বাংলাদেশ আজ ভালো নেই। বেগমগঞ্জের বিবস্ত্র নারীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে বিবস্ত্র করা হয়েছে। বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের খবরে গণমাধ্যম ভরে গেছে—দুই ভাশুরের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, বন্ধুদের নিয়ে প্রেমিকাকে ধর্ষণ, সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ধর্ষণের শিকার স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে আসা তরুণী, সাটুরিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীকে ধর্ষণ, লোহাগড়ায় বিধবাকে ধর্ষণের অভিযোগে ইউপি সদস্য গ্রেপ্তার, খাগড়াছড়িতে স্কুলছাত্রী ধর্ষণের মামলায় পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার, গণধর্ষণের অভিযোগে গৃহবধূর মামলা, চাঁদপুরে শিশু ধর্ষণ, মনপুরায় কিশোরীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ, মুঠোফোনে প্রেমের পরে ডেকে নিয়ে গণধর্ষণ, ইউপি সদস্য কর্তৃক অপহরণ, ধর্ষণ ও ভিডিও ধারণ, ফজরের নামাজ পড়তে উঠে শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করলেন মাদরাসা শিক্ষক, রামপুরায় বিয়েতে অসম্মতির কারণে তরুণী খুন, রাজধানীতে পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণ, রাজশাহীর তানোরে আদিবাসী নারীকে গির্জায় আটকে রেখে যাজকের ধর্ষণ ইত্যাদি। নৃশংসতার সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে সম্প্রতি বেগমগঞ্জে ঘটে যাওয়া নিজ গৃহে নারীকে নগ্ন করে ভিডিও ভাইরাল করার ঘটনা।
বাংলাদেশ কি এখন ধর্ষকের দেশ? নারী নির্যাতনকারীর দেশ? এই প্রশ্ন সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। বেগমগঞ্জের ঘটনার ২৩ দিন পর সবাই জানতে যখন পারল, তখনই সেই নির্যাতনকারী যুবকরা তা ভাইরাল করল। তাহলে প্রশ্ন জাগে আমাদের প্রশাসন, এলাকার সংসদ সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করছিলেন। এলাকার মধ্যে এত বর্বর ঘটনা যারা করেছে সেই বাহিনী এলাকায় তাণ্ডবকারী হিসেবে পরিচিত। এ পর্যন্ত নারী নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরা। তাদের আছে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা, বাহুবলের ক্ষমতা। এই প্রশ্রয়দাতাদের শক্তি কি রাষ্ট্রশক্তির থেকেও বড়? আমরা জাতীয়ভাবে ও বৈশ্বিক সভায় বাংলাদেশের নারীর অগ্রগতির কথা প্রতিনিয়ত শুনছি। কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জরিপে আমরা দেখি, পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৩৪০টি নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে ১২৯টি ধর্ষণের ঘটনা। এর মধ্যে ৭৩ জন শিশু ও ৩৬ জন নারী। ২০টি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১০ জন নারী ও ১০ জন শিশু। ধর্ষণের মতো বর্বরতম ঘটনার মাত্রা কি এখনো আমাদের বিচলিত করে তুলছে না, প্রশ্ন উঠে রাষ্ট্রযন্ত্র কখন সচেতন হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ ঘটছে এসব ঘটনায়। মৌলিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য নারীকে অধিকারহীন করে রাখছে সমাজে, রাষ্ট্রে, পরিবারে। এই অসমতা নারীর মানসিক গঠনেও নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী অংশগ্রহণ করছে; কিন্তু ন্যায্য অংশীদারি পাচ্ছে না। সব ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতির যে ইতিবাচক পথ তৈরি হচ্ছে সেই পথ প্রতিনিয়ত সংকটাপূর্ণ হয়ে উঠছে সর্বাপেক্ষা আদিম বর্বরতা নারীর প্রতি সহিংসতা দ্বারা।
আমাদের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো নারী নির্যাতনের ঘটনায় নারীকে দায়ী করে আঙুল তোলে। প্রথমত, নারী কেন সহিংসতার শিকার হলো, তার পোশাক কেমন ছিল, সময় কী ছিল, সঙ্গে কে ছিল ইত্যাদি। তারপর কারো কারো জিজ্ঞাসা— ঘটনার প্রতিবাদে নারীরা কেন দলে দলে পথে নামছে না। যেন নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এগুলো নারীর বিষয়, শুধু নারীরাই প্রতিবাদ করবে। এটি যে মানবাধিকারের বিষয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে আজও তা মেনে নিতে পারে না।
পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ও রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। সেটা যদি আমরা এখনো গুরুত্ব না দিই, তবে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে দায়ী হয়ে থাকব। চার বছরের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা আজ ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, তা শুধু নারী হওয়ার কারণে। ধর্ষক হিসেবে যাদের দেখা যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই তরুণ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিশোর। এই মানবসম্পদ, যারা আগামী দিনে সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করবে, তাদের মানসিক গঠন যদি হয় এই ধরনের অপরাধপ্রবণ, তবে সেই রাষ্ট্র অগ্রগতি ও উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে পারবে কি না তা গভীর চিন্তার উদ্রেক করে।
আজকে পরিবারের ভূমিকা সামনে এসে যায়। যে ছেলেটি ধর্ষক সে-ও আমাদের সন্তান, যে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সে-ও আমাদের কন্যা। ৯ বছরের মেয়ে যখন প্রশ্ন করে, মা ধর্ষণ মানে কী? তখন তো মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। মনে হয় ৯ বছরের মেয়ের থেকে ছোট মেয়ে আজ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। আজকের নারী নির্যাতনের মহামারি মোকাবেলায় পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। পরিবার হচ্ছে প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে একজন মানবশিশু সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে ওঠে। সেখানে আমি আমার সন্তানকে কী শিক্ষা দিচ্ছি, তা মা-বাবাকে ভাবতে হবে। আমার ছেলে কি ভবিষ্যতে নারীকে সম্মান দিতে শিখবে, না তাকে আমি ধর্ষক করে তুলব। শিশু নিষ্পাপ হয়ে এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো ও মূল্যবোধ তাকে ধর্ষক তৈরি করে। ব্যক্তি নিজ ইচ্ছায় ধর্ষক হয় না।
আমাদের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান যদি পর্যালোচনা করি, তবে আমরা তা স্পষ্টভাবে দেখতে পাই। সমাজের ক্ষমতাবানরা তাদের অপকর্মের ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে এই তরুণসমাজকে। মাদকের ব্যবসাসহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে তাদের যুক্ত করছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়, রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, অর্থের দাপট, পেশিশক্তির ভূমিকা গোটা রাজনীতিকে কলুষিত করছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি অর্থাৎ অপরাধীর শাস্তি না হওয়া অপরাধ বৃদ্ধির আরেকটি বড় কারণ, যা অপরাধীকে অপরাধ করতে সাহস জোগায়, অন্যকেও অপরাধী হতে উৎসাহী করে। সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি বিষয় দেখা যাচ্ছে, প্রতিবাদের মুখে অপরাধী দ্রুত ধরা পড়ছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচার আর হচ্ছে না। নতুন নির্যাতনের ঘটনার আড়ালে পুরনো ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে। অপরাধী নিশ্চিন্তে বিচরণ করছে। অপরাধীর বিচারে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। একজন সংসদ সদস্য, স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতা কোথায়। আজকে সরকারকে কঠোর হতে হবে, যে সংসদ সদস্যের এলাকায় নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটবে তাঁকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তিনি এই ঘটনার জন্য দায়বদ্ধ থাকবেন। নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হতে হবে। বর্তমান সময়ে এই যে ভয়াবহ নৃশংস নারী নির্যাতনের ঘটনা, তার নিয়ন্ত্রণের সুপারিশ প্রদানের জন্য অবিলম্বে একটি কমিশন গঠন করা হোক। যেখানে থাকবেন সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানীসহ নাগরিক সমাজ, আইনজীবী ও নারী আন্দোলনের প্রতিনিধি। এই মাত্রাতিরিক্ত অপরাধের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে ইন্টারনেটের ব্যবহারের প্রতি। প্রযুক্তিকে অস্বীকার করা যাবে না, তবে এটি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তা নীতিনির্ধারকদের ভাবতে হবে। কিশোর ছাত্ররা এই ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রাক্কালে রাষ্ট্রকে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তার ব্যর্থতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে হবে। দেশমায়ের মলিন বদন দেখে যেমন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিরা, আজ আবার সেই মলিন বদন উজ্জ্বল করতে সব সামাজিক শক্তিকে প্রতিবাদ করতে হবে। রাষ্ট্রকে দায়বদ্ধ করতে হবে।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ