অনিঃশেষ প্রেরণা সুফিয়া কামাল -সীমা মোসলেম

‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উক্তির প্রতিফলন ছিল কবি সুফিয়া কামালের সারা জীবনের কর্মযজ্ঞে। তিনি ছিলেন ইতিহাসের কন্যা। তাঁর জন্ম বিংশ শতাব্দীর শুরুতে (১৯১১ সালের ২০ জুন), প্রয়াত হন বিংশ শতাব্দীর শেষে (১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর)। তাঁর এই ৮৮ বছরের কর্মজীবন পরিপূর্ণ ছিল বহুমুখী মানবিক কর্মকাণ্ডে।

তিনি সত্যিকার অর্থেই নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বিশ্বলোকে মিলিত হয়েছেন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন জননী সাহসিকা, সমাজের বাতিঘর। বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি শতক অর্থাৎ দেশ ভাগ-পূর্ব, দেশ ভাগ-পরবর্তী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা। এ শতাব্দীর বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে সুফিয়া কামালকে জানা যাবে পরিপূর্ণভাবে। তিনি সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন মানবাধিকারের সামগ্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাই তাঁর কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। মানবতার নিরন্তর সাধনায় তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বিশাল ও ব্যাপক। তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে কত ধরনের সংগঠনে সক্রিয় ছিলেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। তিনি জন্মেছিলেন বনেদি পরিবারে। পরিবারে বিদ্যাচর্চা থাকলেও মেয়েদের সেখানে অধিকার ছিল না, সেই সঙ্গে ছিল বনেদি পরিবারের নানা আচার ও নিয়ম-নীতি। এরই মধ্যে তিনি নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে জেনেছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে। তাঁর ব্যক্তিজীবনে নানা ঝড়ঝঞ্ঝা পার হয়ে আসতে হয়েছে। তাঁর দৃঢ়তা ও মনোবলে সব কিছু অতিক্রম করতে পেরেছেন।
১৯২৩ সালে বিয়ে হয়। ১৯২৬ সাল থেকে কলকাতায় বসবাস তাঁর জীবনে বিরাট পরিবর্তন বয়ে আনে। তাঁর স্বশিক্ষার ধারা অগ্রসর হতে থাকে। সাহিত্যচর্চা, সামাজিক কাজ তাঁকে বাইরের জগতের সঙ্গে পরিচিত করে তোলে। ১৯৩২ সালে অকাল বৈধব্য তাঁর জীবনকে আবার সংকটময় করে তোলে।

১৯২৬ সালে সওগাত পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৩০ সালে সওগাতে প্রথম মহিলা সংখ্যায় ছবিসহ লেখা প্রকাশিত হয়। এই ঘটনা তৎকালীন বাঙালি মুসলমান সমাজে বিপুল আলোড়ন তৈরি করে। ১৯২৫ সালে বরিশাল মাতৃমঙ্গলের একমাত্র মুসলিম সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী বরিশাল এলে তিনি নিজ হাতে চরকায় সুতা কেটে প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর হাতে তা তুলে দেন। এভাবে তিনি স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ক্রমাগত নিজেকে পরিবর্তন করে পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডিবদ্ধতা অতিক্রম করতে থাকেন।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত ১৯৪৭-এর দেশ ভাগ দুই বাংলার জনজীবনে বয়ে আনে ব্যাপক সংঘাত-টানাপড়েন ও পরিবর্তন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে তিনি সপরিবারে কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। একই সময়ে পূর্ব বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপরও নেমে আসে নানা বিধি-নিষেধ ও সংঘাত। সেই সময়ের পূর্ব বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল নক্ষত্র লীলা নাগ সাক্ষাৎ করেন সুফিয়া কামালের অস্থায়ী আবাসে। এ যেন ইতিহাসের পরম্পরার একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। লীলা নাগ বুঝেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা তাঁর কর্মকাণ্ডে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতিতে সুফিয়া কামালের মতো ব্যক্তির হাতে তাঁর কর্মকাণ্ডের পতাকা দিয়ে যাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ নানা অশুভ প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুফিয়া কামাল ছিলেন সদা সক্রিয় ও প্রতিবাদী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার জাতিসত্তার অধিকার নিয়ে রুখে দাঁড়ায় এবং এই আন্দোলনে সুফিয়া কামাল রাজপথে অবস্থান নেন। পরবর্তী সময়ে বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল ক্রমেই বাঙালির জাগরণের আন্দোলনে একজন বিশিষ্ট রূপকার হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর ‘একালে আমাদের কাল’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘বেগম রোকেয়ার দারুণ প্রভাব আমার জীবনে। ’ রোকেয়া নারীকে মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আজীবন লড়ে গেছেন। লেখালেখি ও কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সুফিয়া কামাল এই ধারাকে অগ্রসর করে নিয়ে গেছেন।

নারী অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সুফিয়া কামালের ভাবনা বিশ্লেষণ করলে তাঁর চিন্তার অনন্যতায় বিস্মিত হতে হয়। তিনি ছিলেন মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি সব সময় বলতেন, ‘মহিলা পরিষদের প্রত্যেক কর্মীকে হতে হবে এক একটি মহিলা পরিষদ। ’ অর্থাৎ প্রত্যেক কর্মীর নিজের মধ্যে ধারণ করতে হবে মহিলা পরিষদকে। যেখানে এই প্রত্যয় ধারণে প্রত্যেক কর্মী একক। একাধিক এককের সম্মিলনে গঠিত হবে সংগঠন, গড়ে তুলবে আন্দোলন। এককের চিন্তাচেতনা, আদর্শবাদিতা, স্বচ্ছতা ও দৃঢ়তার প্রতিফলন ঘটবে সামষ্টিক সংগঠনে। গঠিত হবে সংগঠনের চরিত্র। তাই মহিলা পরিষদের কর্মীই হচ্ছে মহিলা পরিষদ। সব কর্মীকে তিনি অন্তরে ঠাঁই দিয়েছেন। তিনি শুধু নেত্রীই ছিলেন না। তিনি পাড়ায় পাড়ায়, জেলায় জেলায় ঘুরে কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, সচেতন করেছেন, অনুপ্রাণিত করেছেন। আজকের নারী আন্দোলনের সংগঠকদের তাঁর এই কর্মধারা থেকে অনেক শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।

একালে আমাদের কাল গ্রন্থে সুফিয়া কামাল বলেছেন, ‘আমরা জন্মেছিলাম পৃথিবীর এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞানজগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা—এসবের শুরু থেকে যে প্রভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মধ্যে ছাপ রেখেছে সুগভীর করে। স্বাধীনতা চাই, শান্তি চাই, সাম্য চাই—এই বাণী তখনকার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতো। এখনো মানুষ সেই সংগ্রাম করে চলেছে, একতাবদ্ধ গণজাগরণ চিরকাল জয়ের পতাকা উত্তীর্ণ করেছে। বিশ্বব্যাপী এ সংগ্রামের একদা গণসংহতি জয় লাভ করবে। যুগে যুগে মানুষ এগিয়ে চলেছে অজানাকে জানতে, অদেখাকে দেখতে। এই জ্ঞান সন্ধানই মানবতা, সেকাল থেকে একালে এই সন্ধান একই পথের, চিরকাল ধরে চলবে এ সন্ধান। ’ তাঁর এই অসাধারণ উক্তি আমাদের বুঝিয়ে দেয়, কিভাবে তিনি আপনাকে, নিজের সমাজকে এবং বিশ্বলোককে একই সূত্রে গাঁথতে পেরেছিলেন। সুফিয়া কামালের জীবনসাধনা ও দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের দেশের নারীমুক্তি ও সমাজ বিকাশের ধারাকে যেমন এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব, তেমনি মানবমুক্তির সংগ্রামেও নতুন মাত্রা বয়ে আনতে পারব। তাঁর জীবন আমাদের জন্য অনিঃশেষ প্রেরণা।

লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman