৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিডও দিবস। ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ’ সনদ (CEDAW) গ্রহণ করে। ১৯৮০ সালে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সিডও সনদে স্বাক্ষর প্রদান শুরু করে। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে তা কার্যকর হয়।
বাংলাদেশ ১৯৮৪ সালের ৬ নভেম্বর কয়েকটি ধারা সংরক্ষিত রেখে সনদে স্বাক্ষর করে। এখন জাতিসংঘের সিডও সনদ কার্যকর করার ৩৯ বছর এবং বাংলাদেশের স্বাক্ষর প্রদানের ৩৬ বছর অতিক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাক্ষর দানের পরবর্তী ৩৬ বছরে সিডও সনদ বাস্তবায়নের খতিয়ান গ্রহণ বিশেষ দাবি রাখে। ১৯৮৪-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সংরক্ষিত ধারার কিছু অনুমোদন করেছে, তবে ২ নম্বর ধারা ও ১৬(১)(গ) এখনো সংরক্ষিত রয়েছে। এই দুটি ধারা সংরক্ষিত রেখে সিডও সনদ বাংলাদেশের নারী জীবনে কতটুকু প্রভাব রাখতে পারছে তার পরিবীক্ষণ করাও আজকে বিশেষ জরুরি।
সিডও সনদের ২ নম্বর ধারার মূল নির্যাস হচ্ছে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সমতার নীতি রাষ্ট্রের সংবিধানে অথবা অন্য কোনো আইনে এরই মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকলে তার অন্তর্ভুক্তি এবং আইনের মাধ্যমে এই নীতির বাস্তবায়ন। প্রচলিত যেসব আইন, বিধি, প্রথা ও অভ্যাস নারীর প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে, তা বাতিল বা পরিবর্তন করা এবং প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন এ ক্ষেত্রে দরকার। অর্থাৎ সমতার আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা এবং আদালত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা কার্যকর করা।
১৬(১)(গ) ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যের ক্ষেত্রে বিরাজমান পারিবারিক সম্পর্ক, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সম-অধিকার ও দায়-দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।
সিডও সনদের ২ নম্বর ধারার সঙ্গে আমাদের সংবিধানের তুলনা করলে দুটির মধ্যে সার্বিক সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। সংবিধানের ১০, ১৯, ২৬, ২৭, ২৮ ও ২৯ ধারায় রয়েছে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকারে সমতা, আইনের দৃষ্টিতে সমতা, নারীর অনগ্রসরতা দূর করতে বিশেষ সহায়ক বিধান। তাই সিডওর ২ নম্বর ধারা সংরক্ষিত রাখা সংবিধানের মৌলিক ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
মানবাধিকারের পূর্বশর্ত ব্যক্তি অধিকারের স্বীকৃতি, বাংলাদেশের নারী মানুষ হিসেবে ব্যক্তি অধিকার কতটুকু ভোগ করতে পারছে সেটা দেখা দরকার। বাংলাদেশে নারী ব্যক্তি অধিকারের ক্ষেত্রে এখনো বৈষম্যের শিকার। বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকার—এই ক্ষেত্রগুলোতে নারী-পুরুষের বৈষম্য বিদ্যমান, যা নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
সনদের দুটি ধারা সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে বস্তুত নারীর মানবাধিকারকে সোনার পাথরবাটি করে রাখা হয়েছে। সিডও সনদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য সরকারের দায়বদ্ধতা। সিডও কমিটির বিধান অনুযায়ী প্রতি চার বছর পর পর স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রকে জাতিসংঘ সিডও কমিটির কাছে সিডও বাস্তবায়ন রিপোর্ট প্রদান করতে হয়। বাংলাদেশ সরকারও সেই বিধান অনুসরণ করে রিপোর্ট প্রদান করছে। কিন্তু প্রতিবারই রিপোর্ট প্রদানে সংরক্ষণ প্রত্যাহারের অঙ্গীকার থেকে পিছিয়ে আসছে। ২০০৪ সালে সিডও কমিটির সভায় সিডও ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার বিবেচনাধীন বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তী সময়ে সিডও কমিটি সুনির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করার বিষয়ে মত প্রকাশ করে। ২০১৫ সালে এসে সরকার মন্তব্য করে, ‘সমাজ প্রস্তুত নয়’। এমন মন্তব্য কি বাংলাদেশের নারীর অবস্থানের বাস্তবতার সঙ্গে মেলে? বাংলাদেশের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সমাজের সব পর্যায়ে দায়ী নিজের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে নারী। এ ক্ষেত্রে সরকারের নানা ইতিবাচক পদক্ষেপও রয়েছে। এই মন্তব্য বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশে নারী-পুরুষের সমতার পরিবর্তমান বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।
এই সংরক্ষণ নারীর জন্য যেসব ইতিবাচক আইন রয়েছে তার বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত করছে এবং বৈষম্যপূর্ণ আইন ও নীতি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করছে। একই সঙ্গে বলা যায়, সিডও সনদের ২ নম্বর এবং ১৬(১)(গ) ধারা সংরক্ষণ রাখায় অন্য অনুমোদিত ধারাগুলোর ইতিবাচক প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে।
নারীর প্রতি সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা সিডও সনদের বিভিন্ন ধারায় প্রতিফলিত হয়েছে। সামাজিক প্রথা, আচরণ নারীকে যে অধস্তন করে রাখছে, তা পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ নারী-পুরুষের সমমর্যাদার কথা সিডওতে উল্লেখ রয়েছে। সিডও সনদের ধারণার অনুসরণে ১৯৯৩ সালের ভিয়েনা মানবাধিকার সম্মেলনে বলা হয়েছে, ‘নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকার লঙ্ঘন’। কিন্তু সিডও সনদে স্বাক্ষরের ৩৬ বছর পর এবং স্বাধীনতার অর্ধশতক অতিক্রান্ত করার পরও আমাদের সমাজে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করা হচ্ছে না, নারী ইস্যু বলে বিবেচিত হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে এই সহিংসতা নিত্যদিনের ঘটনা। কভিড-১৯-এর এ মহামারি যখন মানবসভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলেছে, তখনো নারী ও কন্যার প্রতি এই নির্যাতন থেমে নেই, বরং আরো ভয়াবহ মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। পারিবারিক সহিংসতা, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন, ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা ইত্যাদি ঘটনা আমরা প্রতিদিনের সংবাদে লক্ষ করছি। সম্প্রতি মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জুলাই মাসে ২৩৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ১০৭ জন ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যা শুধু সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, অপ্রকাশিত ঘটনার সংখ্যা আরো বেশি। এখনো বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের শিকার নারীকে প্রমাণ করতে হয় সে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, অন্যদিকে ধর্ষণকারীকে প্রমাণ দিতে হচ্ছে না। এখানে প্রতিফলিত হচ্ছে নারীর মানবাধিকারের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গি। যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে এখনো আইন প্রণীত হয়নি। যেকোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনায় সর্বপ্রথম অভিযোগের আঙুল তোলা হয় নারীর প্রতি। দেখা হয় কোন ধরনের পরিস্থিতি সেই নারী বা কন্যা সৃষ্টি করেছিল, যার জন্য তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তার পোশাক কেমন ছিল, সময়টা কী ছিল, সঙ্গী কে ছিল ইত্যাদি প্রশ্ন তোলা হয়। যেন সহিংসতার শিকার হওয়ার জন্য সেই নারী বা কন্যা দায়ী। এই হচ্ছে নারীর প্রতি সমাজের বিরাজমান দৃষ্টিভঙ্গি। সিডও সনদের প্রতিটি ধারা এই পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আঘাত হেনেছে।
সরকার বৈশ্বিক উন্নয়ন এজেন্ডা ‘টেকসহ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা’ (SDG) অর্জনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে এবং তা বাস্তবায়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। সেই এসডিজির ৫ নম্বর লক্ষ্য হচ্ছে ‘জেন্ডার সমতা অর্জন ও সকল নারী ও কন্যার ক্ষমতায়ন’। সিডও সনদের পূর্ণ অনুমোদন ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া এসডিজির এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়।
নারীর মানবাধিকার অর্জনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সংবিধান ও সিডও সনদ। কারণ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন সরকার দায়বদ্ধ, তেমনি একইভাবে সিডও সনদ পূর্ণ অনুমোদন ও বাস্তবায়নে বৈশ্বিকভাবে দায়বদ্ধ। তাই সিডও সনদের ২ নম্বর ধারা ও ১৬(১)(গ) ধারার সংরক্ষণ প্রত্যাহার এখন সময়ের দাবি।
লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ