আলো হাতে চলেছে আঁধারের যাত্রী -রাখী দাশ পুরকায়স্থ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাটক ‘রক্তকরবী’ যেন বারবার ঘুরেফিরে আসে আমাদের কাছে। মনে করিয়ে দেয় আঁধার পথ পাড়ি দিতে আলোকবর্তিকা শক্ত করে ধরা, একে আরো প্রজ্বলিত করার শক্তি ও সাহস দেখানোর কথা। সংগ্রাম-ঐতিহ্যের ইতিহাসকে সামনে রেখে বৈরী সময় আর ঘটনাকে মোকাবেলা করার কথা।

সেই ১৯১১ সালে বিশ্বজুড়ে মানবের, নারীর আঁধার পথ পাড়ি দেওয়ার আনুষ্ঠানিক যে পথচলা শুরু হয়েছিল, তা পরিস্থিতি আর সময়ের বাস্তবতায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রাকেই শুধু যুক্ত করে চলেছে।

একদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার বাস্তবতা, একই সময়ে অন্যদিকে পেছনে হাঁটার, পেছনে টানার তীব্র চেষ্টা—একে কিভাবে দেখব, কিভাবে বলব—ভাবতেও অবাক লাগে।
নারী দিবস স্বপ্ন দেখিয়েছে সুস্থ-সুন্দর মানবিক সমাজে সমমর্যাদায় সবার বসবাসের নিশ্চয়তার দিকটিকে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্যে আছি তাকে কি মানবিক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান হিসেবে বাস্তবে বলা যায়?

প্রতিবছর বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেও নারী দিবস পালনকালে অগ্রগতি অর্জনকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়। জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিনের জবানিতে বলা যায়, ‘বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের নেতা, স্পিকার, সংসদ উপনেতা নারী। মন্ত্রিসভায় রয়েছেন চারজন নারী। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে রয়েছেন নারী বিচারপতি। …অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনে শিল্পক্ষেত্রে সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকদের জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি ব্যাংকিং খাত, প্রাইভেট সেক্টর, মিডিয়া, আইন ও বিচারে, রাজনৈতিক ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে, বিভিন্ন পেশায় নারীর উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ দৃশ্যমান হচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েরা অগ্রসর হচ্ছে। …মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও কার্যক্রম, আইন ও নীতি নারী অধিকার সুসংহত করা ও ক্ষমতায়নের অনুকূল ক্ষেত্র নিশ্চিতকরণে কষ্টকর ভূমিকা রয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, স্থানীয় সরকারে সরাসরি নির্বাচনে নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ আইন উল্লেখযোগ্য। ’ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকারের এই সংখ্যাতত্ত্বে চিত্রটি আপাতদৃষ্টিতে যথার্থ বলতে দ্বিধা নেই। কিন্তু গভীরে গেলে আরেকটি দিকও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ক্ষমতায়নের যে দিকটিকে আবশ্যিক হিসেবে দেখা হয়, সেই রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকারে সরাসরি নির্বাচনের ব্যবস্থাসহ আইন করা হয়েছে কিন্তু যেখান থেকে আইন প্রণীত হবে সেই জাতীয় সংসদে নারীদের আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট করে সংরক্ষিত রাখা হয়েছে ঠিকই, তার নির্বাচন পদ্ধতি সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নয়, মনোনয়নের মাধ্যমে। যিনি বা যাঁরা মনোনয়ন দেবেন তাঁদের ইচ্ছা, পছন্দ ও প্রভাবের ওপর ভিত্তি করে সংরক্ষিত আসনে নারী মনোনীত হন এবং এই পদ্ধতিতে ভবিষ্যতেও হবেন। তাহলে নারী জনগোষ্ঠীর কাছে, জনগণের কাছে এই নারী সদস্যদের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহি কিভাবে দৃশ্যমান ও নিশ্চিত হবে? বিষয়টি ‘কিতাবে আছে গোয়ালে নেই’ এই আপ্তবাক্যের মতো হয়ে যায় না কি? যাঁরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে, তাঁদের অবস্থানগত কারণে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের জায়গাও যে দৃশ্যমান, সে কথাটি মিডিয়ার কল্যাণে, নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার আন্দোলন কর্মীদের কর্ম-অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, গবেষকদের তথ্যের মাধ্যমেও আছে দৃশ্যমান।

যে অর্থনীতির চাকাকে মজবুত করতে নারীর শ্রম আর ঘাম আজ নিয়ামক শক্তি, সেই নারীর শ্রমের মূল্যায়নের অসমতা, বঞ্চনা আর না পাওয়ার বাস্তবতা স্বীকার করার দৈন্য কি উন্নয়নের অর্জনের দিক দিয়ে সত্যিই ঢাকতে পারা যাবে? নারীর জন্য কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব পর্যায়ে উপযুক্ত পরিবেশ-নারীবান্ধব পরিবেশ এখন পর্যন্ত জোগান দিতে না পারার দায় কি রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ এমনকি পরিবার এড়িয়ে যেতে পারে?

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। বলা হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েরা অগ্রসর হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষ তুলনামূলক বিচারে ‘অতিউত্তম’ অবস্থানে মেয়েরা যেতে সক্ষম, সে উদাহরণও বহু আছে কিন্তু তাকে মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নবীন প্রজন্মের আরো কত মেয়ে ও ছেলেকে গড়ে তোলা যাবে, সেই পথে কি সত্যিই এগোতে পেরেছে? নাকি বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে গিয়ে বাল্যবিয়েকে প্রকারান্তরে উত্সাহিত করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আইনপ্রণেতারা জনপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে গ্রহণ করে নিলেন। এ ধরনের পদক্ষেপের নেপথ্য কথা সাধারণত সাধারণ মানুষ নারীসমাজ জানতে পারে না। তবে ত্রিকালদর্শীর মতো সমাজে যাঁরা চোখ-কান খোলা রেখে চলেন, তাঁরা হয়তো কেউ কেউ অনুধাবন করেন এবং যথার্থ অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু সমাজ তো ন্যায়-ন্যায্যতাভিত্তিক নয়; তাই তোমার বলা তুমি বলে যাও, আমার যা করার আমি করব বলে দিন চলে যায়। লাভবান হয় তারা, যারা দেশটি প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত প্রজ্ঞাবান প্রগতিমুখী, কুসংস্কার আর কূপমণ্ডূকতামুক্ত, সমতাপূর্ণ, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন করুক, ধারণ করুক—এটা চায় না।

আজকের নারীর যোগ্যতা বৃদ্ধি তার শিক্ষা ও কর্মদক্ষতাকে দৃশ্যমান করে। কিন্তু এর জন্য নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত গৃহশ্রম কোনো ক্ষেত্রেই ছাড় পায়নি পারিবার থেকে, সমাজ থেকে। সরকারের-রাষ্ট্রেরও এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেখা যায় না। যে নারী গৃহে তাঁর মেধা, যোগ্যতা এবং শ্রম ব্যয় করেন, পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা করেন, তাঁর এই শ্রমের এখন পর্যন্ত কোনো মূল্যায়ন নেই। গৃহকাজে নারীশ্রম যে অর্থনীতিরও একটি পরিমাপক—সে বিষয়টি সমাজ-মানসিকতার কারণে আজও জিডিপিভুক্ত নয়। এখনো যে নারী সবার আগে ঘুম থেকে ওঠে এবং সবার পরে ঘুমাতে যায় তাঁকে সে কোনো কাজ করে না শুনতে হয়। এমনও হয়, নারী নিজেই জানেন না তাঁর কাজের অনেক মূল্যায়ন। তাই নিজেই বলে, ‘আমি কোনো কাজ করি না। ’ পাল্টা প্রশ্ন তাহলে কী করেন? এ প্রশ্নটিই তাঁকে সচেতন করে নিজের দিকে ফিরে তাকাতে। অথচ সেই আশির দশকে ভ্যাটিকানের মতো রাষ্ট্র, অধুনা ভুটানের মতো রাষ্ট্রে মেয়েদের গৃহশ্রমের মূল্যায়ন করে অর্থনীতিতে তার অবস্থান যুক্ত করেছে শুধু নারীশ্রমের স্বীকৃতির জন্য নয়, জাতীয় পর্যায়ে নর-নারী উভয়ের অংশগ্রহণের যথার্থ স্বীকৃতি রাষ্ট্র স্বীকার করে—এ কারণে।

ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর চক্রের ‘নারী নরকের দ্বার’—এ কথা যেমন প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, শিক্ষা রাষ্ট্রের সামাজিক বিনিয়োগ; এই বিনিয়োগে নারী-পুরুষ সবার সমান অধিকার ও সুযোগ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে, বাংলাদেশ নামের এই গণপ্রজাতন্ত্রও তা নিশ্চিত করতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ। কাজেই শিক্ষার বাস্তব সর্বাত্মক সুযোগ প্রদানের ব্যবস্থা ও এই শিক্ষা বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনায় লালিত অসাম্প্রদায়িক একমুখী কারিকুলামসংবলিত শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থা চালুর নিশ্চয়তাকে নিশ্চিত করার দায় প্রথমত রাষ্ট্র ও সরকারের। দ্বিতীয়ত, সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার জন্য সংগ্রাম করেন তাঁদের ও তাঁর সঙ্গে যারা এর শিকার এই নারী জনগোষ্ঠীরও। দেশ সমাজে বর্তমানে উন্নয়নের পথযাত্রার পাশাপাশি শঙ্কিত করে তুলেছে তাকে রুখতে হবে। নারী নির্যাতনের জন্য নারীর প্রতি বঞ্চনা আর বৈষম্যের জন্য, প্রাপ্য সুযোগ ও অধিকার না দেওয়ার জন্য অর্ধেক জনগোষ্ঠী পুরুষের দিকেই আপনাআপনি আঙুল উঠেছে; একে রোধ করা তাই শুধু নারীর দায় নয়, পুরুষের দায়ও সমভাবে আসে। সমাজ অগ্রসর হয় পুরুষ ও নারীর মিলিত চেষ্টায় ও সভ্যতার ইতিহাস তাই বলে।

মানবসভ্যতা ভুলে যাওয়া স্মৃতিকে বারবার মনে করায় আগামী দিনের নির্ভুল পথচলায়—অন্ধকার ভেদ করে আলোর পথে চলার। আমরা জানি, সংগ্রামই নতুন নতুন বাস্তবতা মোকাবেলা করতে আঁধার পথে আলোর নিশানা হয়ে দাঁড়ায়। এবারের নারী দিবস তাই সব নেতিবাচক বৈপরীত্যকে মোকাবেলা ও অর্জনকে ধরে রাখার শক্তি হোক অঙ্গীকার।

লেখক : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : কালের কণ্ঠ

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman