সমতা ও ন্যায্যতার আন্দোলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ-রেখা সাহা

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ উদারমনস্ক, আধুনিক চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে ১৯৭০ সাল থেকে সমতার লক্ষ্যে বন্ধুর পথে কাজ করে যাচ্ছে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী অগ্রাধিকার বিবেচনায় আন্দোলনের বিষয় ও গতিধারায় পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু আদর্শের জায়গায় থেকেছে অটল। শতাব্দীর নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলনের মর্মবাণীকে ধারণ করে মহিলা পরিষদ শ্রেণি-পেশার নারীদের সংগঠিত করার প্রয়াসে দশকে দশকে গ্রহণ করেছে নতুন কর্মপদ্ধতি ও কর্মপরিকল্পনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এ দেশের নারীদের জীবনে নিয়ে আসে সম্ভাবনা বিকাশের অপার সুযোগ, এক তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক পরিবর্তন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এ দেশের নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ কবি সুফিয়া কামাল সুদূরপ্রসারী চিন্তা নিয়ে গভীর আধুনিক-মনস্কতার সঙ্গে এই পরিবর্তনের তাৎপর্য সংগঠনের রাজনৈতিক ভিত্তিতে যুক্ত করেছিলেন।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেওয়া হয়। সমাজ-রাষ্ট্রের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নারীরা যেন দক্ষতা-যোগ্যতা নিয়ে সম্পৃক্ত হতে পারেন- তাই নারীর শিক্ষার মৌলিক চাহিদা পূরণের দাবিটি মহিলা পরিষদ সামনে নিয়ে আসে এবং এ লক্ষ্যে কর্মসূচি গ্রহণ করে। ৭০-এর দশকে জেলায় জেলায় গড়ে তোলা হয় বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। পরিচালনা করা হয় বিনামূল্যে চিকিৎসাকেন্দ্র্র। ঘরের কাজের বাইরে কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য নারীদের মধ্যে আত্মশক্তি বিকাশের বিষয়টি আলোচনায় যুক্ত করে; উৎসাহিত করে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পভিত্তিক আয়-রোজগারের মাধ্যমে কিছুটা স্বাবলম্বনের পথ অনুসন্ধানের জন্য। নিজেদের কথা নিজেরা বলার জন্য অনুপ্রেরণা দেওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক নারীকে সংগঠিত করার প্রয়াসে আওয়াজ তোলা হয়- ‘গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ো, মহিলা পরিষদ গড়ে তোলো।’

সংগঠন বিস্তৃত হয় কেন্দ্র থেকে জেলা, জেলা থেকে তৃণমূল পর্যন্ত। সমাজ সংস্কারমূলক কাজের মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার সচেতন করে তোলার প্রয়াসে সংগঠনের একটি রাজনৈতিক ভিত্তি গড়ে ওঠে। নারীর জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির কাজটি মূলত একটি রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার কাজ। এই রাজনীতি নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠার রাজনীতি; নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার রাজনীতি। সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র নারীকে যেসব অধিকার দিয়েছে, সেসব অধিকার অর্জনের রাজনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার এই রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়েছে মহিলা পরিষদ। আজকের মূলধারার নারী আন্দোলন সেই ধারাকেই বহন করে চলেছে।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে নানা সমস্যার মধ্যে নারীর প্রতি বৈষম্য, অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত প্রথম বিশ্ব নারী সম্মেলনের ‘সমতা, উন্নয়ন ও শান্তি’র সামগ্রিক কর্মসূচি বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকেও প্রভাবিত করে। সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনের পাশাপাশি ক্রমশ সমানাধিকারের আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি হতে থাকে। নারী আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতার রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণের সূচনা ঘটান। জাতীয় সংসদে নির্ধারিত হয় নারীদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসন।

এই আন্দোলনে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

নব্বইয়ের দশক থেকে মহিলা পরিষদ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে আসছে। মহিলা পরিষদ যৌক্তিক কারণেই মনে করে, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো এবং জনজীবন সংশ্নিষ্ট সব প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সর্বস্তরে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অসমতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এখানে ন্যায্যতার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়। মহিলা পরিষদ বিশ্বাস করে, নারী-পুরুষের মধ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি নানা ধরনের অন্যায় দূর করার প্রক্রিয়া অনেক বেশি জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যক্তির মননে যে নারীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা-বিশ্বাস প্রোথিত, সেই ধারণা-বিশ্বাস পরিবর্তনের জন্য নিতে হবে বহুমুখী রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।

নারীর প্রতি দৃশ্যমান, অদৃশ্য সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে মহিলা পরিষদ একক ও যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলে প্রতিরোধ-প্রতিকারের আন্দোলন। কেন্দ্র্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সহিংসতার শিকার নারী ও কন্যার পাশে দাঁড়ায়; আইনি সহায়তা নিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। বৈষম্যমূলক আইন পরিবর্তনের লক্ষ্যে গড়ে তোলে আইন সংস্কারমূলক আন্দোলন। নারীর ব্যক্তিগত জীবনের মৌলিক বিষয়গুলোতে সমতা আনার লক্ষ্যে তৈরি করে অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রস্তাবনা।

একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, উদার মানবিক সমাজ, রাষ্ট্র না হলে যে সার্বিক অর্থে নারীর মুক্তি আসবে না- এই আদর্শ, বিশ্বাস তাই সংগঠনের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সংগঠক-কর্মীরা ধারণ করে চলেছে। বৈশ্বিক নারী আন্দোলনের সঙ্গে কার্যকর যোগসূত্র অব্যাহত রেখে মহিলা পরিষদ সময়ের সঙ্গে পথ হেঁটেছে। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ-সিডও বাস্তবায়নের আন্দোলনে পালন করে চলেছে অগ্রণী ভূমিকা। বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনার প্রতিফলন ঘটিয়েছে সংগঠনের নিজস্ব কর্মপরিকল্পনায়। অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করা সংগঠনকে সুদূর আগামীর দিকে অগ্রসর করার জন্য সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়ে তরুণ নারীদের যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সমাজের উদারমনস্ক পুরুষদের নানাভাবে যুক্ত করে সংগঠনের সমতার আন্দোলন শক্তিশালী করার প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। মহিলা পরিষদ বিশ্বাস করে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংগঠনকে আরও প্রসারিত করা যাবে এবং ন্যায্যতা ও সমতা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সমাজের সর্বস্তরে সম্প্রসারিত করা যাবে।

নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য, সহিংসতার সংস্কৃতির অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সার্বিক অর্থে ন্যায্যতা ও সমতার আন্দোলন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আরও শক্তিশালী করবে- আজ ৫২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এটাই আমাদের প্রত্যয়।

রেখা সাহা, লিগ্যাল এইড সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল

Share this news on

You might also interest

Shima Moslem

মহিলা পরিষদের পথচলা – সীমা মোসলেম

আজ ৪ এপ্রিল ২০২৩। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সংগঠন গড়ি, নতুন সমাজ বিনির্মাণ করি’—এই স্লোগান নিয়ে স্বেচ্ছাসেবী, গণনারী সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৫৩তম

Read More »
President, BMP

প্রয়োজন গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন প্রযুক্তিনীতি -ফওজিয়া মোসলেম

সমাজতান্ত্রিক নারীদের দ্বিতীয় সম্মেলনে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেিকন আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপনের পর নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে ৮ মার্চ বৈশ্বিক নারী আন্দোলন

Read More »

Copyright 2024 © All rights Reserved by Bangladesh Mahila Parishad, Developed by Habibur Rahman