাশ। ক্ষমতার কেন্দ্রে পুরুষতান্ত্রিকতাকে রেখে নারীর মর্যাদা রক্ষা বা সমতা আনয়ন সম্ভব নয়। তাই ২০২১ সালের ৮ মার্চ শপথ নিতে হবে—নারী নির্যাতনবিরোধী সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য বহুমুখী কর্মসূচি নিয়ে সমতাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
সমতার প্রজন্ম গড়ে তোলা
ওপরের আলোচনায় বলতে চেষ্টা করেছি আমাদের বর্তমান সময়ে লিঙ্গীয় বৈষম্যের কারণ ও প্রভাব বিষয়ে সমাজের ধারণাটি এখনো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক, নাগরিক সমাজ, এমনকি নারীসমাজের মধ্যেও লিঙ্গীয় বৈষম্য বিষয়ে ধারণার অস্পষ্টতা বিরাজ করছে। এ কারণে আমাদের প্রচারমূলক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। গণমাধ্যম, শিক্ষা কারিকুলাম, প্রশাসনিক নীতিতে লিঙ্গীয় বৈষম্যের বিষয়ের সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগকে প্রাধান্য দিতে হবে। শুধু নারী সংগঠন নয়, সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমতায় বিশ্বাসী প্রজন্ম গড়ে তোলার আন্দোলন বর্তমান সময়ের অন্যতম দাবি।
নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নারী নেতৃত্বের বিকাশ
নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনে নারীর ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও নাগরিক জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা প্রয়োজন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকেই ক্ষমতায়ন বলা হয়। এর জন্য প্রয়োজন নারীর দক্ষতা অর্জনে সমাজে নারী-পুরুষের জন্য সমসুযোগ বিদ্যমানের বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত। আমরা এখনো বাল্যবিয়ে, পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থান, সামাজিক ক্ষেত্রে, কর্মক্ষেত্রে নারী নিরাপত্তাহীনতা নাগরিক হিসেবে লিঙ্গীয় বৈষম্যের কারণে নারীর ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এগুলো অপসারণের জন্য সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ায় নারীকে সম্পৃক্ত করার জন্য প্রয়োজন বিশেষ উদ্যোগ। এই উদ্যোগের গুরুত্বপূর্ণ দিকে নারী নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করা। শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, সমাজের সব পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নারীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, তৈরি হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে বাধাগুলো চিহ্নিত করে অপসারণের চেষ্টা করতে হবে। এখানে অবশ্যই রাষ্ট্রের এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা ও উদ্যোগী ভূমিকা প্রয়োজন। নারী যেন সব ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে সহায়ক পরিবেশ পায় সে বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। নারীকে বর্তমান সময়ের চাহিদাসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বিকাশ ঘটবে নারী নেতৃত্বের।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে যাত্রা শুরু করেছে। দেশের ৫০ বছর প্রতিষ্ঠালগ্নে এই যাত্রা দেশবাসীর মনে আনন্দ ও আশার সঞ্চার করেছে। উন্নয়নের এই অভিযাত্রায় নারীর অবদান কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পোশাকশিল্প, যা কিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, সেখানে শ্রম প্রদানকারী শক্তির শতকরা ৮০ ভাগ ছিল নারী। অভিবাসী নারীরা দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দেশের জন্য আহরণ করেছেন বৈদেশিক মুদ্রা। কৃষিক্ষেত্রে প্রাথমিক ১৯টি পর্যায়ে রয়েছে নারীর অবদান। ক্ষুদ্রঋণ সফল ব্যবহারের মাধ্যমে নারীরা বিকশিত করে চলেছে গ্রামীণ অর্থনীতি। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে চলেছে। কয়েক বছর আগেও প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ নারী সম্পৃক্ত ছিলেন। সম্প্রতি এই অংশগ্রহণের হার কিছুটা নিম্নমুখী। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসকরণে এ দেশের প্রসূতিবিদরা রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এককথায় বলা যায়, অর্থনীতি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য—সব ক্ষেত্রে নারীর রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাশাপাশি চ্যালেঞ্জিং পেশা, যেমন—পুলিশ, সেনাবাহিনী, গণমাধ্যম, সেখানেও আছে নারীর দৃপ্ত ও সফল পদচারণ। নারী আজ সমাজের বোঝা নয়, জাগ্রত সামাজিক শক্তি। সাম্প্রদায়িকতার অপশক্তিসহ প্রচলিত প্রথা, নীতি, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাঠামো—এই শক্তির বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। শত বছরের অধিক সময়ে বহমান আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আন্দোলন ক্রমান্বয়ে পরিণত ও পুষ্ট হয়ে চলেছে। বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সফল বিকাশ ঘটে বেইজিং প্ল্যাটফর্ম অব অ্যাকশন ঘোষিত কর্মসূচিতে।
বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক কর্মসূচি স্থায়ী উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) যেখানে বলা হয়েছে ২০৩০-এর পৃথিবী হবে ৫০ঃ৫০ অর্থাৎ সমতার বিশ্ব, সেখানে বাংলাদেশও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরাও দেখি নারী-পুরুষের যৌথ অংশগ্রহণ ও অবদানে অগ্রসরমাণ বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন বিগত শতাব্দীগুলো ছিল দাসপ্রথা ও উপনিবেশবাদের কলঙ্কে কালিমালিপ্ত। আমাদের এই শতাব্দী হোক লিঙ্গবৈষম্যের কালিমামুক্ত সমতার বিশ্ব।
২০২১ সালের ৮ মার্চ সামনে রেখে আমরাও বলতে চাই সমতাভিত্তিক, গণতান্ত্রিক, মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা হোক আমাদের লক্ষ্য।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ