ধর্ষণের বিচারপ্রাপ্তি কঠিন করে তুলবে -মালেকা বানু

ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ সহিংসতার শিকার নারীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার পান না ভুক্তভোগী নারীরা। এই অবস্থায় রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর ধর্ষণ মামলার রায়ে আদালত যে রায় ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তা নারীর ন্যায়বিচার পাওয়ার সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে। বিশেষত, রায়ের পর্যবেক্ষণে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পরে পুলিশকে ধর্ষণের মামলা না নেওয়ার ‘নির্দেশনা’ দিয়েছেন বিচারক। আদালতের এ নির্দেশনা বিস্ময়কর ও খুবই দুঃখজনক। এমন নির্দেশনার ফলে ন্যায়বিচারের জন্য ভবিষ্যতে কোনো ভিকটিম থানায় বা আদালতে মামলা করতে যাবেন না। তারা নিরুৎসাহিত হবেন এবং অনিরাপদ বোধ করবেন। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ নিশ্চিতভাবে মানবাধিকার সংরক্ষণের বিষয়টিকে আরও সংকুচিত করবে। এর ফলে অপরাধীরা শুধু পার পেয়ে যাবে না, অপরাধ করতে উৎসাহ বোধ করবে।

আমরা জানি, আইনি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অনেকের মধ্যে জেন্ডার সংবেদনশীলতা এবং মানবাধিকার সম্পর্কিত ধারণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যে নারী-কিশোর বা শিশু ধর্ষণের শিকার হন, প্রথমেই তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ধর্ষণের পর বেশিরভাগ ভিকটিম পরিবার এবং তার আত্মীয়স্বজন ও পারিপার্শ্বিকের কারণে ঘটনাটি ধামাচাপা পড়ে যায়। পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে বেশিরভাগ ভিকটিমকে দীর্ঘ সময় আটকেও রাখা হয়। অনেকে সমাজে একঘরে হয়ে পড়ে। ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশু থানায় গিয়ে নারীবান্ধব পরিবেশ পায় না। ফলে তারা সময়মতো মামলা বা অভিযোগ করতে পারে না। থানায় মামলা নিতে চায় না কিংবা সময়ক্ষেপণ করা হয়। আবার কোনোভাবে মামলা হলেও আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা লক্ষ্য করা যায় না।

আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও জামিনে মুক্ত হয়ে এসে বাদী ও তার পরিবারের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত থাকে। অনেক সময় মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হয় নানাভাবে। বাদীর চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয় নানা উপায়ে। ধর্ষণ মামলা বছরের পর বছর আদালতে চলতে থাকে। তদন্তে দুর্বলতা, সাক্ষী সময়মতো না আসা ও আইনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতার কারণে ভিকটিমরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

বস্তুত, ১৮৭২ সালের প্রণীত সাক্ষ্যপ্রমাণ আইন যুগোপযোগী নয়। এ আইনে বরং ভুক্তভোগী নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ রাখা হয়েছে। সবকিছু মিলে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন।

রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের ঘটনায় যে রায় হলো তাতে কি এটাই প্রমাণিত হলো যে, সেখানে কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি? রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগের বিষয় প্রমাণ করতে পারেনি- এর অর্থ এই নয়, সেখানে ধর্ষণের ঘটনাই ঘটেনি। এই অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারার দায় রাষ্ট্রকে নিতে হবে। কী কারণে অভিযোগ প্রমাণ করা গেল না তা খুঁজে বের করা দরকার, যদি আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই। আদালত নিজেও এ কাজটি করতে পারতেন। পুনঃতদন্তের নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দায়ভার আদালত চাপিয়েছেন বিচারপ্রার্থীর ওপর, যা বিচারপ্রার্থীর বিচার চাওয়ার অধিকারকে খর্ব করার শামিল।

ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সময়সীমা আমাদের প্রচলিত আইন ব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া নেই। কাজেই বিচারকের এ নির্দেশনা কতখানি আইনসিদ্ধ? ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ধর্ষণের আলামত খুঁজে পাওয়া দুস্কর হয়, সে কারণে এই সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা যত উন্নত প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছি, অপরাধ নির্ণয়ে নানা সুযোগ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষা তেমন একটি উপায়। অপরাধ যাতে প্রমাণ করা যায়, সে বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে বিচারক ৭২ ঘণ্টার পরে মামলা না নেওয়ার যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা ধর্ষণের শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার পথ আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর আইনি প্রতিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হয়। এখন যখন আদালত একটি সময় নির্ধারণ করে দিলেন, তখন এ জটিলতা আরও বাড়ল। আদালত এই পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে অপরাধ করে নিস্কৃতি পাওয়ার পথ সুগম করলেন কি? এর ফলে নারী আরও বেশি ধর্ষণ, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হতে পারে- এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই পর্যবেক্ষণ স্পষ্টতই মানবাবিধকার ও ন্যায়বিচার পাওয়ার পরিপন্থি। এ পর্যবেক্ষণ আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।

আমাদের উচ্চ আদালতের একটি রায় আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত একটি মামলায় গত ২০ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়া পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় ধর্ষণ মামলায় আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্ট না থাকলেও ধর্ষণের অভিযোগ মিথ্যা ছিল, তা বলা যাবে না। সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে উচ্চ আদালতের এই রায় যুগান্তকারী। রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার রায়ে বিচারক যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনায় বিচার পেতে ভুক্তভোগীরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, কতজন নারী বিচার পান, তাদের কত সংকটের মুখোমুখি হতে হয়, সামাজিকভাবে তারা কতটা হেয়প্রতিপন্ন হন এবং অভিযুক্তরা কীভাবে ছাড়া পেয়ে যায় তা আমরা জানি। এখন অপরাধীরা চেষ্টা করবে ভুক্তভোগী কোনোভাবে যেন ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মামলা করতে না পারে। ধর্ষকরা ভুক্তভোগীকে ৭২ ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখতে পারলেই বিচারের মুখোমুখি হওয়া থেকে বেঁচে যাবে।

আমরা জানি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তারা অর্থবিত্ত দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ন্যায়বিচারকে প্রভাবিত করে। তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের আঁতাত থাকে। তারা সহজেই বাদীকে মামলা করা থেকে ৭২ ঘণ্টা আটকে রাখতে পারবে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং এই পর্যবেক্ষণ অপরাধীদের যদি ধর্ষণের মতো অপরাধকর্মে আরও উৎসাহিত করে তোলে তার দায় কে নেবে?

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : সমকাল

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman