একুশ শতকের বাংলাদেশে সুফিয়া কামালের প্রাসঙ্গিকতা – দেবাহুতি চক্রবর্তী

বিশ শতকের বড় একটা অংশজুড়েই পরিব্যাপ্ত সুফিয়া কামালের জীবন। ১৯১১ থেকে ১৯৯৯—এই দীর্ঘ সময় তিনি ঔপনিবেশিক ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী। সীমিত পরিসরে আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতার মূল্যায়ন সহজ নয়।

বরিশালের শায়েস্তাগঞ্জে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

রক্ষণশীলতার আভিজাত্যে ঠাসা সেই পরিবারের অন্দরমহলে বাংলা ভাষার কোনো প্রবেশাধিকার ছিল না। সুফিয়া কামালের জীবনসংগ্রামের হাতেখড়ি বাংলা বলতে, পড়তে ও লিখতে শেখার একান্ত তাগিদের মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষার সঙ্গে পরিচয়ের মাঝ দিয়েই তিনি নিজ দেশ, নিজ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাকে চিনতে ও লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করতে শেখেন। মা সাবেরা বানু ছিলেন জীবনের প্রধান অবলম্বন। বাবা আবদুল বারি জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই সুফি সাধনায় গৃহত্যাগ করায় পিতাপুত্রীর মধ্যে কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তৈরি হয়নি। কিন্তু সংসার-সমাজের কঠিন দায়িত্ব পালন করেও তাঁর অন্তর্জগতে বৈষয়িক জীবন ঘিরে এক ধরনের বৈরাগ্য দেখা যায়।
বৃহৎ বিশ্বজগতের সঙ্গে বালিকাবধূ সুফিয়া কামালকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিচয় করান স্বামী নেহাল হোসেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা ও বিপ্লবীদের সান্নিধ্য, রোকেয়ার সান্নিধ্য, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য তাঁকে দেশের জন্য, সমাজের জন্য, মানুষের জন্য এবং লেখালেখির জন্য বৃহত্তর পরিসরে প্রস্তুত করে। দ্বিতীয় স্বামী কামালউদ্দিন হোসেনও জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করেন। দেশভাগের পর সপরিবারে কলকাতার জীবন ছেড়ে সুফিয়া কামাল স্থায়ী হন ঢাকায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাঁর মধ্যেও একটা প্রচ্ছন্ন আশাবাদের পরিচয় মেলে এই সময়কালে তাঁর লেখা বিভিন্ন কবিতায়। এই আস্থা ভাঙতে সময় লাগেনি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান অবধি সব আন্দোলনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। সেই সঙ্গে নারী মুক্তি আন্দোলন, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবিরোধী আন্দোলন, দুস্থ ও দুর্যোগপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক আন্দোলন, নারী ও শিশু সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডে পাকিস্তান পর্বে তিনি গভীরভাবে জড়িয়ে যান।

মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সব সংকটসংকুল পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী সব কাজের ধারা অব্যাহত থাকে। এক পর্যায়ে ক্ষীণ দেহধারী শান্তশিষ্ট মানুষটি দল-মত-নির্বিশেষে প্রগতিশীল সব নারী-পুরুষের পুরোদস্তুর অভিভাবক হয়ে ওঠেন। সব দুর্যোগ-বিপর্যয়ে, সব সংগ্রামে-সংকটে তাঁকে সামনে রেখে পথচলা জাতির জন্য স্বস্তির হয়ে ওঠে। সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই ওতপ্রোত সম্পর্ক তাঁর সাহিত্যচর্চাকে অনেকাংশেই বিঘ্নিত করে। তা নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো অতৃপ্তি ছিল না। মানুষের জন্য, মানবতার জন্য তিনি নিজেই এক জীবন্ত মহাকাব্য হয়ে ওঠেন। রবীন্দ্রসংগীত তাঁর উপাসনার আসনে স্থান পায়। মুরতাদ, নাস্তিক, কাফের বহুবিধ অভিযোগে মৌলবাদীদের হুমকি ধর্মপ্রাণ এই নারী সাহসের সঙ্গে উপেক্ষা করেন।

একুশ শতকের বাংলাদেশ সুফিয়া কামালকে প্রত্যক্ষভাবে পায়নি। কিন্তু তাঁর হাতে গড়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বহু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান তাঁকে সামনে রেখেই কমবেশি পথ চলছে। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা থেকে বাংলাদেশ আজ বহুলাংশে সরে এসেছে। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখযোগ্য। সব পর্যায়ের কর্মক্ষেত্রে ও বাইরের জগতে নারীর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে অনেক সূচকে মর্যাদাপূর্ণ স্থানে রয়েছে। পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের চারপাশে আজ অন্ধকার ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। বহুমাত্রিক নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তির তৎপরতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বহুমাত্রিক অপরাধের প্রবণতার শিকার হচ্ছে নারী-শিশুসহ দেশের অসংখ্য মানুষ। গণতন্ত্র ও সুশাসনের অভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি রাষ্ট্রের সব কাঠামোকে ভঙ্গুর করছে। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণি, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদের মধ্যেও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর নেই বললেই চলে। শান্ত, নির্ভীক, অকম্পিত কণ্ঠে সুফিয়া কামালের মতো অন্যায়কারীকে ধমক দেওয়ার, জাতিকে পথনির্দেশনা দেওয়ার, পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি ও প্রেরণা জোগানোর অভিভাবকের আজ বড়ই অভাব। অথচ সংকট পেরোনোর সংগ্রামে সুফিয়া কামালের আদর্শ আজও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

আজকের বাংলাদেশে সব বয়সের, সব শ্রেণি-পেশার দিকভ্রান্ত মানুষের জন্য সুফিয়া কামালের জীবন পাঠ ও চর্চা তাই একান্ত জরুরি।

লেখক : সম্পাদক, আন্তর্জাতিক উপপরিষদ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman